
লালন ফকির তার একটা গানে লিখেছেন, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজিলে পরে সোনার মানুষ হবি। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, মানুষ জ্ঞানের আধার। মানুষ ছাড়া জগত অচলই শুধু নয়, কল্পনারও অতীত, তাইতো জন-মানবহীন বরফে ঢাকা এন্টার্কটিকা কিংবা জন-মানবহীন বিশাল সাইবেরিয়াতে অবতারকে ডাকার মতো একটা পাণিও নেই। যেখানে মানুষ আছে সেখানে পরিবেশ আছে। সেই মানুষের বাসস্থান ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাই পরিবেশ এবং তাকে ঘিরে আছে প্রতিবেশ এবং প্রকৃতি। মাটি পানি বায়ু ও প্রাণ প্রকৃতি যার প্রধান উপাদান।
সংস্কৃতিতে বলা হয়েছে, মানব দেহের উপাদানেও ক্ষিতি অপ তেজ মরুত এবং বোমের উপস্থিতি রয়েছে। এগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে কোনভাবেই পরিবেশ-স্বাভাবিক থাকতে পারেনা। পরিবেশের ক্ষতির কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে আর তার নেতিবাচক ফলাফলের কারণে পৃথিবীব্যাপী মানুষ বাসের অযোগ্য হয়ে পরছে, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি হওয়ায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের উপর পরিবেশের নেতিবাচক পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পৃথিবীর শুভবুদ্ধির মানুষেরা, বিভিন্ন সংস্থা বা ফোরামে মাধ্যম চেষ্টা করছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে যত প্রাকৃতিক কারণ তার চেয়ে বেশি যুক্ত মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম কারণ। এই মানুষের মধ্যে যতোটা আছে অসচেতনতা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি আছে লোভ এবং স্বার্থবাদীতা। মুনাফার বিষয়টি বড় করে দেখতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে। বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণে দেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস নামে একটি দিবস পালন করা হচ্ছে। প্রতিবছর দিবসটি পালনের সময় পরিবেশ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সামনে রেখে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় ও একটা শ্লোগান নির্ধারণ করে থাকে। এবছরেও সে রকম করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করো এখনই’। তবে আইন হলেই হবেনা, তা বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এর জন্য ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, এই দায়িত্বের মধ্যে আইনি দায়বদ্ধতার সাথে সাথে বিবেকী দায়বদ্ধতাও থাকতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশমনকল্পে এই আইনগুলি হয়েছে।
জলাধার, নদনদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, দীঘি-পুকুর ঝর্ণা বা জলাশয় হিসেবে সরকারি জমি রেকর্ড ভুক্ত স্থাপনা এমনভাবে পরিবর্তন করা যাবেনা যাতে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মধ্যে পরে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য যা নিজস্ব ভৌত বা রাসায়নিক গুণগত কারণে অথবা অন্যান্য বর্জ্য বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়া, জীবন সংক্রামণ দহন, বিস্ফোরণ-ক্রিয়া তেজস্ক্রিয়া, ক্ষয়-ক্রিয়া বা অন্য কোনভাবে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবেনা। বায়ু মাটি ও পানির তাপ, স্বাদ ও গন্ধের পরিবর্তন, দূষিত-করণ বা উহাদের ভৌতিক ও রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীসমুহের পরিবর্তন অথবা বায়ু মাটি ও পানির মধ্যে কোণ রাসায়নিক উপাদান প্রবেশ করিয়ে তার স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন করা যাবেনা।
শিল্প ও কারখানা আইনানুযায়ী রিফাইন না করে শিল্পের কোন বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা যাবেনা। শিল্পের স্থানীয়করণ না করে যেখানে- সেখানে ইট ভাটা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন ও ডায়িং কারখানা করে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়ীর হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ, মাইকের শব্দ, ব্যান্ডশোর নামে শব্দদূষণ মানুষকে বধির করে দিচ্ছে। শব্দের সহনীয় মাত্রা যেখানে ৬০ ডেসিবল সেখানে ১০০ থেকে ১৫০ ডেসিবলের মধ্যে মানুষকে চলতে হচ্ছে। বাঙালির বাণী প্রধান সংগীতকে আজ বাদ্য প্রধান করে শব্দদূষণ করছে। ৭০ এর দশকে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটাতে পৃথিবীব্যাপী বনভূমি হ্রাস করে চাষের জমি বৃদ্ধির তত্ত্ব দিয়ে নরম্যান বোলগার ১৯৭০ সালে সবুজ বিপ্লবের নামে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তার অর্ধশতাব্দীর পর এসে বনভূমির অভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পরেছে পৃথিবীর মানুষ ও জীববৈচিত্র্য, প্রচারণা শুরু হয়েছে পরিবেশ রক্ষায় ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা লাগবে, সে কারণে এক সময় শুরু হয়ে ছিলও সামাজিক বনায়নের এবং এখনও চলছে বসতভিটায় এবং তার চারপাশে গাছ লাগানোর। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান জনগণের খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার ব্যবহার করা হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ও পানির ক্ষতি হচ্ছে মৎস্য ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। পোকা-মাকড় দমনের নামে ব্যবহৃত কেমিক্যালে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করছে।
নির্মাণ শিল্পের উপকরণের অপরিকল্পিত পরিবহন, সংরক্ষণের কারণে বাতাসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি ধুলা বালি প্রাকৃতিক বাতাসকে দূষিত করছে। নগর জীবনে যাতায়াতের রাস্তা-ঘাটের অভাব, যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড এবং শিশার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পরেছে। সর্বশেষ পরিবেশের জন্য অভিশাপ হিসেবে হাজির হয়েছে প্লাস্টিক এর ব্যবহার। প্লাস্টিক এর ব্যবহার একন সর্বত্র দেখা মিলে। এর মধ্যে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক (Single use plastic) আরও বেশি ক্ষতিকারক। এরা একই সাথে মাটি ও পানির ক্ষতি করছে। পরিবেশসম্মত এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত পাট শিল্পকে অবজ্ঞা এবং আদমজী বন্ধের মাধ্যমে নতুন আপদ হিসেবে ‘প্লাস্টিক’ হাজির হয়েছে। শিল্প কারখানা থেকে পরিত্যক্ত বর্জ্য রিফাইন না করে বাইরে ফেলায় একসাথে পানি ও বাতাসকে দূষিত করছে। শিল্পের বর্জ্য, গ্রিন হাউজ গ্যাস, অতিরিক্ত শিশা বাতাসে তাপমাত্রা বাড়িয়ে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার কারণে অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির ফলে সময়-অসময়ে খরা হওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা-হীনতার সৃষ্টি করেছে। এসি থেকে নির্গত সিএফসি গ্যাস বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরের ক্ষতিসাধন করে সূর্য থেকে অনেক ক্ষতিকর উপাদান পৃথিবীতে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। নদী ও সাগরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাধারগুলির পানিধারণ ক্ষমতা কমে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক শেল্টারে থেকে নদী-খাল-দখল করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। উপকূল অঞ্চল পানির তলায় ডুবে যাওয়ায় স্থানচ্যুত হয়ে বেকার হচ্ছে অগণিত মানুষ। ফলে অসংখ্য মানুষ খাদ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্বাহীনতায় ভুগছে।
পৃথিবীতে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতিনিয়তই রিফিউজির সংখ্যা বাড়ছে। সেখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলে পৃথিবীর জন্য বার্ডেন হয়ে পরবে। পরিবেশ বিপর্যয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও দেশগুলিকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সচেতন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া আরও জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সমঝোতায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রাণ-প্রকৃতি তথা পরিবেশ রক্ষার দায় নিতে হবে। কারণ এ বিশ্ব বসবাসের উপযোগী না থাকলে আমি-আপনি-আমরা কেউই নিরাপদ থাকতে পারবোনা।