ইয়োম কিপ্পুর থেকে ইরান-ইসরায়েল : আর্থিক নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকিং এলিটদের যুদ্ধ
সাফায়াতুল ইসলাম সৌরভ
আমাদের চোখের সামনে যে যুদ্ধগুলো ঘটছে, সেগুলো একইরকম ধারা অনুসরণ করে–প্রতিবারই একই চূড়ান্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য, যা হলো- ধান্দাবাজ ব্যাংকিং এলিটদের আর্থিক ক্ষমতা।
সচেতন যারা, তারা হয়তো ইতোমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন কিভাবে আমাদের এক শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে একটি ভুয়া আর্থিক ব্যবস্থা দিয়ে ঠকানো হচ্ছে। আপনি যদি এ বিষয়ে নতুন হন, তাহলে আমি পরামর্শ দেবো যে আপনি প্রথমে মৌলিক বিষয়গুলো জেনে নিন- তা না হলে এই কথাগুলো আপনার মাথার ওপর দিয়ে যাবে।
১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়: সে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন ডলারকে স্বর্ণমান থেকে বিচ্ছিন্ন করে, ব্রেটন উডস ব্যবস্থার সমাপ্তি টানে। সেইদিন থেকে, মার্কিন ডলার আর স্বর্ণ দ্বারা সমর্থিত ছিল না, বরং মার্কিন সরকারের ওপর অন্ধ বিশ্বাস দ্বারা। এটি কেবল একটি নীতিগত পরিবর্তন ছিল না- এটি ছিল গোটা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার একটি পুনর্বিন্যাস।
এর প্রভাব তাৎক্ষণিক ছিল; মার্কিন ডলারের মান পড়তে শুরু করে, আর স্বর্ণের দাম ৪০০% বেড়ে যায়- ৪০ ডলার থেকে ১৬০ ডলার প্রতি আউন্স- যা প্রকাশ করে দেয় ফিয়াট মুদ্রা ব্যবস্থা আসলে কতটা দুর্বল ও ভুয়া। শুধু মনে করিয়ে দিই, এই সময়ে ১ পাকিস্তানি রুপির মূল্য ছিল ০.৭৫ মার্কিন ডলার।
“স্বর্ণের বিনিময়ে ডলার” মডেলের পতনের সাথে সাথে মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যও টলতে শুরু করে। বিশ্বজুড়ে ডলারের চাহিদা কমে যায়। মার্কিন অর্থনীতি ভেঙে পড়ছিল, আর সাম্রাজ্যকে কৃত্রিম আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে কিছু একটার দরকার ছিল।
তখনই এলো ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, যাকে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধও বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিজড়া-খকে সমর্থন দেওয়ার পর, কিং ফয়সালের নেতৃত্বে সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলাফল? তেলের দাম বিস্ফোরিত হয়–এক বছরেরও কম সময়ে ৩ ডলার থেকে ১২ ডলার প্রতি ব্যারেল।
আর ঠিক তখনই স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী আমল হলো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার–মাস্টার ম্যানিপুলেটর–রিয়াদে পৌঁছালেন। তার কাজ? সৌদি আরবকে রাজি করানো যে তারা শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে তেল বিক্রি করবে। ইউরো নয়, ইয়েন নয়, স্বর্ণ নয়- শুধু ডলার।
জন পারকিন্স, একজন সাবেক ইকোনমিক হিটম্যান, তার কনফেশনস অফ অ্যান ইকোনমিক হিটম্যান বইয়ে এই সুপরিকল্পিত চালের কথা উল্লেখ করেছেন। এটি কূটনীতি ছিল না- এটি ছিল অর্থনৈতিক যুদ্ধ। ১৯৭৫ সালের মধ্যে এই চুক্তি সম্প্রসারিত হয়েছিল সমগ্র OPEC-G। নতুন ব্যবস্থার জন্ম হলো- পেট্রোডলার। স্বর্ণের বিনিময়ে ডলারের বদলে এলো তেলের বিনিময়ে ডলার।
এটি কেবল একটি আর্থিক চুক্তি ছিল না। এটি ছিল একটি Reset- একটি সযত্নে পরিকল্পিত পদক্ষেপ, যাতে বিশ্বকে আবার মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা যায়। আর জানেন কি? আরব-ইসরায়েল সংঘাতের উভয় পক্ষই একই ব্যাংকিং এলিটদের দ্বারা সমর্থিত ছিল এই ব্যবস্থা সম্ভব করার জন্য। এটি কেবল ধর্মীয় বা আদর্শিক লড়াই ছিল না- এটি ছিল (এলিটদের) আর্থিক আধিপত্যের জন্য একটি স্টেজড ইভেন্ট।
ডলারের আধিপত্য ফিরে এলো, আর তার সাথে এলো প্যাক্স আমেরিকানার (মার্কিন আধিপত্যের যুগ) উত্থান।
এবার বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিরে আসা যাক।
মার্কিন অর্থনীতি আবারও ডুবতে শুরু করেছে। জাতীয় ঋণ এখন ৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। একবার ভাবুন: পৃথিবীর সমস্ত স্বর্ণ একত্র করলেও এর মূল্য ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না। তাহলে বাকি ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার এলো কোথা থেকে?
এটি কখনই বাস্তব ছিল না। শুধু স্ক্রিনে কিছু সংখ্যা- বাতাস থেকে ছাপা। কোনো ব্যাকিং নেই। কোনো জবাবদিহি নেই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: স্বর্ণ-ব্যাকড স্থিতিশীলতা থেকে ফিয়াট-ভিত্তিক চুরির দিকে।
১৯৪৪ সালে, ১ আউন্স স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩৫ ডলার। আজ? ২,৬৫০ ডলারের বেশি। মানে ডলারের মান ৯৮% পড়ে গিয়েছে। যার অর্থ: আপনার সম্পদ, সঞ্চয় ও কঠোর পরিশ্রমের ৯৮% ইতিমধ্যেই চুরি হয়ে গেছে- নিঃশব্দে এলিটদের পকেটে চলে গেছে।
এখন আসা যাক পরবর্তী পর্যায়ে
ফিয়াট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে একটি নতুন ডিজিটাল দাসত্বের মডেলে স্থানান্তর করতে, তাদের পেট্রোডলারের একটি নিয়ন্ত্রিত পতন দরকার। ফাটল ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। আর পরবর্তী বড় ফ্ল্যাশপয়েন্ট কী?
ইরান-ইসরায়েল
এটি কেবল দুটি রাষ্ট্রের সংঘর্ষের বিষয় নয়। আসল খেলা হলো হরমুজ প্রণালি-বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগত তেল চেকপয়েন্ট। ইরান এর উত্তর দিক নিয়ন্ত্রণ করে, আর ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দক্ষিণ দিক। বিশ্বের ৩০% এর বেশি তেল এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এই করিডোর বাধাগ্রস্ত করলেই গ্লোবাল তেল বাজার ধসে পড়বে। বাণিজ্য আটকে যাবে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। পেট্রোডলার ধ্বংস হবে।
আর যদি ডলার ধ্বংস হয়, তাহলে গোটা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা- যা এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি- তা এর সাথে ধসে পড়বে। উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো অরাজকতায় পড়বে। মুদ্রাগুলো ধ্বংস হবে। মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী হবে। এটাই হবে নিখুঁত সময় তাদের “সমাধান” সামনে আনার। সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC)। এটাই হলো ফাঁদ।
একটি পূর্ণ নজরদারি ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি লেনদেন ট্র্যাক করা, প্রোগ্রামযোগ্য ও নিয়ন্ত্রিত হবে। একটি ডিজিটাল মুদ্রা। একটি গ্লোবাল ব্যাংক। কোনো গোপনীয়তা ছাড়া। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। আর মানুষকে এটি গ্রহণ করাতে? তাদের দরকার একটা ক্রাইসিস, দরকার একটা যুদ্ধ।
ঠিক এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতেই ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এর নেপথ্যে, সেই এলিটরা নিঃশব্দে স্বর্ণ সরিয়ে নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফেডারেল রিজার্ভের ৮০%-এর বেশি সোনার মজুদ এখন আর নেই। তাহলে কোথায় গেল? অনেকে সন্দেহ করছেন, তা ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে- কারণ ফেডারেল ও ইসরায়েলের আর্থিক ব্যবস্থা একই ব্যাংকিং পরিবারগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। এই কলাকৌশলগুলো আমরা আগেও দেখেছি।
‘প্যাক্স ব্রিটানিকা’ (ব্রিটিশদের স্বর্ণ-নিয়ন্ত্রণ) থেকে ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ (‘স্বর্ণের বিনিময়ে ডলার’ থেকে ‘তেলের বিনিময়ে ডলারের নিয়ন্ত্রণ’), এবং এখন তারা গড়ে তুলছে ‘প্যাক্স জুডাইকা’- ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, যা পরিচালিত হবে জেরুজালেম থেকে। এটি কোনও থিওরি না। এটা তাদের পরিকল্পনায় যা তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে। তারা ইতোমধ্যেই মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এখন তারা সিবিডিসি (CBDC) বা অন্য কোনও ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে সর্বাত্মক আধিপত্য চায়।
এটি কেবল পূর্ব বনাম পশ্চিম, বহুপাক্ষিক বনাম এককেন্দ্রিক বিশ্বের লড়াই নয়–বরং এটি একটি মেসিয়ানিক যুদ্ধ, যা ক্ষমতা ওয়াশিংটন থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবে। এই সাপের মাথা হলো মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা- ভবিষ্যতের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের লড়াই, এবং এর মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না- বরং এটিকে একই হাত দ্বারা পুনরায় লিখা হচ্ছে।
Login to comment..