
বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক ইতিহাসে বাম প্রগতিশীলদের লড়াই সংগ্রাম তেমনভাবে আলোচিত নয়। তেমনিভাবে মূলধারার ইতিহাস চর্চায় বহু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ উপেক্ষিত থেকে গেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন নারী অনিমা সিংহ। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গেলে কমরেড অনিমা সিংহকে বাদ দিলে তা সম্পূর্ণ হবে না। যদিও মূলধারার ইতিহাসে অনিমা সিংহদের যুগ যুগ ধরে উপেক্ষা করা হয়েছে।
২০১১ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত না হলে তাঁর সম্পর্কে হয়ত জানা আমার পক্ষেও সম্ভব হতো না। তাঁর সম্পর্কে জানার পর থেকে, আমি তাকে পাঠের চেষ্টা করেছি।
অনিমা সিংহ ১৯২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা অন্নদা প্রসন্ন দাস ছিলেন একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। আর তার মাতা আশালতা দাস ছিলেন একজন শিক্ষিত নারী। মূলত তিনি ছিলেন একজন গৃহিণী।
তার দু’ভাই যুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। তাদের জীবন অনিমা সিংহকে আলোড়িত করেছিলো। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন সিলেট মেডিক্যাল কলেজে। মূলত এই মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। এটা ছিলো এমন এক সময়, যখন সামাজিক পরিবেশে নারীদের তেমন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছিলো না। সেসময় সামাজিক আর পারিবারিক বাধা ডিঙিয়ে অনেকেই রাজনীতিতে শামিল হন। তেমনই একজন ছিলেন অনিমা সিংহ।
অনিমা সিংহের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রবল ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো তার মায়ের সহযোগিতায়। কেননা তার মা ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী। সেসময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিলো। এবং অনিমা সিংহের মাতা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সমর্থক।
সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনিমা সিংহের সাথে পরিচয় ঘটে মার্কসবাদের সাথে। মূলত মার্কসবাদ অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে তিনি মেহনতি মানুষের লড়াইয়ে সক্রিয় হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এর ফলশ্রুতিতে তার পরিচয় ঘটে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তার পরিচয়, নিরবচ্ছিন্ন কাজ আর সংকল্পের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন একনিষ্ঠ সভ্য।
প্রথম থেকেই তার সুতীব্র আকর্ষণ ছিলো কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার। কেননা কৃষকদের প্রতি তার ছিলো সুগভীর মমতাবোধ। ফলশ্রুতিতে শুধু ভাবনায় তিনি আর সীমাবদ্ধ রইলেন না। কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে তিনি কৃষক পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে থাকেন। এমনকি পরবর্তীকালে তিনি তাদের সাথে বসবাস করতেও শুরু করেন।
এর মধ্য দিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সাক্ষী হন তিনি। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে সে সময় দেশভাগ হয়ে যায়। আর হাজং কৃষকেরা বিদ্রোহ করতে থাকেন। এসময় বিদ্রোহী হাজং কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তৃতীয়বারের মতো যখন টংক আন্দোলন দানা বাঁধে সেখানে যুক্ত হন অনিমা সিংহ। নানা প্রতিকূলতা ও জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে অনিমা সিংহ কৃষক আন্দোলনে নিজেকে সমর্পিত করেন। কৃষকদের সংগঠিত করে তোলার কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন।
এর পরবর্তী সময়কাল ছিলো মূলত কৃষক আন্দোলনের এক উত্তাল সময়। মূলত ১৯৫০ সালের প্রায় পুরোটা জুড়েই চলেছে দুর্বার কৃষক আন্দোলন। এসময় হাজংদের সাথে তার ছিলো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তিনি হাজংদের সাথে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাদের সংগঠিত করতে ভূমিকা পালন করছেন। এমনকি তিনি সশস্ত্র সংগ্রামেও যোগ দিয়েছেন। এর ফলশ্রুতিতে পাহাড়গুলো যেন একেকটি দূর্গে পরিণত হয়। সেসময় হাজং বেষ্টিত পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও একে একে ছড়িয়ে পড়ে কৃষক আন্দোলনের স্লোগান আর দিকে দিকে বিদ্রোহের বারুদ। সেখানে কোনো নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই। একসাথে কৃষক আর কৃষাণীরা সংগঠিত হচ্ছেন। আর দল বেঁধে তারা লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন।
কিন্তু এই কাজ করাটা খুব সহজ ছিলো না। কৃষকের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনিমা সিংহ দিনের বেলায় সঙ্গীদের সাথে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে আত্মগোপন করে থাকতেন। সন্ধ্যা নেমে এলেই পাহাড়ি ঢাল থেকে নেমে গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে টংক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত অনিমা সিংহ কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে সারারাত ধরে ঘুরে বেড়াতেন।
আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য পুলিশ এই আন্দোলনের সংগঠক ও নেতাদের গ্রেফতার এবং বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করার জন্য গ্রামে ও পাহাড়ি এলাকায় নিশ্ছিদ্র পাহারা বসায়। এইসব পাহারা ও পুলিশি নির্যাতন উপেক্ষা করে আত্মগোপন অবস্থায় দিনের পর দিন অর্ধাহারে অনাহারে কাটিয়েও দৃঢ়চিত্ত অনিমা সিংহ তার কাজ চালিয়ে যেতেন।
পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী কোনো কোনো সময় আন্দোলনরত পুরো এলাকা ঘিরে রাখতো। তখনও অনিমা সিংহ তার সঙ্গীদের সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াইকে সংগঠিত করেছেন। রাতের অন্ধকারে তিনি কৃষাণ আর কৃষাণীদের একত্রিত করেছেন। মাইলের পর মাইল গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারের কাছে তিনি পৌঁছে যেতেন। কৃষকদের উজ্জীবিত করতেন।
তিনি ছিলেন আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতি অবিচল এক যোদ্ধা। কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করতে দৃঢ়তার সাথে তিনি কৃষক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে দুর্গ গড়তে নিজেকে সপে দিয়েছিলেন। এই সময়ে আন্দোলন যতো বেগবান হচ্ছিল পুলিশের নির্যাতনও ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৯৫০ সালেই আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার টংক প্রথা বাতিল করলেও আন্দোলনের সংগঠক নেতাকর্মীদের ওপর চলতে থাকে চরম দমন-পীড়ন ও অত্যাচার। তখন টংক এলাকায় থাকাটা হয়ে পড়ে একেবারেই অসম্ভব। অনিমা সিংহ এমন পরিস্থিতিতে পার্টির নির্দেশে চলে যান সিলেটে।
রাজনীতির টালমাটাল এসময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। কমরেড অনিমা সিংহের ভাই প্রিয়ব্রত দাস ১৯৫০ সালের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হন। বেদনাবিধুর এ সময়ে তার বাবা, মা, ভাই ও অন্যরা দেশত্যাগ করেন। এ সময় অনিমা সিংহ প্রবল মানসিক যন্ত্রণার শিকার হন। এই প্রতিকূল অবস্থা তিনি সাহসের সাথে মোকাবিলা করেন। সবাই দেশ ছাড়লেও, তিনি দৃঢ়চিত্তে সিদ্ধান্ত নেন তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না। তারপর কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে অনিমা সিংহ চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই ১৯৫৫ সালে অনিমা সিংহ ও বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু হয় তাদের জীবনের আরেক সংগ্রামী আখ্যান।
জীবনের এই পর্বে তিনি ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। একদিকে আত্মগোপন আর অন্যদিকে নানাবিধ সংকট তার জীবনকে দুরবস্থার মধ্যে ফেলে। কিন্তু তিনি তো দমে যাওয়ার মতন মানুষ ছিলেন না। নানান সমস্যা ও দুরবস্থার মধ্যেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ এবং ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
দুটি দশক তিনি আত্মগোপনে পার করেছেন। মূলত বিশ শতকের পাঁচ ও ছয় দশক অনিমা সিং এবং মণি সিং দম্পতি আত্মগোপন অবস্থায় কাটান। নিজেরা আত্মগোপনে থাকলেও, তাদের একমাত্র সন্তান দিবালোক সিংহ বড় হলে আত্মগোপন থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় অনিমা সিংহ ত্রিপুরায় চলে যান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয়। সক্রিয়ভাবে তিনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি শরণার্থী শিবিরের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা দেশে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে তার জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয়। এরপর তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার জীবন ছিলো সংকট আর প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবেলার এক কঠিন জীবন।
মার্কসবাদের শিক্ষায় তিনি নিজেকে একজন সত্যিকারের বিপ্লবী চেতনার মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। যে কারণে বয়সের সীমারেখা কিংবা কঠিন পরিস্থিতি তাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে কখনোই দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। আমৃত্যু তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করা ও তাদের ন্যায অধিকারের লড়াই এবং শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে গেছেন।
১৯৭৩ সালে মস্কোতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রবল বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় অনিমা সিংহ নিজের বাসায় রুটি বানাতেন এবং সেই রুটি বিতরণ করা হতো। এভাবে তিনি তার জীবন মানুষের জন্য নিবেদন করে গেছেন।
১৯৮০ সালের জুন মাসে একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং ২ জুলাই তিনি প্রয়াত হন।
অনিমা সিংহ প্রয়াত হয়েছেন আজ প্রায় ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন, বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। ইতিহাসে সুলুক সন্ধান আমাদের করতেই হবে। কেননা ইতিহাস অনেক সময় আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেয়। যখন মূলধারার ইতিহাস আমাদের ব্রাত্য করে রাখে, তখন নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে সেই ইতিহাসকে জনগণের কাছে ছড়িয়ে দিতে হয়। আমাদের পার্টি কিংবা আমাদের গণসংগঠনে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই কমরেড অনিমা সিংহকে চর্চা জারি রাখতে হবে।
বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনীতিতে বাংলাদেশের কৃষক যে সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে রয়েছে সেখানে অনিমা সিংহ আমাদের লড়াইয়ের অনন্ত প্রেরণা হয়ে থাকবেন। ৪৫তম মৃত্যুবাষিকীতে কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা কমরেড অনিমা সিংহকে জানাই লাল সালাম।
লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি