
ধর্মীয় পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থার বিপরীতে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের সমাজব্যবস্থা ছিল গোটা আরব অঞ্চলে সবচেয়ে আধুনিক। এই দেশগুলাতে ছিল না বোরখা হিজাবের বাধ্যবাধকতা। আশির দশকে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী পুরুষ শিক্ষকের অনুপাত ৩০:৭০ ছিল, সেখানে ইরাক ও লিবিয়ায় নারী শিক্ষক/অধ্যাপক ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। এছাড়াও সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আদলে নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার চারটি (অন্ন, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস ছিল প্রশংসনীয়। দেশগুলোতে শুধু ছিল না পশ্চিমা আদলের উদারপন্থি স্বাধীনতা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছদ্মবেশে, কৌশলে, মিডিয়াকে ব্যবহার করে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার জনগণের ভিতর সেই লিবারেলিজমের মাদক প্রবেশ করিয়ে সেখানকার সমাজ অস্থিতিশীল করে দিলো। বিক্ষুব্ধ জনগণ পশ্চিমা উদারপন্থি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলিত হলে তাদের ব্যবহার করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সহায়তায় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী সরকার পতন ঘটিয়েও ফেললো। ফলাফল কী দাঁড়ালো?
লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকে ক্ষমতার লোভে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। উত্থান হলো আইএস নামের ওয়াহাবি সালাফি ফ্যাসিবাদী অপশক্তির এবং বিশ্ব দেখলো তাদের ভয়াবহ বর্বরতা। জনগণ চাইলো লিবারেলিজম আর পেলো সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ। মাঝখান দিয়ে নাগরিক হিসেবে যেই মৌলিক অধিকারের সুবিধাটুকু পেত সেটাও তারা হারালো।
এই গেল আরব অঞ্চলে লিবারেলিজম চেয়ে ফ্যাসিবাদ পাওয়ার উপাখ্যান। এদিকে লিবারেলিজমের জন্মভূমি ইউরোপে বর্ণবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে লিবারেলিজমের অভয়ারণ্যে। পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল পার্থক্যের জায়গাটা হলো, সারা বিশ্বের মতো পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি তাদের কৃষক শ্রমিকের শ্রমের উপর নির্ভরশীল নয়। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতির বড় একটি অংশ আসে প্রাক্তন বা নয়া উপনিবেশিক দেশগুলো থেকে এবং তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার মুনাফা থেকে। যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি নিজেদের কৃষক শ্রমিকের শ্রমের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না, ফলে সেখানে শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। উল্টা সমাজতান্ত্রিক সংগঠনগুলো সোশাল ডেমোক্রেটিক এবং উদারপন্থি বিচ্যুতির দিকে হেলে গিয়েছিলো। আদর্শিক চর্চার অভাবে এবং নয়া উদারবাদী বিরাজনীতিকরণের ফলে তরুন সমাজের মধ্যে যেই আদর্শিক দিকনির্দেশনার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা এখন পূরণ করছে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদী ফ্যাসিবাদ আর অভিবাসীদের মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ। ইউরোপের দেশগুলোতে একেরপর এক ডানপন্থি শক্তির বিজয় এবং অভিবাসী মুসলিমদের বিভিন্ন সহিংসতা এই সত্যেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। এর মাঝে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের অন্যায় যুদ্ধে ব্যাপকহারে সামরিক সহায়তা দিতে গিয়ে এবং রাশিয়ার থেকে সস্তায় জ্বালানি প্রাপ্তি বয়কট করে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি দুর্বল করে ফেলেছে। অন্যদিকে আফ্রিকায় পশ্চিমা বিরোধী আত্মনির্ভরশীলতার যেই জোয়ার গত দুই বছরে সৃষ্টি হয়েছে তাতে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও জার্মানির মতো নয়া উপনিবেশিকতাবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উপার্জনও বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ভারসাম্য করতে গিয়ে নাগরিক সুবিধাগুলো কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে অর্থাৎ পশ্চিমা উদারপন্থি ব্যবস্থা আর নাগরিকদের বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারছে না যা সেখানকার তরুণ প্রজন্মকে উগ্র ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করছে।
২০১৪এর ময়দান ক্যু কালার রেভল্যুশনের পরে সেখানে নব্য নাৎসি ফ্যাসিবাদের যেই উত্থান ঘটেছে তার মূল ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলো সেদেশের লিবারেলরা। এমনকি গত দশ বছরে বাংলাদেশে ওয়াহাবি সালাফি উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির শক্তিশালী হবার পেছনে এদেশের লিবারেলদের ন্যারেটিভগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। এখন আসা যাক লিবারেলিজম কিভাবে ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে তার গভীর বিশ্লেষণে।
“লিবারেলিজমের গর্ভে ফ্যাসিবাদের জন্ম”–এই তত্ত্বটি মূলত মার্কসবাদী, বামপন্থি ও সমালোচনামূলক চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণ থেকে উদ্ভূত। দাবি করা হয় যে উদারনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও সংকট ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো সৃষ্টি করে। তবে এটি কোনো সরলীকরণ নয়, বরং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রক্রিয়াগুলো কাজ করে,
১. অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রেণিবৈষম্যের শোষণ:
★ পুঁজিবাদের সংকট- উদারনৈতিক পুঁজিবাদ চক্রীয় অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করে, যা ব্যাপক বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতা ডেকে আনে।
★ শ্রেণিসংগ্রামের তীব্রতা- শিল্পপতি ও অভিজাত শ্রেণি তাদের সম্পদ রক্ষায় ফ্যাসিবাদী শক্তিকে সমর্থন করে, যারা শ্রমিক আন্দোলন, বামপন্থি বিপ্লব ও সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ দমন করতে সক্ষম।
উদাহরণ- ১৯৩০-এর দশকে জার্মান শিল্পপতিরা (Krupp, Thyssen, IG Farben) হিটলারকে অর্থায়ন করেছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লব প্রতিহত করতে।
২. গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক শূন্যতা:
★ অকার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থা- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে দলীয় কোন্দল, নীতিগত অচলাবস্থা ও দুর্বল নেতৃত্ব জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে তখন ফ্যাসিবাদের দক্ষতার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ফ্যাসিবাদীরা দৃঢ় হাতে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা ও দ্রুত সিদ্ধান্তের লোভ দেখায়।
★ গণতন্ত্রের উপাদানগুলোর অপব্যবহার- ফ্যাসিস্ট দলগুলি নির্বাচনী প্রক্রিয়া, সংবিধান ও আইনের ফাঁক ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসে।
৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নেতিবাচক ফল:
★ সামাজিক বিচ্ছিন্নতা- উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিলেও, এটি সমাজে পরমাণুকরণ (Atomization) তৈরি করে। মানুষ স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, সামাজিক সংহতি ভেঙে যায়।
★ অর্থ ও পরিচয়ের সংকট- ধর্ম, ঐতিহ্য বা সমষ্টিগত লক্ষ্যের অবমূল্যায়নের ফলে মানুষের মধ্যে ‘অর্থশূন্যতা’ পরিলক্ষিত হয়। ফ্যাসিবাদ এই শূন্যতা পূরণে ধর্ম, উগ্র জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধের গৌরব, অন্ধ আনুগত্য, সাম্প্রদায়িকতার আদর্শ সরবরাহ করে।
৪. সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ ও নৈতিক সঙ্কট:
★ ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের বিশ্লেষণ- থিওডর অ্যাডর্নো, হার্বার্ট মার্কুস প্রমুখ যুক্তি দেন যে উদারনীতিবাদ সমস্ত নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যকে আপেক্ষিক করে তোলে। এর ফলে নৈতিক দিকনির্দেশনার অভাব তৈরি হয়।
★ ফ্যাসিবাদের সরলীকৃত ন্যারেটিভ বা বয়ান- এই শূন্যতায় ফ্যাসিবাদ ‘শত্রুর’ (ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কমিউনিস্ট, প্রতিবেশী) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতীয় পুনর্জাগরণের বিভ্রান্তিকর গল্প তৈরি করে, যা জনগণকে সহজে আকর্ষণ করে।
৫. রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার বিপদ:
★ উদারনৈতিক রাষ্ট্র নিজেকে “নিরপেক্ষ” বলে দাবি করায়, এটি পুঁজি ও ক্ষমতার কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অর্থনৈতিক অলিগার্ক্রা রাষ্ট্রকে দখল করে ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা চাপিয়ে দেয়।
★ আন্তোনিও গ্রামসির বিশ্লেষণ- আধিপত্য (Hegemony) বজায় রাখতে শাসক শ্রেণি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করে, যা ফ্যাসিবাদে রূপ নিতে পারে।
জার্মানিতে যেভাবে ফ্যাসিবাদ বিকশিত হয়েছিলো-
★ উদারনৈতিক সংবিধান: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংবিধান সংস্কার
★ সংকট পরিস্থিতি: যুদ্ধ জরিমানা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব→রাজনৈতিক হিংসা (নাৎসি বাহিনী বনাম কমিউনিস্ট)।
★ ফ্যাসিবাদের জন্মপ্রক্রিয়া: সংসদে অচলাবস্থা→হিটলারকে ‘জরুরি ক্ষমতা’ প্রদান→ গণতন্ত্রের বিলোপ।
উপরোক্ত তথ্য, বিশ্লেষণ, দৃষ্টান্ত, উপসর্গ ও তত্ত্বগত ব্যাখ্যার আলোকে বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না কোনোভাবেই। বিগত স্বৈরাচারী শাসনের লিবারেল পলিসিগুলোর কারণে সমাজে যেই সংকটগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো এই দেশকে ওয়াহাবি সালাফি মতবাদভিত্তিক একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করছে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে যে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে কমিউনিস্টদের হাতে, ফলে আসন্ন ফ্যাসিবাদ প্রতিহত ও পরাস্ত করার ইতিহাস অর্পিত গুরুদায়িত্ব কমিউনিস্টদের উপরেই বর্তাবে, যার জন্য কমিউনিস্টদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আর সেইজন্য কমিউনিস্টদের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে-
১. লিবারেল বা উদারনৈতিকদের মিত্র ভাবার ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে।
২. তত্ত্বগত পাঠ্যাভ্যাস বৃদ্ধি করতে হবে, যেন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, মোকাবিলা, দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রশিক্ষিত থাকতে পারে।
৩. শ্রেণিসংগ্রামের কঠোর চর্চায় নিবেদিত হতে হবে যেহেতু কমিউনিস্টদের মূল শক্তির জায়গাটিই হচ্ছে বিপ্লব অভিমুখী একতাবদ্ধ মেহনতি জনতা।
লিবারেলিজমের ফলে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক দুর্বলতা, নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ থেকেই ফ্যাসিবাদের বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সক্রিয় মতাদর্শিক চর্চা, সচেতন নাগরিক সমাজ ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ফ্যাসিবাদ রোধ করতে পারে। যেহেতু পুঁজিবাদের শ্রেণীচরিত্রের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলোর কারণে ফ্যাসিবাদের সম্ভাবনা লুকায়িত থাকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এবং চূড়ান্ত লড়াইটা যেহেতু পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, ফলে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করতে হলে রাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্র অভিমুখী করা ছাড়া বিকল্প নাই। ফ্যাসিবাদের উত্থানের আগেই তাকে এই কারণে প্রতিহত করা প্রয়োজন যে, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাকে বিলুপ্ত করতে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয় নিরীহ মানুষের প্রাণের দামে।
লেখক : সদস্য, সিপিবি, ঢাকা মহানগর উত্তর