মোর্দেকাই ভানুনু, জায়নবাদের দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
১৯৮৬ সালের ৫ অক্টোবর। লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার তিন-পাতাজোড়া প্রতিবেদনে চমকে ওঠে বিশ্ব। গোপনে এক বিপুল পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার তৈরি করে ফেলেছে ইজরায়েল। আর, সেই গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন আর কেউ নয়, সেই গোপন অস্ত্র কারখানারই একজন প্রাক্তন কর্মচারী।
ইজরায়েলের ডিমোনা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বের নেগেভ মরুভূমির মাঝে কাপড় কলের সাইনবোর্ড টাঙানো কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা রহস্যজনক পেল্লায় স্থাপনাটি যে একটি গোপন পরমাণু অস্ত্র তৈরির কারখানা, সেটা এতদিন কেউ কল্পনাও করেনি। এই সত্য যিনি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন বিশ্বের দরবারে তাঁর নাম মোর্দেকাই ভানুনু।
পরমাণু অস্ত্রমুক্ত পৃথিবীর জন্য যাঁরা দেশে দেশে লড়ছে তাঁদের চোখে ভানুনু একজন বিদ্রোহী প্রহ্লাদ। আর ইজরায়েলের জায়নবাদীদের চোখে তিনি ‘বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী’। বিবেকের দংশনে বিদ্ধ ভানুনু প্রকৃতপক্ষে সেই বিদ্রোহী। ইংরেজিতে যাকে বলে হুইসলব্লোয়ার অর্থাৎ হাঁটেহাড়ি-ভাঙা সত্যান্বেষণী। ‘নিউক্লিয়ার অ্যামবিগুয়িটি’ বা ‘পরমাণু বিষয়ক ধোঁয়াশা’-র ছলনার অপনীতি অনুসরণ করে ইজরায়েল তাদের পরমাণু গবেষণার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করে না এখনো। এই ধোঁয়াশার অপনীতিকে সমর্থন করে তাদের অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলি। ইজরায়েলের বাঁধা বুলি ছিল, ‘বিশ্ব নিশ্চিত থাকুক মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলের হাত ধরে পরমাণু বোমার প্রথম আবির্ভাব হবে না’। ভানুনুর পর্দা ফাঁস থেকে যে তথ্য বেরিয়ে আসে, তাতে দেখা যায় ইজরায়েলের তৈরি অস্ত্রের ভাণ্ডারের আয়তন তখনই দাঁড়িয়েছে ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের ভাণ্ডারের চেয়ে বেশি। ভানুনুর ফাঁস করে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় কমপক্ষে ১৫০-২০০-টি পরমাণু বোমা তখনই তৈরি করে ফেলেছে ইজরায়েল। শুধু তাই নয়, পরমাণু বোমার চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর নিউট্রন বোমা তৈরির জন্য প্লুটোনিয়াম প্রক্রিয়াকরণ করা হয় ডিমোনার গোপন কারখানায়। এছাড়াও তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে মজুত ছিল আরো নানা ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র। মাঝারি দূরত্বের পারমাণবিক মিসাইল, পারমাণবিক ল্যান্ডমাইন এবং পারমাণবিক ডুবোজাহাজ।
এই নিয়ে সারা বিশ্বজুড়ে হইচই হলেও প্রতিক্রিয়াহীন থেকেছে ইজরায়েল সরকার। তবে নিষ্ক্রিয় থাকেনি। দেশের ভিতরে নানা সময়ে করা তাঁর রাজনৈতিক অভিমতের জন্য ভানুনুকে কয়েকবারই সতর্ক করেছিল সরকারি বাহিনী। দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁর পিছনে সর্বক্ষণ নজরদারি জারি রেখেছে ইজরায়েলি গোয়েন্দারা। সানডে টাইমস-এর হাতে ভানুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে দিয়েছেন এই খবরও ছিল তাদের কাছে। ৫ অক্টোবর টাইমসের সেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার আগেই ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ মার্কিন পর্যটকের পরিচয়ে প্রেম নিবেদন করে মোসাদের চর এক তরুণী। মধুজাল বিছিয়ে ভানুনুকে রোমে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মোসাদ বাহিনীর একটি দল তাঁকে অপহরণ করে। গোপনে নৌকোয় ইজরায়েলে পাচার করে দেয়। ভানুনুর দেওয়া সচিত্র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যখন সানডে টাইমস-এ ইজরায়েলের গোপন পরমাণু অস্ত্র কারখানার খবর ফাঁস হয়, তখন ভানুনুর হদিশ কেউ পাচ্ছে না। অন্য দেশের মাটিতে অপহরণ করা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। কিন্তু ইজরায়েলের জন্যে কোনও আইন খাটে না। নিরুদ্দেশ হওয়ার কয়েক মাস পর ইজরায়েল সরকার শুধুমাত্র জানায় ভানুনু তাদের কাছে কয়েদ রয়েছে। এবারে বিচার হবে। গোপন বিচারে ভানুনুর ১৮ বছরের কারাদণ্ড হয়। এই আঠারো বছরের মধ্যে এগারো বছরই তিনি ছিলেন ৯ ফুট বাই ৬ ফুটের এমন একটি সেলে, যে অন্ধকূপে ছিল না কোনও জানালা। এমনকী তাঁকে যখন বাইরে নিয়ে আসা হত, তখন তাঁর চারধারে একটি ক্যানভাস দিয়ে ঘিরে রাখা হত, যাতে চারপাশ দেখা না যায়। টানা ১১ বছর ভানুনু ঘাস চোখে দেখেননি। ভানুনু যে রোমে অপহৃত হয়েছিলেন, সেটা তিনি হাতের তালুতে লিখে রেখেছিলেন গোপনে। বিচারের সময় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানের জানালা দিয়ে সাংবাদিকদের হাতের তালু প্রদর্শন করে জানিয়ে দেন। এভাবেই গোটা বিশ্ব জানতে পারে যে তাঁকে রোম থেকে অপহরণ করে এনেছে ইজরায়েল সরকার।
১১ মার্চ, ২০০৩। আর মাত্র ৭ দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাকে আগ্রাসন চালাবে। সেদিনই বিবিসির ‘করেসপনডেন্ট’ শীর্ষক ধারাবাহিকে গিসেলে পোর্টেনিয়ের পরিচালিত ‘ইজরায়েলস সিক্রেট উইপন’ নামে একটি পর্ব সম্প্রচারিতহয়। ওই তথ্যচিত্রে ইজরায়েলের গোপন পরমাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচি সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়। সেই সময়ে শোরগোল তোলা হচ্ছে ইরাক মানব-বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। তৈরি করছে জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র। ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়া মিলে ‘শয়তানের অক্ষ’ গড়ে তুলেছে। ইরাকের হাতে থাকা সমস্ত বিধ্বংসী অস্ত্র অচিরেই আল কায়েদা সহ সন্ত্রাসবাদীদের হাতে চলে যাবে, যদি না ইরাকে যুদ্ধাভিযান চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ইরাক আগ্রাসনের ২২ বছর পর আমরা জানি ইরাকের বিরুদ্ধে তোলা জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণের অভিযোগ ছিল সর্বৈব মিথ্যা। এবং ওই মিথ্যা সজ্ঞানেই প্রচার করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।
আজ একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে
ইরাককে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানকার সমাজকে গোষ্ঠীগত হিংসার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার পর এখন নিশানায় ইরান। এই মুহূর্তে আবার বিবিসি-র সেই তথ্যচিত্রটি দেখা উচিত। ১৮ জুন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ‘ফগি লেন্স’ (কুয়াশামাখা কাচ) শীর্ষক অর্ঘ্য সেনগুপ্তের লেখা উপ-সম্পাদকীয়র শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘হলোকস্টে-র সময়পর্বের ৬ কোটি ইহুদি জনগণের নৃশংস হত্যা কয়েক দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর আজ ট্রাজেডি থেকে স্ট্র্যাটেজি-র রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই রূপান্তরের শুরুয়াৎ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের হাতে, যার মাধ্যমে হলোকস্ট যার হিব্রু প্রতিশব্দ শোয়া হয়ে ওঠে ইজরায়েল রাষ্ট্রের বনিয়াদ। হলোকস্টের উপস্থাপনের ধরন, বা ইজরায়েল নিয়ে কোনও কঠোর জিজ্ঞাসা তুললেই পত্রপাঠ ইহুদি-বিদ্বেষ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। ইজরায়েলের জন্যে বিশ্বের সহানুভূতি আকর্ষণ বেগিনের উদ্দেশ্য ছিল না।... বিগত ৭৫ বছর ধরে ব্যাপকভাবে যে অবিরাম প্রচারের পথে হেঁটেছে ইজরায়েল, তার উদ্দেশ্য শান্তি স্থাপন ছিল না, ছিল প্রতিশোধ পূরণ।
‘গাজার ওপর নামিয়ে আনা হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে তেল আবিবে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে ইহুদি বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করে বলেছে, ইজরায়েল সরকার অতীতের নাৎসি জার্মানির মতো আচরণ করছে। গোড়া থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে গেছে ইজরায়েল।
বিবিসি-র তথ্যচিত্র শুরু হচ্ছে পর্দায় পরপর ভেসে ওঠা কয়েকটি অমোঘ মন্তব্য দিয়ে। ‘মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের রয়েছে অঘোষিত পরমাণু অস্ত্র?’, ‘মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের রয়েছে অঘোষিত জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্রভাণ্ডার?’, ‘মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে বাইরে থেকে অনুসন্ধানী দল আসে না?’, ‘কোন দেশ সত্য উদঘাটককে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে?’ প্রায় ৪৫ মিনিটের এই তথ্যচিত্র এই প্রশ্নগুলিরই সবিস্তার উত্তর দিয়েছে।
ইজরায়েলের পরমাণু অস্ত্রের ইতিহাস শুধু গোপনীয়তায় ঢাকা নয়, তঞ্চকতায়ও ভরা। পঞ্চাশের দশকেই ফ্রান্সের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চুল্লি ক্রয় সংক্রান্ত গোপন চুক্তি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য পেয়েই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি কেনেডির ভয় ছিল এতে তৎকালীন পশ্চিম এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। ইজরায়েল যদিও দাবি করে যে পরমাণু গবেষণার ফল শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হবে, কেনেডি তবু অনুসন্ধানী দল পাঠানোর দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালের মে মাসে যখন অনুসন্ধানী দল ইজরায়েলের পরমাণু কেন্দ্রে আসে, তখন তাদেরকে ধোঁকা দেওয়া হয়। মাটির তলায় যে ছয় মহলা পরমাণু অস্ত্র তৈরির ব্যবস্থাপনা ছিল, তাতে প্রবেশ করার সমস্ত পথকে কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে শুধুমাত্র মাটির ওপরে থাকা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও অন্য ব্যবস্থাপনাগুলো দেখানো হয় অনুসন্ধানী দলকে।
পুরাকথা ও কল্প ইতিহাস নির্ভর করে প্যালেস্তাইনের আরবদের উচ্ছেদ করে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইজরায়েলের পত্তন হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। ধর্ম ও জাতিসত্তা গুলিয়ে দিয়ে প্রাচীন সাধারণ্যে অপ্রচলিত ভাষা হিব্রুর পুনরুত্থানের মাধ্যমে ভাষা ও ধর্মের মিশেলে তৈরি কৃত্রিম ইহুদি জাতিসত্তার ভিতে ওপর তৈরি করা হয় ইজরায়েল। রাষ্ট্রের পত্তনই ঘটে স্থানীয় বাসিন্দাদের বলপূর্বক বহিষ্কার মধ্য দিয়ে। ফলে জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইজরায়েল। কয়েকশ বছরের যে জাতিগত ঘৃণার ধারবাহিকতায় ইহুদিদের গণহত্যার ঘটনা ঘটে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন সময়ে তা সম্পূর্ণভাবেই ইউরোপের ঘটনা। জোর করে প্যালেস্তিনীয় ভূখণ্ডে ইজরায়েল নামের রাষ্ট্র চাপিয়ে দেওয়ার ফলে আরব-ইজরায়েল সংঘাতের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ প্যালেস্তিনীয়দের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার দাবিকে সুকৌশলে ইউরোপের ইহুদি-ঘৃণার সমগোত্রীয় করে উপস্থাপন করে এসেছে ইজরায়েল ও তাদের অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রশক্তি।
এই কৃত্রিম ইহুদি অস্মিতা নির্ভর জায়নবাদের অন্ধমোহে ইজরায়েলের পরমাণু বিজ্ঞানীরা ছয়ের দশকের গোড়ায় শুরু হওয়া পরমাণু অস্ত্র গবেষণায় পরম উৎসাহেই অংশ নিয়েছিল। ওখানে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত বাধ্যতামূলক গোপনীয়তার শর্ত মেনে নিতে আপত্তি ছিল না ওই বিজ্ঞানী বা ভানুনুর মত প্রযুক্তিকর্মীদের। এমনই এক বিজ্ঞানী ছিলেন উজি ইভেন, যিনি ডিমোনো পরমাণু অস্ত্র কারখানায় কর্মরত ছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮। ১৯৯৬ সালে হঠাৎ করেই প্রকাশ্যে চলে আসে মরু অঞ্চলের কয়েকটি জায়গায় তেজষ্ক্রিয় দূষণের চিহ্নের খবর। দেখা যায় ডিমোনোর কর্মী বা প্রাক্তন কর্মীদের অনেকেই ক্যান্সার-সহ নানা কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তখনই প্রশ্ন উঠল সেখানকার কর্মীদের সুরক্ষা ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। যেহেতু সরকারিভাবে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের বিষয়টি কখনো স্বীকার করেনি ইজরায়েল, ফলে তেজষ্ক্রিয় বিদূষণের খবরকেও ধামাচাপা দেওয়া হয়। অসুস্থ কর্মীরা যারা সোচ্চার হয়েছিল সুরক্ষার প্রশ্ন তুলে, সরকার ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। এই ভয় এতটাই ব্যাপক হয় যে ইজরায়েলের সমাজকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের অধিকাংশ এই প্রশ্নে মুখ বন্ধ রাখে। এই সামূহিক নীরবতার ঘটনায় বিহ্বল সাংবাদিক ওলেঙ্কা ফ্রান্জকাই তথ্যচিত্রে দর্শকদের দিকে চোখ রেখে সবিস্ময়ে বলেন, ‘এটাই ইজরায়েল। এই দেশকেও গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়’।
বিবিসি-র এই তথ্যচিত্রে সবিস্তারে দেখানো হয়েছে কীভাবে এত ভয়ভীতি ও ধামাচাপা দেওয়ার নানাবিধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইজরায়েলের পরমাণু কর্মতৎপরতার খবর বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। ১৯৯২ সালে আমস্টারডাম বিমান বন্দরে ইজরায়েলের একটি মালবাহী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, যার ফলে মৃত্যু হয় ৪৩ জন মানুষের। ইজরায়েল সরকার দাবি করে, সেই বিমানে বহন করা হচ্ছিল ফুল ও নানা ধরনের সুগন্ধী। ছ’বছর পর ডাচ সংসদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে ওই বিমানে আসলে বহন করা হচ্ছিল ডিএনএমপি নামের রাসায়নিক, যা একটি অতি বিষাক্ত গ্যাস উৎপাদনের মুখ্য উপাদান। এই রাসায়নিক যাচ্ছিল ইজরায়েলের আরো এক অত্যন্ত গোপন প্রতিরক্ষা স্থাপনা সিয়োনার জৈব পরীক্ষাগারে। কঠোর সামরিক সেন্সরশিপের আওতায় থাকা এই খবরও অপ্রকাশিত থেকে যায় ইজরায়েলের অভ্যন্তরে। ২০০১ সালে গাজায় আক্রমণ চালোনোর সময়ে নতুন এক ধরনের গ্যাস ব্যবহার করে ইজরায়েল সরকার, যা আক্রান্ত প্যালেস্তিনীয়দের শরীরে অদ্ভুত ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। খিঁচুনিতে ছটফট করতে থাকা ১৮০ জন রোগীকে তখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা সন্দেহ করেন বিষাক্ত গ্যাস ছোড়া হয়েছে, যদিও ইজরায়েলিরা দাবি করে সেগুলো নাকি ছিল কাঁদানে গ্যাস।
ভানুনুর সাজার মেয়াদ যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন বিবেকের দংশনে দগ্ধ হয়ে প্রকাশ্যে আসেন আরেক ইহুদি। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন ইতঝাক ইয়াকভ, যিনি ইয়াতঝা নামেও পরিচিত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে তিনি লেখেন তাঁর আত্মকথা নির্ভর একটি উপন্যাস, যেখানে ইজরায়েলের গোপন পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ সংক্রান্ত নানা কর্মসূচির কথা ফাঁস করে দেন আত্ম অনুশোচনা থেকে। খোলাখুলি সাক্ষাৎকারও দেন সেখানকার সংবাদ মাধ্যমে। তিনি জানান, ১৯৬৭ সালে পূর্ব সিনাই মরুভূমিতে পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রতিবেশী শত্রু দেশগুলিকে ভয় প্রদর্শন করে বশে আনার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যার নাম ‘শিমসন বা স্যামসন অপারেশন’। এর রূপরেখা থেকে বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপের দায়িত্বে ছিলেন তিনি নিজে। মিশরের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্যে শেষ মুহূর্তে ওই অপারেশন স্থগিত রাখা হয়।
তথ্যচিত্রে আমরা দেখতে পাই দুই বৃদ্ধ মার্কিন দম্পতিকে। নাম নিক ও মেরি ইওলোফ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই তাঁরা অবিশ্রান্ত ছিলেন যুদ্ধ-বিরোধী প্রচারে। এই তথ্যচিত্রের সময়ে তাঁরা ইরাকে আসন্ন মার্কিনী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার। ১১ বছর ধরে ইজরায়েলের কারাগারে বন্দি ভানুনুকে তাঁরা আইনসম্মতভাবে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন। ভানুনুর জন্মদাতা ধর্মযাজক পিতা ভানুনুকে তাঁর কাছে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সন্তান মোর্দেকাই অস্ট্রেলিয়ায় পরমাণু অস্ত্রবিরোধী খ্রিস্টান ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর। ইওলোফ দম্পতি মার্কিন দেশ থেকে উড়ে আসেন ইজরায়েলে ভানুনুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁদের সঙ্গী হয়েই তথ্যচিত্রে আমরা দেখতে পাই ইজরায়েলের অভ্যন্তরে থাকা পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ো তোলায় অঙ্গীকারবদ্ধ কিছু ইজরায়েলি নাগরিককে, যাঁরাও ছিলেন ভানুনুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার। দেশের ভিতরে ও বাইরে প্রতিবাদের এই সুরের সূত্র ধরেই আমরা দেখতে পাই ইজরায়েলি সংসদের সেই দৃশ্য, যেখানে দেখা যায় এক বামপন্থি ইজরায়েলি আরব সাংসদ ইশাম মাখুলকে যিনি সোচ্চারে দাবি জানাচ্ছেন ইজরায়েলের গোপন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করার। দেখা যায় কীভাবে মাখুলের কন্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সংসদে।
২০০৪ সালে কারাগার থেকে ছাড়া হয় মোর্দেকাই ভানুনুকে, কিন্তু মুক্তি তাঁর হয়নি। অসংখ্য শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় তাঁকে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে। তাঁর দেশের বাইরে যাওয়া নিষেধ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা বারণ। কোনও বিদেশী নাগরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এমনকী কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাসের ধারে কাছে যেতেও তিনি অপরাগ। তার পরেও দমানো যায়নি ভানুনুকে। বারবার তিনি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সোচ্চার হয়েছেন পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার সংকল্পে। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাংবাদিকদের। এর পরিণামে বারবার তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারাগারে। প্যারোলে মুক্তির আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আবার কখনও মুক্তি পেয়েছন। আবার সোচ্চার হয়েছেন। নরওয়ের নাগরিক তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সে দেশে থাকতে চেয়ে বারবার ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন ভানুনু। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবার সেই আবেদন প্রত্যাখান করেছে। ভানুনুকে এখনও ইজরায়েলের ভয়।
ইরানে বিনা প্ররোচনায় গত ১৩ জুন যে সামরিক হামলা চালানো হয় তার উদ্দেশ্য নাকি ‘পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা’কে ব্যর্থ করা। তেমনই দাবি করেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। অথচ তাদের অভিভাবক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গাবার্ড গত ২৫ মার্চ গোয়েন্দা বিষয়ক সিনেট কমিটিকে জানিয়েছেন, ইরানের কোনো পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ পরিকল্পনা নেই সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সারা বিশ্ব জানে, ইরান পরমাণু অস্ত্ররোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আইএইএ-র পর্যবেক্ষকরাও সেখানকার পরমাণু স্থাপনা অনুসন্ধান করে জানিয়েছে যে ইরান কোনও অস্ত্র তৈরি করছে না। তারপরও ইরানে হামলা চালাচ্ছে নিজেদের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে মুখে কুলুপ টানা ইজরায়েল। তবে এবার লড়াই সমানে সমানে। ইরানও প্রত্যাঘাত করছে সুতীব্রভাবে ইজরায়েলের বুকে। প্রতিরোধে কোণঠাসা হয়ে পড়া ইজরায়েল যে তাদের গোপন পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারকে ব্যবহার করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? ফলে বিশ্ব আবার একটি পারমাণবিক বিধ্বংসের অধ্যায়ে প্রবেশ করছে কি না তা বলবে আগামী সময়।
বিবিসি-র সেই চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী তথ্যচিত্রটি কিন্তু এখন আর তাদের ওয়েবসাইটে নেই। স্বাভাবিক। তবে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী যোদ্ধাদের দৌলতে ইউটিউবে এখনো রয়েছে। সেটাই এখন যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি অস্ত্র।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও গবেষক
সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ
Login to comment..