শ্রেণি সংগ্রাম জোরদার করতে হবে
‘কমিউনিস্টরা সর্বত্রই বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলন সমর্থন করে। এইসব আন্দোলনের প্রত্যেকটির প্রধান প্রশ্ন হিসেবে তারা সামনে তুলে ধরে মালিকানার প্রশ্ন, তার বিকাশের মাত্রা তখন যাই থাকুক না কেন।’
যে কোন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা বা করণীয় সম্পর্কে ধারণা পেতে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এর এই দুটি বাক্যই যথেষ্ট।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের অসাধারণ গণঅভ্যুত্থান ছিল ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাত করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। সেই অভ্যুত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি, দল, সংগঠন ও ব্যক্তি যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় ছিল। ফ্যাসিবাদের পতনের পর প্রত্যেকেই নিজ নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। বহুমাত্রিক এই দ্বন্দ্বে কমিউনিস্টদের প্রভাবক শক্তি হয়ে উঠতে হলে অবশ্যই মালিকানা তথা শ্রেণির প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে আনতে হবে।
গত প্রায় এক বছরে নানা নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হলেও জুলাই অভ্যুত্থান যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে- তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণ ছিল বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসহ এদেশের বিভিন্ন মত ও পথের রাজনৈতিক দল, গণ সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির দীর্ঘ দেড় দশকের সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের হাজারো মানুষ। এই তালিকায় রয়েছেন কমপক্ষে ১১২ জন শ্রমিক। এছাড়া শিক্ষার্থীসহ যে তরুণরা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের বড় অংশই শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। এছাড়া শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অনেক সদস্য আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। ফলে এই গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিকশ্রেণির অবদান অগ্রগণ্য।
শুধু আন্দোলন অংশগ্রহণ কিংবা আহত-নিহতের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় নয়, গণঅভ্যুত্থানকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন বড় ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতনের মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণির এই সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। গত এক বছরে স্পষ্ট হয়েছে, স্বৈরাচারের বিদায় হলেও তার পরিবর্তে যারা ক্ষমতায় বসেছেন তারা শাসকশ্রেণিরই অংশ। ড. ইউনূস ও তার সরকার এ দেশের শাসকশ্রেণির প্রতিনিধি এবং শাসকশ্রেণির এক মহা-সংকটকালে তারা দেশ শাসনের দায়িত্ব নিয়েছে। সুতরাং তারা তাদের শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কোন পদক্ষেপ নিবে- এমটা আশা করার কোন সুযোগ নেই। ফলে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে এই সংস্কার শাসকশ্রেণির ক্ষমতাকে আরও নিরঙ্কুশ ও দীর্ঘস্থায়ী করবে। এ অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক শক্তির প্রধান কর্তব্য হলও শোষণ-মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং আরও জোরদার করা।
এদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বার বার বিজয় এলেও প্রতিবারই মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি শেষ পর্যন্ত আড়ালে চলে গেছে। পাকিস্তানি শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটানোর মূল লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭১ সালে এদেশের আপামর জনসাধারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। বরং শাসকশ্রেণি পর্যায়ক্রমে এদেশে পাকিস্তান আমলের পুরনো ব্যবস্থাকেই আরও শক্তিশালী করেছে। ফলে শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা বেড়েছে। একশ্রেণির মানুষ ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছে। আর গরীবের জীবন বহুমুখী সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন এই পরিস্থিতিকে আরও দুঃসহ করেছে। ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ভাগাভাগি, ব্যাংক লুট ও বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। সেই সাথে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে গণবিরোধী নানা রকম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব কিছুর প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকহারে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। শিল্প কারখানাসহ বেসরকারি খাতে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হয়নি।
চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সেই দুঃখ, বঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগের স্বৈরতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়ে নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তবে কোন কিছুতেই তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। জনগণের মহা-জাগরণ ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে।
এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মুখে নিপীড়নমূলক কোন ব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না। মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা থেকেও মুক্ত হওয়া সম্ভব। শ্রমিকশ্রেণির অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্টরাই পারে, চলমান সংগ্রামকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের সেই পথে নিয়ে যেতে। দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা, লুটপাটতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে কল্যাণমুখী ও বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে হলে গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে কমিউনিস্টদের সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। সংগ্রাম যেন আরও একবার শ্রমিকশ্রেণির হাতছাড়া হয়ে না যায়।
সম্পাদকীয়
এই ‘আত্মঘাতী প্রবণতা’ কে থামাবে
Login to comment..