
ডেভিড হার্স্ট :
১৯৪০ সালের ১৪ নভেম্বর ব্রিটেনের কভেন্ট্রি শহরে লুফটওয়াফে (জার্মান বিমানবাহিনী) যে বিমান হামলা চালায়, সেটিকে তারা এক চমকপ্রদ প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে নিয়েছিল। জার্মান প্রচারমাধ্যম দাবি করেছিল, এটি ছিল ‘পুরো যুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা’।
নাৎসি জার্মানির প্রধান প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস এ হামলায় এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তিনি ওই হামলার নামে ‘টু কভেনট্রেট’ নামে একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তারপর খুব বেশি দিন না গড়াতেই জার্মানির সেই বিজয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। কারণ, ব্রিটিশরা খুব দ্রুত অ্যারো ইঞ্জিন ও বিমান যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানাগুলো তাদের গোপন কারখানায় সরিয়ে ফেলে। ব্রিটিশদের উৎপাদনক্ষমতা কিছুটা ব্যাহত হলেও ধ্বংস হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যেই এসব কারখানা আবার সম্পূর্ণ উৎপাদনে ফিরে যায়।
আজ আমরা জানি, জার্মানদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ব্রিটিশদের মনোবলকে খাটো করে দেখা। ব্রিটিশরা দ্রুতই পাল্টা আঘাত হানার দুর্দমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। এর কিছুদিন পরেই রয়্যাল এয়ার ফোর্স (আরএএফ) জার্মানিতে বড় ধরনের বিমান হামলা শুরু করে।
সেই পরিস্থিতি এখন ইসরায়েলে দেখা যাচ্ছে। ইরানে হামলার প্রথম ঘণ্টাগুলোতে যে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ইসরায়েলের সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, মাত্র ১২ দিনের মাথায় সেই বিজয় এখন কৌশলগত পরাজয়ের মতো দেখাচ্ছে। সে কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও ইসরায়েল বারবার সেই চুক্তি মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
এখন বোঝা যাচ্ছে, ইসরায়েল তাদের ঘোষিত তিনটি যুদ্ধলক্ষ্যের একটিও পূরণ করতে পারেনি।
প্রথমত, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ‘সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’ বলে দাবি করলেও তার সপক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বলা হচ্ছে, ইরান হামলার আগে অন্তত কিছু সেন্ট্রিফিউজ (পারমাণবিক সরঞ্জাম) নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানে ইরানের ৪০০ কেজির বেশি উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত আছে বলে যে ধারণা করা হয়ে থাকে, তা কতটুকু সত্য তা–ও স্পষ্ট নয়।
যে মুহূর্তে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটি স্পষ্ট করে দেয়, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (যা ইসরায়েলের দ্বিতীয় যুদ্ধলক্ষ্য ছিল) এখনো শক্তিশালী ও কার্যকর এবং ইসরায়েলের জন্য এটি এক স্থায়ী হুমকি।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল যেসব ইরানি জেনারেল ও বিজ্ঞানীকে হামলার শুরুর দিকে হত্যা করেছিল, তাঁদের জায়গায় দ্রুত নতুন লোকদের বসানো হয়েছে।
তৃতীয়ত, সিএনএন গেল মঙ্গলবার জানিয়েছে, পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখার মূল্যায়নে বলা হয়েছে, মার্কিন বাহিনীর যেসব হামলা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হয়েছিল, তাতে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উপাদানগুলো ধ্বংস হয়নি। এ হামলা বড়জোর কয়েক মাসের জন্য ইরানের কার্যক্রম পিছিয়ে দিতে পেরেছে।
সুতরাং এ যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের অর্জনের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতিই বেশি হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ইসরায়েল এখন আর এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার চিত্র আঁকতে পারছে না।
যদি কভেন্ট্রির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছু বোঝা যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কয়েক মাসের মধ্যে আবার চালু হয়ে যাবে। সেটি ‘অনেক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে’ বলে যুক্তরাষ্ট্র যেমনটা বলছে, আসলে তা ঠিক নয়।
কারণ কী? কারণ, ইরানের হাতে প্রযুক্তি আছে, দক্ষতা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার করার জাতীয় দৃঢ়সংকল্প আছে। অর্থাৎ ইরান ঝড়ের ধাক্কা সহ্য করে তারা টিকে গেছে।
যে মুহূর্তে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটি স্পষ্ট করে দেয়, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (যা ইসরায়েলের দ্বিতীয় যুদ্ধলক্ষ্য ছিল) এখনো শক্তিশালী ও কার্যকর এবং ইসরায়েলের জন্য এটি এক স্থায়ী হুমকি।
১২ দিনে ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যতটা ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা দুই বছর ধরে হামাসের দেশীয় রকেট বা মাসের পর মাস হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি।
এই ১২ দিনে ইসরায়েলি নাগরিকেরা ধ্বংসাবশেষ দেখেছে। তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো ভেঙে পড়েছে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। এই দৃশ্য তারা শুধু গাজা বা লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর দেখেছে। এখন সেই ধ্বংস তাদের নিজেদের ঘরেই হয়েছে। এটি তাদের জন্য বড় ধাক্কা।
ইরান কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। একটি তেল শোধনাগার ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আক্রান্ত হয়েছে। ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের কড়া সেন্সর নীতির কারণে এসব দাবি যাচাই করা কঠিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের শাসনব্যবস্থা এখনো অটুট। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের এই একতরফা ও বিনা উসকানির আক্রমণ ইরানের জনগণকে শাসকদের পেছনে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ তাদের এক করেছে, বিভক্ত করেনি।