
লেবাননের রাতের আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দৃশ্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ইরান থেকে ছোড়া এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর ভিডিও অনেকে পার্টি, ডিনার বা বিয়ের অনুষ্ঠানের পটভূমি হিসেবে শেয়ার করছেন। কেউ খুশি, কারণ তারা মনে করেন- যে ইসরায়েল গত বছর লেবাননে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, এবার ওই ইসরায়েলই হামলার শিকার। আবার অনেকেই স্বস্তি পান এই ভেবে যে ক্ষেপণাস্ত্র তাদের দেশ নয়, অন্য কোথাও আঘাত করছে। এই দ্বৈত অনুভূতি শুধু লেবাননে নয়, পুরো আরব বিশ্বেই প্রতিফলিত হচ্ছে।
ইসরায়েল ও ইরান কেউই প্রিয় নয়
গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযানে আরব দুনিয়ার সহানুভূতি অনেকটাই ফুরিয়ে গেছে। আগে যারা ইসরায়েলের প্রতি নিরপেক্ষ ছিলেন, তারাও আজ সমালোচক। গাজায় সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, হাসপাতাল ধ্বংস, শিশুদের মৃত্যু-এসব চিত্র আরবদের মধ্যে ক্ষোভ ও ক্ষত তৈরি করেছে। তাই এখন ইসরায়েলের শহরে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের দৃশ্য অনেকের কাছে প্রতিশোধের চেহারা নিয়েছে।
তবে একে ইরানের জন্য সমর্থন ভাবার সুযোগ নেই। বহু বছর ধরে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহ, হুথি ও অন্যান্য মিলিশিয়া গড়ে তুলে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। এসব গোষ্ঠী হত্যা, চাঁদাবাজি, এমনকি সৌদি আরব ও আমিরাতে হামলাতেও যুক্ত ছিল। ফলে আরবদের চোখে ইরান এক দমনমূলক পরাশক্তি- যাকে ঘৃণা করা যায়। কিন্তু ভয়ও করতে হয়।
ইরান দুর্বল, আনন্দ ও বিদ্রুপ
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিপর্যয় আরব বিশ্বে কৌতুক ও স্বস্তির জন্ম দিয়েছে। ইরানের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা বাহিনীতে ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ। সিরিয়ায় ইরানি কমান্ডারদের মৃত্যু- এসব ঘটনায় অনেক আরব খোলাখুলি সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।
সিরিয়ায় এই প্রতিক্রিয়া আরও প্রবল। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে টিকিয়ে রেখেছিল ইরান। এখন ওই ইরান-সমর্থিত কমান্ডারদের মৃত্যুকে অনেক সিরিয়ান উদযাপন করছেন। কেউ কেউ এমনকি খালি ইরানি দূতাবাসে মিষ্টি নিয়ে গেছেন। একজন রসিকতা করেন, ‘এটাই এখন ইরানের একমাত্র নিরাপদ ভূখণ্ড, কারণ এখানে কেউ নেই।’
যুদ্ধ যেন বিনোদনের রূপ
আরবদের কাছে এই সংঘাত এখন অনেকটাই দূরবর্তী এক নাটক। ১৯৮০-এর ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন উভয় পক্ষকেই ‘শুভকামনা’ জানাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই একই কথা বলছেন। কেউ কেউ সন্ধ্যায় খাবার-দাবার প্রস্তুত করে ‘ইরান-ইসরায়েল ম্যাচ’ উপভোগ করছেন।
মিডিয়া-গণমাধ্যমের দ্বৈত ভূমিকা
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা ইরানের প্রতি তুলনামূলক সহানুভূতিশীল। চ্যানেলটি ইসরায়েল-বিরোধী। এদিকে কাতার ও ইরান যৌথভাবে পারস্য উপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র ব্যবহার করে। এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও ছায়া পড়েছে সংবাদ কভারেজে।
অন্যদিকে সৌদি নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবারের সংঘাতে আশ্চর্যজনকভাবে নিরপেক্ষ। অতীতে ইরান-বিরোধী প্রতিবাদে তারা সোচ্চার থাকলেও এখন স্বর সংযত। কারণ ইরান যদি সৌদিকে এই সংঘাতে অভিযুক্ত করে, তবে আক্রমণ চালাতে পারে- যেমনটা ২০১৯ সালে হয়েছিল। এতে সৌদি মিডিয়াকে বলা হয়েছে ইসরায়েলের পক্ষে কথা না বলতে এবং ইরানি দুর্বলতা নিয়ে উল্লাস না করতে। তবে ইরানে যদি শাসনব্যবস্থার পতন হয়, তখন সুর বদলাতে পারে।
ইসরায়েল শক্তিশালী, তবে বন্ধুহীন
এই সংঘাত ইসরায়েলকে নিজের আঞ্চলিক ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছে। আমিরাতের শিক্ষাবিদ আব্দুল খালেক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ইসরায়েল প্রতিদিনই দেখাচ্ছে, সে কতটা ভয়ংকর এবং শক্তিশালী।’ কিন্তু এই শক্তি প্রশংসার চেয়ে বেশি উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে-এমনকি মিত্র দেশ আমিরাতের মধ্যেও।
ইসরায়েল তার শত্রুদের সাময়িকভাবে পরাজিত করতে পারছে। কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে ব্যর্থ। গাজায় যুদ্ধ অব্যাহত, ফিলিস্তিনদের মানবিক বিপর্যয় দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীলতার মুখে।
দুবাই-ভিত্তিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ বাহারুন বলেন, ‘আজ ইসরায়েল এই অঞ্চলের অস্থিরতার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে।’ উপসাগরীয় দেশগুলো শান্তি চায়। কিন্তু ইসরায়েল যেন আগুন চায়।
[দ্য ইকোনমিস্ট থেকে সংক্ষেপিত, অনুবাদ করেছেন লেখক]