সাহিত্যে নারীত্বের নির্মাণ বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা ডেস্ক : সকল মাধ্যমে পুরুষদের আধিপত্য চলে আসছে অনন্তকাল থেকে, বাংলা সাহিত্যে নারীর নির্মাণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ছাপ প্রকাশ পেয়েছে। কবিতা, উপন্যাস, গল্পে পুরুষরা তাঁদের নিজস্ব ধারাতেই, নারীদের গড়েছেন। আমরা যদি বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করি, সেখানেও দেখা যায়, নারীদের সেই একই ছকে ফেলে নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা যদি খুব ভালভাবে দেখি, তাহলে প্রায় বেশিরভাগ গল্প, উপন্যাসে যে সকল ‘ভালো’ নারীদের দেখা মেলে তাঁরা হন- পরমা সুন্দরী, সতী, কিঞ্চিৎ বুদ্ধিমান, ত্যাগ স্বীকারকারী। আবার ‘মন্দ’ নারীরা হন- চালাক, স্বার্থপর, চরিত্রহীন ইত্যাদি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহিত নারী চরিত্রগুলির সতীত্ব দিয়ে গড়া, আবার বিধবাদের তিনি ব্রহ্মচারিনী হিসাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। খুব ভালভাবে যদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি পাঠ করা হয়, তাহলে বোঝা যায় ‘নারীর সতীত্ব’-কে তিনি অনেক স্থানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মৃণালিনীর মনোরমা, বিষবৃক্ষের সূর্যমুখী, রজনীর লবঙ্গলতা, কৃষ্ণকান্তের উইলের ভ্রমরকে সতীসাবিত্রী হিসাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন। আবার বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইলের দুই বিধবা চরিত্র কুন্দনন্দিনী ও রোহিণীর প্রেম হয়তো তিনি মেনে নিতে পারেননি। সমাজের চাপানো বিধিনিষেধকে কুন্দনন্দিনী মেনে নিতে চাননি। তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন। সমাজের বঞ্চনা সহ্য করে মুখ বুজে চুপ করে থাকতে চাননি। যেহেতু তাঁরা বিধবা, অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে পড়ছেন তাই তাঁদের চরিত্র অনেকখানি ধূসর! উপন্যাসে কুন্দনন্দিনী ও রোহিণীর মৃত্যু ঘটেছে। রোহিণী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, লাস্যময়ী, চঞ্চল ও বিধবা। বিধবা রোহিণী বিবাহিত গোবিন্দলালকে ভালোবাসতেন। গোবিন্দলালকে না পাওয়ার কষ্টে তিনি একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। বিধবা নারী রোহিণীর চরিত্র সৃষ্টি করে, বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রোহিণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেইসময় পাঠকদের মধ্যে আলোড়ন পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এ প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শনে লিখেছিলেন- ‘অনেক পাঠক আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন- রোহিণীকে মারিলেন কেন? অনেক সময়ই উত্তর দিতে বাধ্য হইয়াছি, আমার ঘাট হইয়াছে। সমালোচকরা মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্রের এ ধরনের মনোভাবের জন্য নীতিবাদী বঙ্কিমের কাছে শিল্পী বঙ্কিমের পরাজয় ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকে নারীদের সেই একই ছকে ফেলে গড়ে তোলেন। অবলা, সুন্দরী, পুরুষের প্রেরণা ও প্রেমিকা রূপেই দেখা যায়। তবে উনিশ শতকে বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের দেখা মেলা যেখানে দুষ্কর সেইসময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর নারী চরিত্রদের উপস্থাপন করেছেন সঠিক মতামত প্রদানকারী-সাহসী-স্বাধীনচেতা, হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরি সাহিত্যিকরা বিধবা নারী চরিত্রদের সৃষ্টি করেছেন অসহায়ভাবে। দুর্ভাগা নারীরা বৈধব্য জীবনের অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়ায়, এইসব চিত্র সাহিত্যিকরা তখন তাঁদের লেখনীর মধ্যে তুলে ধরতেন। সেইসময় বঙ্কিমচন্দ্রও রোহিণী- কুন্দনন্দিনীকে সমর্থন করতে পারেননি। তখন রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- ‘চোখের বালি’-র মতো উপন্যাস। বিনোদিনী চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। একজন স্বাধীনচেতা বিধবা নারীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে উনিশ শতকের পাঠক সমাজ। আবার, ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে সেই একই বাংলার চিরন্তন নারী চরিত্র হিসাবে ধরা দিয়েছেন হেমনলিনী। গোরা, ঘরেবাইরে এবং চতুরঙ্গ উপন্যাসে দেখা মেলে সুচরিতা, বিমলা, দামিনীর সঙ্গে। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের লাবণ্য আধুনিক, স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নারী চরিত্ররা প্রতিবাদী। সেই সময়ের থেকে অনেকাংশে এগিয়ে ছিলেন সকল চরিত্ররা। সমালোচকরা মনে করেন- ঠাকুরবাড়ির আধুনিক, স্বাধীনচেতা নারীদের দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বলিষ্ঠ নারী চরিত্রদের গড়ে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পের নারী চরিত্ররা তৎকালীন সমাজে মুক্তির বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারী চরিত্ররা সরব হয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারী চরিত্ররা প্রতিবাদ করেছেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে আধুনিকতার আলো জ্বালিয়েছেন। ‘স্ত্রীর পত্রের’ মৃণাল, ‘সমাপ্তির’ মৃন্ময়ী, ‘ল্যাবরেটরির’ সোহিনী, ‘শাস্তি’র চন্দরা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার কথা ধ্বনিত হয়েছে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..