কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো যে জীবন সংগ্রামী প্রেরণার উৎস

মৃণাল চৌধুরী

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সাহসী যোদ্ধা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, আমৃত্যু মেহনতি জনগণের স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ, অকৃতদার বিপ্লবী, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো তৃতীয়বারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৫ সালের ৭ জুন রাত ৮টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯১৭ সাল- মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর শোষণ বঞ্চনার অবসান ও মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সমসাময়িক সময়ে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো চট্টগ্রামের কেলিশহরের এক সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা নিরোধা কানুনগোও ছিলেন পার্শ্ববর্তী ধলঘাট গ্রামের অভিজাত পরিবারের মেয়ে। পিতা সুরেন্দ্র কানুনগো ছিলেন পেশায় আইনজীবী। ওকালতি করতেন হাটহাজারী কোর্টে। ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পূর্ণেন্দু কানুনগো বাবার কাছে থেকে হাটহাজারীতেই লেখাপড়া করেন। হাটহাজারী কোর্ট চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হলে তাঁর বাবা ও চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। তাঁকে ভর্তি করানো হয় শহরের মিউনিসিপ্যাল স্কুলে। কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো যখন কৈশোরত্বে প্রবেশ করছিলেন তখন চট্টগ্রাম শহরে অনুশীলন এবং যুগান্তর দলের প্রভাবে স্থানে স্থানে ক্লাব গড়ে তোলা হয়। নিজ গ্রাম কেলিশহরের প্রমোদ বিশ্বাস তখন হাজারী লেইন ক্লাবের নেতৃত্বে ছিলেন। ক্লাবটি ছিল অনুশীলন দলের প্রভাবাধীন। প্রমোদ বিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় কিশোর পূর্ণেন্দু হাজারী লেইন ক্লাবের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েন। ১৯৩৩ সনে বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা বিপ্লবী যুবকদের মধ্যে সৃষ্টি করে টান টান উত্তেজনা। ব্রিটিশ সরকার চরম নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। একে একে ধরা পড়ছেন বিপ্লবী কর্মীরা। এসময়ে সরকার যুবকদের জন্য তিন ধরনের কার্ড চালু করেন। সাদা, নীল ও লাল। সাদা কার্ড ভাল। নীল কার্ড রাজনীতির সাথে কিছুটা সম্পর্কিত এবং লাল কার্ড ধারী হলো বিপদজনক কর্মী। যুবকদের এই কার্ড নিয়ে চলাফেরা করতে হতো। ১০ম শ্রেণির ছাত্র পূর্ণেন্দু কানুনগো লাল কার্ডই পেলেন। যে কোন সময়ে গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন এই ভয়ে বাবা তাঁকে জোর করে জলপাইগুড়ি পাঠিয়ে দিলেন কাকার কাছে। সেখানে ময়নাগুড়িতে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ময়নাগুড়িতে কুমিল্লা জেলার এক অন্তরীণ বন্দির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯৩৫ সনে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর পূর্ণেন্দু কানুনগোকে আবার চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রাম পৌঁছার সাথে সাথে তাঁর উপর গৃহে অন্তরীণের নির্দেশ হয়। বিলে (জমি) ফুটবল খেলা, সংগীত চর্চা, বাঁশি বাজানো ও লাইব্রেরিতে বই পড়া ইত্যাদির সাথে তিনি যুক্ত হন। এক বছর গৃহে অন্তরীণ থাকার পর তিনি আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি প্রদান করেন, ফলে তাঁর অন্তরীণ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৩৭ সনে রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পেতে শুরু করেন। বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কর্মী হিসেবে ব্রিটিশ সরকার যাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন তাদের অনেকেই যখন দীর্ঘ জেলজীবন শেষে ফিরে আসছিলেন, তখন তারা একেকজন মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী বিপ্লবী কর্মী। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার মতো ১৯৩৭-৩৮ সনে কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি গঠিত হয়। কেলিশহরে কৃষক সংগঠন গড়ার কাজে এগিয়ে আসেন কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো। ১৯৩৯ সনে কেলিশহরে জমিদারদের ধান বন্ধ আন্দোলন শুরু হয়। সামন্ত পরিবারের সন্তান পূর্ণেন্দু কানুনগোর সামনে অগ্নিপরীক্ষা। সকল দ্বিধা কাটিয়ে এবার সংগ্রাম শুরু হলো তার নিজ পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে। জয় হলো আদর্শের। তিনি স্থায়ীভাবে স্ব-শ্রেণিচ্যুত হলেন। ১৯৩৯ সালেই পূর্ণেন্দু কানুনগো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। সদস্য পদ পাওয়ার মুহূর্তে তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন- “এখন থেকে সমাজ বদলের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে আমিও একজন। সমাজ বদলের সংগ্রাম আর নিজেকে বদলের সংগ্রাম পাশাপাশি কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করলাম”। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ শুরু হলে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো দুঃস্থ মানবতার সেবা, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে রিলিফ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময়ে যুদ্ধের জন্য পার্টি স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো প্রথম ব্যাচেই যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সনের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির মিলিত আহ্বান অনুযায়ী কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোর নেতৃত্বে কেলিশহরে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। কৃষকরা জমি থেকে ধান কেটে নিয়ে নিজের ঘরে তুলত। শত শত লাঠিধারী ভলান্টিয়ার বাহিনীর নেতা ছিলেন অসীম সাহসের অধিকারী পূর্ণেন্দু কানুনগো। ১৯৪৯ সনে পূর্ণেন্দু কানুনগোকে সুধাংশু কাঞ্জিলাল সহ গ্রেপ্তার করা হয়। কাঞ্জিলাল ছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর বডিগার্ড। তাঁরও বাড়ী ছিল কেলিশহরে। বার্মা থেকে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। দুজনেই জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু মুক্তি লাভের সাথে সাথে পুনরায় তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়। পলাতক অবস্থায় ধলঘাটের বিনয় হরিদত্তের বাড়ি থেকে এক সন্ধ্যায় পূর্ণেন্দু কানুনগোকে গ্রেপ্তার করে ৩/৪ জন পুলিশ ধলঘাট পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে আসার সময়ে তিনি পুলিশদের ওপর আক্রমণ করে দৌড়ে পালিয়ে এক পর্যায়ে একটি মজা পুকুরে আত্মগোপন করেন। সারারাত পুকুরে ডুবে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভোরে পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন। অমানুষিক নির্যাতনের পর তাঁর রক্তাক্ত দেহ পুলিশ টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। ১৯৫৬ সন পর্যন্ত একটানা তিনি জেলে ছিলেন। ‘৫৪ সনে অনেক বন্দী মুক্তি পেলেও পূর্ণেন্দু কানুনগো চট্টগ্রাম, ঢাকা, যশোহর প্রভৃতি জেলে বন্দি জীবন কাটান। জেলে থাকা অবস্থাতেই তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয়। জনতার চাপেই তিনি ১৯৫৭ ইংরেজিতে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে বোর্ডের দীর্ঘকালীন সময়ের প্রেসিডেন্ট বাবু গোবিন্দ ভট্টাচার্যের মতো পরাক্রমশালী প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি যখন যাকে মনোনীত করেছেন তিনি কেলিশহর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৬৫ সালে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পলাতক জীবনে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো সেলিম ভাই নামেই পরিচিত ছিল। ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে তিনি নিরলসভাবে পরিশ্রম করেন। ১৯৭০ সালে জে এম সেন হলে সভা করে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্য কাজকর্ম শুরু করে এবং অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদকের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। ‘৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে চলে যান। এ সময়ে তিনি পটিয়া, বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের যুবকদের সংগঠিত করে ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যে দলে দলে ভারতে পাঠাতেন। যুবকদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর পরিচয়পত্র গ্রহণ করতেন এবং সীমান্ত পর্যন্ত নিরাপত্তার ব্যাপারে সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করতেন। মে মাসে তিনি সুখেন্দু শুক্লদাস নামে একজন মাত্র সঙ্গী নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাউজান উপজেলার লাম্বুর হাটের কাছে দরগাহ ঘাটে পোঁছালে চাটা জড়ানো দুটি বন্দুক সহ পাকিস্তানী দালালদের হাতে ধরা পড়েন। দুজনকেই নেওয়া হয় সেনা বাহিনীর ক্যাম্পে। কিন্তু বিরল সাহস ও তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জোরে বন্দুকের দায়ভার দালালদের ওপর চাপিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির ৩য় কংগ্রেসে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে পার্টির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি গঠিত হলে তিনি সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে যান এবং দক্ষিণ জেলাকে গড়ে তোলার জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় বিচরণ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি দীর্ঘদিন থেকে সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা, গ্রামীণ জীবন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯৮৭ সালে পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। জনতার চাপে ১৯৮৮ সনে তিনি দ্বিতীয়বারের মত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বগ্রহণ করতে বাধ্য হন। কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো ছিলেন একাধারে আন্দোলনকারী ও সংগঠক। আজকের প্রজন্মের বহুনেতা ও কর্মী তাঁর হাতের সৃষ্টি। তিনি নিজেকে কখনো অতি পবিত্র, অপরিবর্তনীয় বা অভ্রান্ত মনে করতেন না। সিদ্ধান্ত প্রদানের পূর্বে বারে বারে কর্মীদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। নেতৃত্বের এসব গুণাবলিতে কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো ছিলেন এক বিরল দৃষ্টান্ত। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের আপাতঃ বিপর্যয়ে তিনি কখনো হতাশ বা বিভ্রান্ত হননি। সংগ্রামের প্রতীক চিরঞ্জীব কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো লাল সালাম। লেখক : সদস্য, সিপিবি, কেন্দ্রীয় কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..