পহেলগামের ফাঁদে পা দেবেন না!

প্রেমশঙ্কর ঝা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একটা বিষয় স্পষ্ট, পহেলগামের ঘটনা কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষ বা সেখানকার বিক্ষুব্ধ কোনো সংগঠনের কাজ নয়। কারণটা সহজ, কাশ্মীরীদের জন্যে এটা নিজেদের গলায় ছুরি বসানোর শামিল। এই আক্রমণ আসলে পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সবচেয়ে কট্টর অংশের চরম হতাশার বহিঃপ্রকাশ। চার দশক ধরে শত চেষ্টা করেও তারা কাশ্মীরীদের পাকিস্তানমুখী করতে না পারার ব্যর্থতাই এর কারণ। এই কট্টরপন্থীরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে ভারতবিরোধী মনোভাব উস্কে দিয়েই। ২০১৯ সালে মোদী সরকার যখন ৩৭০ ধারা বাতিল ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিবর্তিত করে শাসনের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি দিল্লিতে নিয়ে গেল তখন থেকেই তারা ভীষণ আশান্বিত হয়ে আছে। এর পরবর্তী সময়ে জম্মু ও কাশ্মীরে যে আপেক্ষিক শান্তি বিরাজ করছে সেটা মূলত বন্দুকের শান্তি। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝেছিল যে দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু গত অক্টোবরের নির্বাচনে বিপুল হারে ভোটদান এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাশ্মীর উপত্যকায় নির্বাচনী সমর্থন বিপুল পরিমাণে ন্যাশনাল কনফারেন্সের স্বপক্ষে গিয়ে বিজেপির প্রথমবারের মত সরকার গড়ার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে এদের প্রত্যাশা ও পরিকল্পনাতেও জল ঢেলে দিয়েছে। ফলে পাকিস্তানের হতাশা ও ক্রোধও প্রত্যাশিতই ছিল। ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর অবধি একটি বাদে সব হামলার ঘটনা ঘটেছে জম্মু এলাকায়। নির্বাচনী ফলাফল বেরোনোর পর ৯ অক্টোবর থেকে ২৫ দিন সময়সীমার মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকায় ৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার একদিন পর প্রথম আক্রমনের ঘটনা ঘটে ৯ অক্টোবর অনন্তনাগে। শেষ ঘটনাটি ঘটে ৩ নভেম্বর শ্রীনগরে। একটি ঘটনা ছাড়া সবক’টি ছিল সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ। শিকার হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিষেবা প্রদান রত চিকিৎসকরা। ২২ এপ্রিলের পহেলগামের জঘন্যতম হামলাটি এর আগেকার সব ঘটনাকে ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের দিক থেকে হতাশার বহিঃপ্রকাশের দিকটি এখানেও অপরিবর্তিত। ৫ বছর ব্যাপী চরম দমনপীড়ন এবং মোদী সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরও উপত্যকায় ভারতে থেকে যাওয়ার বাসনা এবং সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ভাঁটা পড়েনি। ৩৫ বছরের বিরতিহীন হিংসার ফলে তৈরি হওয়া দুর্দশা সত্ত্বেও কাশ্মীরীরা ভারতের অভ্যন্তরে থেকেই কাশ্মীর সমস্যার সুরাহা চায়। কারণ তারা বিশ্বাস করে এই পথে শুধু যে তাদের কাশ্মীরীয়ত রক্ষিত হবে তাই নয়, এই পথেই ভারতের বিশাল বাজারের পথ তাদের সামনে উন্মুক্ত হবে। এই পথকেই কাশ্মীর তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যপূরণের পথ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। এ কথা স্মর্তব্য যে কাশ্মীরের মানুষ ভারতের সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত জনসংখ্যার অন্যতম। কাশ্মীরীরা যা চায় ছ’বছর আগে অক্সফোর্ড বক্তৃতায় বিজেপি-র বৈজয়ন্ত পাণ্ডার বিপক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি কাশ্মীর ও ভারতের মানবোন্নয়ন সূচকগুলি তুলে ধরেছিলেন। প্রতিটি সূচকে কাশ্মীর ছিল জাতীয় গড়ের চেয়ে ১০% বা তার চেয়ে বেশি ওপরে। এর কারণ এটা নয় যে কাশ্মীরের শাসন ব্যবস্থা ভারতের অন্য অংশের চেয়ে উন্নততর (শেখ আবদুল্লাহ কারান্তরালে থাকার সময়ে বক্সি গুলাম মহম্মদের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়টায় এটা হয়ত সত্যই ছিল)। এর কারণ, সারা পৃথিবী থেকে বিপুল সংখ্যায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কাশ্মীরের সক্ষমতার বিষয়টি। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কাশ্মীর হচ্ছে সেই অঞ্চল যেখানে প্রতিটি পরিবার সুশিক্ষিত হওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে থাকে। ভারতে রপ্তানিকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির একমাত্র দৃষ্টান্ত হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীর। পৃথিবীতে যদি এমন কোনো অঞ্চল সত্যিই থাকে যেখানে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ককে উচ্চতম মূল্য দেওয়া হয় তবে তার নাম কাশ্মীর। এটাই ইসলাম, হিন্দু এবং শিখ ধর্মের সমন্বয়বাদী শতাব্দি প্রাচীন পরম্পরার অর্থনৈতিক ভিত্তি। এটাই জম্মু ও কাশ্মীরের স্বকীয়তার স্বাক্ষর। এই কারণেই ২০১৪ সালে আধুনিককালের সবচেয়ে সর্বনাশা হড়পা বানের সময়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও পর্যটকদের বাঁচাতে শত শত কাশ্মীরী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। এই একটি কারণেই ৩৫ বছরের বিরামবিহীন জঙ্গিবাদজনিত অস্থিরতার মধ্যেও একবারই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর পর্যটকদের ওপর, সুনির্দিষ্টভাবে অমরনাথ যাত্রীদের ওপর হামলা চালাতে পেরেছিল লস্কর-এ-তৈবার জঙ্গিরা। সেটাও ঘটেছিল পহেলগামেই এবং সেবার কাশ্মীরীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঘটনাকে তারা মনে করেছিল, এক সপ্তাহ আগে আবদুল মজিদ দারের নেতৃত্বাধীন হিজবুল মুজাহিদিনের গোষ্ঠীর ঘোষিত যুদ্ধবিরতিকে ব্যর্থ করার একটি অপচেষ্টা। দার প্রত্যাশিতভাবেই কিছুদিন পর আইএসআই প্রেরিত ঘাতকদের গুলিতে নিহত হয়। ২০০২ ও ২০০৯ সালে ‘মোরি’ (বর্তমান নাম আইপিএসওএস) সংঘটিত জনমত সমীক্ষায় দেখা যায়, কাশ্মীর উপত্যকার ৯০ শতাংশেরও অধিক মানুষ চায় শান্তি পুনরুদ্ধার ও গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন। ৬ শতাংশেরও কম মানুষ চেয়েছে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে। ফলে এটা একেবারেই বিস্ময়কর নয় যে কাশ্মীরীরা সর্বাত্মকভাবে চায় জঙ্গিবাদের অবসান এবং তাদের সমস্ত আকুলতা নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের কামনায়। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও গত অক্টোবরের নির্বাচনে বিপুল হারে ভোটদান তাদের এই দুর্মর বাসনাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। কাশ্মীরের সমন্বয়বাদী ধারার টিঁকে থাকার মূল কারণ সেখানকার সুফি-রেশি ধারার ইসলাম এবং ব্রিটিশ শাসনকালীন অবশিষ্ট ভারতের ভূখণ্ড থেকে কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। এটাই দেশভাগ সময়পর্বের কুৎসিৎ সাম্প্রদায়িক হিংসা থেকে মুক্ত রেখেছিল সেই অঞ্চলকে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও বিগত ৩৫ বছরে এই সমন্বয়বাদের প্রচুর ক্ষয় ঘটেছে, বিশেষ করে ১৯৯০ সালে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিতাড়নের পর। কিন্তু উপত্যকায় থেকে যাওয়া মানুষদের মধ্যে এই পরম্পরা এখনও শক্তিশালী রয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো অবশিষ্ট ভারতের সাথে কাশ্মীরের অর্থনীতির নাড়ির বাঁধনটি। পর্যটন থেকে যে রাজস্ব আদায় হয় সেটাই কাশ্মীরের প্রাণভোমরা। ২০২৩ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে ২৩ মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করেছে। এর মধ্যে ৪,৪৬,০০০ পর্যটক ছিল জুলাই থেকে আগস্ট সময়পর্বের অমরনাথ যাত্রী। এই তীর্থযাত্রা আরম্ভ হয় পহেলগাম থেকে। ফলে কেন এই স্থানটিকেই লস্কর-এ-তৈবা বা আইএসআই পুষ্ট জঙ্গিরা তাদের দ্বিতীয়বার নির্বিচার হত্যার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ারই কথা নয়। এই ঘটনা থেকে মোদী সরকার বা দল হিসেবে বিজেপি সারাদেশে মুসলিম বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে দিয়ে রাজনৈতিক মুনাফা তোলার চেষ্টা করবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পুলওয়ামার পূর্বদৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েইছে। এটা এখন ঘটবেই কারণ ২০২৪ সালের নির্বাচনেই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ টের পেয়ে গেছেন যে তাদের সমর্থনের ভিত ভাঙতে শুরু করেছে। এটা মূর্খতার পরাকাষ্ঠা হবে কারণ আইএসআই, লস্কর-সহ পাকিস্তানভিত্তিক কট্টরপন্থিরা চায় মোদী এই পথটিই নিক। সময় চয়ন পহেলগামে হামলার এই সময় চয়নটি আকস্মিক নয়। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি ভান্সের ভারত সফরের সময়টিকে তারা ভেবেই ঠিক করেছে। ২৫ বছর আগে ২০০০ সালের ২৫ মার্চ কাশ্মীরে সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হামলার ঘটনাটিও ঘটেছিল এভাবেই ঠিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসে পৌঁছনোর দিনের সাথে মিলিয়ে। ভারতীয় সেনার পোশাক পরে জঙ্গিরা ৩৬ জন কাশ্মীরী শিখ তরুণ ও বয়স্ক মানুষকে হত্যা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বের সামনে এটা দেখানো যে ‘ভুয়ো ফ্ল্যাগ’ অপারেশনের নামে ভারতীয় সেনারা দেশের মানুষকে কীভাবে হত্যা করে। তবে যে শিখরা বেঁচে গিয়েছিলেন তারা পরে বলেছেন ঘটনার আগে হামলাবাজরা যখন গ্রাম পরিদর্শনের ছলে এসেছিল তখনই তাদের পোশাক দেখে তাদের সন্দেহ জেগেছিল। বিশেষ করে পায়ের জুতো দেখে বুঝেছিলেন যে এরা ভারতীয় সৈন্য নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা পরে এই হত্যায় অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানের শিয়ালকোটের মহম্মদ সুহেইল মালিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যাকে ভারতীয় সেনারা আটক করেছিল। মালিক স্বীকার করে যে লস্করের নির্দেশেই তারা সেই হত্যালীলায় অংশ নিয়েছিল। পুলওয়ামার মতই পহেলগামেও আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই- যেনতেনপ্রকারেণ সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো। আক্রমণকারীরা চেয়েছে কাশ্মীরে অক্টোবরের নির্বাচনের পর যে একটু ঢিলেঢালা মনোভাব এসেছে তার পরিবর্তন করে মোদী সরকার যাতে আবার কঠোর দমনপীড়ন ফিরিয়ে আনে। এর প্রতিক্রিয়ায় কাশ্মীরের মানুষ যদি নিজেদের চেপে রাখা ক্ষোভের উগ্র বিস্ফোরণ ঘটায় তবেই শেষ পর্যন্ত কাশ্মীর এমনিতেই পাকিস্তানের কোলে ঢলে পড়বে। মোদী সরকার যদি এই ফাঁদে পা দেয় তবে সেটা কাশ্মীরে যুদ্ধ পরিস্থিতি ডেকে আনবে এবং তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে মুসলিম বিরোধী হিংসার জন্ম দেবে। সূত্র : দ্য ওয়্যার ভাষান্তর : শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..