পেঁয়াজচাষীদের আত্মহত্যা শহুরে মধ্যবিত্তের স্বস্তি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা
গত কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজ ও আলুর দাম কম পেয়ে ঢাকার মধ্যবিত্তরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। বাজারের মসলা বা সবজি একটু সস্তা পাওয়া মানেই যেন তাদের উল্লাস, সামাজিক মাধ্যমে হাহা হিহি, মিম, স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসবের গহীন অন্তরালে, দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে এক বা একাধিক কৃষক আত্মহত্যা করছেন-কারণ তারা যে পেঁয়াজ ফলিয়েছেন, তার খরচটুকুও তুলতে পারছেন না।
বিপুল লোকসানে কীভাবে চলবে পরিবার? পরের বার না হয় আর চাষবাস করলেনই না!
সম্প্রতি রাজশাহীর বাঘায় চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন মীর রুহুল আমিন (৬০) নামের এক পেঁয়াজচাষি। তিনি স্থানীয় তিনটি এনজিও থেকে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ৬৪ হাজার ও ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন এবং প্রতি সপ্তাহে তাকে ৪ হাজার ৪৫০ টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। এখনো তার ৯৯ হাজার ২৯০ টাকা ঋণ অবশিষ্ট ছিল। পারিবারিকভাবে জানা গেছে, তিনি এই ঋণ নিয়েই পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু আশানুরূপ ফলন হয়নি এবং তিনি লোকসানের আশঙ্কায় গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
সপ্তাহ দুয়েক আগে মেহেরপুরের মুজিবনগরে সাইফুল শেখ (৫৫) নামের এক পেঁয়াজচাষি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। পরিবার বলছে, পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েন তিনি। সেই হতাশা থেকেই নিজের পেঁয়াজের জমিতে গিয়ে বিষপান করেন।
এই আত্মহত্যাগুলোর জন্য শুধুই মৌসুম দায়ী? ব্যক্তি দায়ী? এর গভীরে রয়েছে রাষ্ট্রের অমনোযোগ, কৃষি নীতির দুর্বলতা, কৃষিখাতে দীর্ঘমেয়াদী লুটপাট, এবং কর্পোরেট স্বার্থের প্রতি পক্ষপাত। বছরের পর বছর ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য চলেছে-যেখানে কৃষক মাঠে ফসল ফলিয়ে কোনো লাভ পান না, আর শহরের বাজারে সেই একই পণ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে যায়। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, অদক্ষ বিপণন কাঠামো এবং কৃষি খাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার রাষ্ট্রায়িত আগ্রহহীনতা।
যে কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেই কৃষিকে আমরা ক্রমাগতভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কর্পোরেট স্বার্থে কৃষিজমি অধিগ্রহণ, বহুজাতিক কোম্পানির জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজের একচেটিয়া ব্যবহার, সার ও বীজের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ানো- এসব মিলিয়ে যেন পরিকল্পিতভাবে কৃষকদের কৃষি থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটা নীলনকশা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কৃষকেরা যাতে দাম না পান, তারা যাতে ঋণে জর্জরিত হন এবং শেষ পর্যন্ত চাষাবাদ ছেড়ে দেন- এটাই যেন আধুনিক পুঁজিবাদের গোপন নীতি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পেঁয়াজ বা আলুর দাম কমে যাওয়া মানেই মধ্যবিত্তের লাভ নয়; এর পেছনে লুকিয়ে আছে একটি শ্রমনির্ভর শ্রেণির দুঃসহ ট্র্যাজেডি। এই দাম কমার পেছনে যে শোষণ, বঞ্চনা আর আত্মহত্যার ইতিহাস জড়িয়ে থাকে, তা না-জানলে বা না-মানলে আমরা অবচেতনেই এক নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে সমর্থন করছি।
এ অবস্থা চলতে পারে না। একটি অন্তর্বর্তী সরকার বা যেকোনো রাজনৈতিক শক্তি যদি ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে এসে কৃষক, কৃষি ও সাধারণ মানুষের দিকেই নজর না দেয়, তাহলে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান কোনোকালেই হবে না। কৃষি, কৃষককে রক্ষা করতে হলে দরকার ন্যায্য বাজারব্যবস্থা, শক্তিশালী কৃষি-নীতিমালা, কৃষকবান্ধব বিপণন কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এগুলো এই রাষ্ট্র এমনি এমনি করবে বলে মনে হয় না। দরকার ব্যাপক আন্দোলন, সামাজিক গণজাগরণ, নিজের অধিকার আদায় করে ছাড়বে এমন কৃষক সংগঠন। এই পরিবর্তন ছাড়া কৃষকের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না- যে অধিকারের অভাবেই আজ কৃষক আত্মহত্যা করছেন, আর আমরা হাসছি সস্তা পেঁয়াজ পেয়ে।
Login to comment..