প্রসঙ্গ গ্রাফিতি

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

গ্রাফিতি হল জনসাধারণের অভিমতে শৈল্পিয় উপায়ে দেয়ালের উপর লেখনি। বা অন্য কোন প্রকার অংকনের মাধ্যমে তুলে ধরা। গ্রাফিতি এক বচনে প্রাফিতো, যেহেতু অনেকগুলো দেয়ালে তা অলংকরণ করা হয় তাই বহু বচনে বলা হয় গ্রাফিতি। গ্রাফিতি শুধুমাত্র প্রত্নতত্বে ব্যবহার করা হত একসময়। গ্রাফিতি তৈরির উপকরণ স্প্রে পেইন্ট বা র্মাকার, এই দুইটি হল গ্রাফিতি তৈরির মুল উপকরণ। গ্রাফিতি একটি বির্তকিত বিষয় হিসাবে অনেক দেশে গণ্য করা হয়। অনেক দেশে এই গ্রাফিতি বিকৃত ও ধ্বংসাত্বক শিল্প হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কারণ অনেক সময় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তাদের সক্রিয়তা গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রচার করে। তবে কিছু গ্রাফিতি পজেটিভ শিল্প হিসাবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সমাজিক পরির্বতনে গ্রাফিতির ভুমিকা প্রশংসনীয়। জেন মিচেল বাস্কুইট একজন গ্রাফিতি শিল্পী। যার গ্রাফিতি জনসাধারণের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল প্রাচীনকালে। গ্রাফিতির প্রাচীন ইতিহাস খুজতে গিয়ে দেখা গেছে- রোম ও পম্পেই নগরীর দেয়ালের ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান, উত্তর সৌদি আরবে শিলা ও পাথরের কিছু লেখা পাওয়া গিয়েছে স্যাফাটিক ভাষায়। তাই ধারণা করা হয় স্যাফাটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকে। প্রাচীন গ্রীক নগরীতে এফেসাসেই আধুনিক গ্রাফিতির উদ্ভব। এফেসাসে গ্রাফিতি পতিতা বৃত্তির বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমান সমাজের চাইতে প্রাচীনকালে গ্রাফিতিগুলো বেশি অর্থপূর্ণ এবং বিভিন্ন ধারায় বহমান ছিল। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলোর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতো। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত সময়কার গ্রাফিতিগুলো পম্পেই নগরীতে সংরক্ষিত ছিল। নভেলিয়া ও পিমিগেনিয়া নামের দুই পরমা সুন্দরী পতিতার বিষয়টি জানা যায় গ্রাফিতি থেকে। প্রাচীনকালের গ্রাফিতিসমূহের বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, দেয়াল বা যেকোন সারফেসে র্যা -মলি আকা কোনো চিত্র। যাতে থাকবে সিম্পল কনটেন্ট, সিম্পল আকা কিন্তু পেছনের বোধটা হবে খুব গভীরে। গ্রাফিতি সাধারণত দুর্বোধ্য হবে না। গুহায় মানুষ বসবাস করার সময় গ্রাফিতি আকা হত গুহার দেয়ালে। আর গুহার দেয়ালের গ্রাফিতি অর্থ্যাৎ আদি গ্রাফিতি আকা হয়েছে পশুর হাড় দিয়ে। সেই থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন পরিবর্তন হয় গ্রাফিতির স্থান ও উপকরণের। আস্তে আস্তে মানুষের বাড়ির অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আকতে শুরু করে। গ্রাফিতি আকার মূল স্থান হলো সেই জায়গাটি, যেখানে মানুষের নজরে আসে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানদের সময়কার গ্রাফিতির প্রচলন শুরু হয়। ঐ সময়কার গ্রাফিতির নির্দশন প্রাচীন গ্রীক শহর এফিশাস বা বর্তমান তুরস্কে আছে। ঐ সময় তারা গ্রাফিতিতে প্রেম, ভালবাসা, রাজনৈতিক শ্লোগান এবং প্রসিদ্ধ উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। বাংলাদেশে গ্রাফিতির প্রচলন শুরু হয় অনেক আগে। তবে সুবোধ নামে একটি গ্রাফিতি মানুষের নজর কাড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে ছাত্ররা গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করে। এর ফলে গ্রাফিতির বিষয়টি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের নজরে চলে আসে। তাছাড়া গ্রাফিতি বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হলে সামনে “সামসুন্নাহার হল নির্যাতন” উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এক ড্রাগন গ্রাফিতি আঁেক। এই গ্রাফিতিটি সবার নজরে আসে এবং বেশ প্রশংসা কুড়ায়। সুন্দরবন

রক্ষা আন্দোলনে বিভিন্ন প্রতিবাদী গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা যায়। এই গ্রাফিতির মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন জনপ্রিয়তা পায়। মানুষের মনকে আন্দোলিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল গ্রাফিতি। গ্রাফিতি যখন সমাজ পরির্বতনের আন্দোলনের ডাক দেয় তখন তা আর শিল্পকর্মের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, একটি হয়ে উঠে একটি পরির্বতনের প্রতীক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর রাজধানীতে বহু গ্রাফিতি আঁকা হয়। এই গ্রাফিতিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসঙ্গতি তুলে ধরা এবং জনগণকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য সচেতন করা। গত ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে যার মূল দায়িত্ব পালন করে এদেশের ছাত্র-জনতা। তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়া। বাংলা জনপদে এই ধরনের বহু আন্দোলন উপনিবেশিক আমল থেকে হয়ে আসছে। তবে সব আন্দোলন সফলতা অর্জন করতে পারেনি। অনেক সময় দেখা গেছে চূড়ান্ত বিজয়টাও আবার চলে গেছে ফ্যাসিবাদীদের হাতে। এদেশের সমাজ পরির্বতনের জন্য লড়াই করে গেছেন বহু নারী। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামালসহ অসংখ্য নারী। রাজশাহী মহিলা কলেজের দেয়ালে তাদের গ্রাফিতি ছিল। কিন্তু দুঃখের কারণ এই যে গ্রাফিতিগুলো মুছে তার উপর নতুন করে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে অসংখ্য নারী রাজপথে মিছিল করেছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সফলতায় এই নারীদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। এই উপমহাদেশে মুসলিম নারী জাগরণের অন্যতম নেত্রী রোকেয়া, যার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নারী শিক্ষার প্রচলন হয়। আজকে নারী শিক্ষিত হওয়ায় এবং শিক্ষার প্রচলন হওয়ায় নারীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পেরেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ইলা মিত্র, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল, রোকেয়ার তদ্রুপ অবদান রয়েছে। কিন্তু ঐ গ্রাফিতিগুলো মুছে তার উপর নতুন করে গ্রাফিতি আকার প্রয়োজন বোধ হয় ছিল না। প্রতিটি গ্রাফিতির যে অঞ্চলে আঁকা হয় তার সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরাজমান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়েই আঁকা হয়। জনগণ যেন বুঝতে পারে এবং সচেতন হতে পারে তার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে ঐ অঞ্চলের ভাষা এবং দৃশ্যপট। রাজশাহী মহিলা কলেজের একটি গ্রাফিতি খুব সম্মত উর্দু ভাষায় লেখা হয়েছে, কারণ আরবি হরফ আর উর্দু হরফের মাঝে মিল আছে। আমি আরবি হরফ কিছুটা চিনি তবে উর্দু হরফ চিনি না। তাই বুঝা যাচ্ছে না এটি আরবি না উর্দু হরফে লিখা। এই গ্রাফিতিটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে তা ষ্পষ্টত বুঝা যায় না। তবে যারা আইএস সম্পর্কে জানেন তাদের মতে আইএসের একটি আন্দোলনের ইঙ্গিত হতে পারে। এ ধরনের গ্রাফিতি সারা দেশ জুড়েই নাকি পাওয়া যাচ্ছে। কোন আন্দোলনের সাড়া জাগাতে এই গ্রাফিতিগুলো আঁকা হচ্ছে তা অনেকেরই বোধগম্যতায় আসছে না। বিভিন্ন মহলের ভাবনা এটা কি অন্য কোন আন্দোলন হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছে না ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতিবিপ্লব এর বার্তা এই গ্রাফিতি। এই ধরনের গ্রাফিতি দেখে জনমনে নানা সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের মতে, এই গ্রাফিতিগুলো লক্ষ্য বাংলা সংস্কৃতিতে আঘাত হানার একটা নতুন কৌশল। যারা গণঅভুত্থানের কারিগর তাদের এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। গ্রাফিতি হোক প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতির ধারক বাহক। তাই সবারই লক্ষ্য রাখা উচিত এই গ্রাফিতির মাধ্যমে জনগণকে ভিন্ন সংস্কৃতির দিকে নিয়ে না যায়।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..