
এসো হে বৈশাখ এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।।/ যাক পুরাতস স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।/ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/ রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি/ আরো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।/ মায়ার কুজ্ঝটিকাজাল যাক দূরে যাক।।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানটি বাংলা নববর্ষ উৎসবের সাথে এমনভাবে বিজড়িত হয়ে পড়েছে যেন একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি চলতেই পারে না। গানটি ১৩৩৩ বাংলা (১৯২৭ইং) সনের ফাল্গুন মাসে কবি শান্তিনিকেতনে বসে লিখেছিলেন। অবশ্য বাংলা নববর্ষকে একটি সার্বজনীন উৎসবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রয়েছে এক সুবিশাল অবদান। তাঁর জন্মদিন ২৫শে বৈশাখ শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মের ছুটি। তিনি ঠিক করেন পয়লা বৈশাখেই তা সেরে ফেলার। ১৩৪৩ বাংলা (১৯৩৬ইং) সনের পয়লা বৈশাখে কবির জন্মদিন প্রথমবারের মত নববর্ষ উপলক্ষ্যে পালিত হয়। তখন থেকেই শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এর আগে ১৩০৯ বাংলার পয়লা বৈশাখ আশ্রম বিদ্যালয়ে প্রথম নববর্ষের আয়োজন করা হয়, যেখানে কবি ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তিনি বছরের আগমনীর মত বিদায়েও শুভ কামনা করেছেন তাঁর বহুল পরিচিত গান ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি’-র মাধ্যমে।
বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির উৎসব, সার্বজনীন উৎসব। শুধু বাংলায় বসবাসকারী নয়, জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নয়, এ উপলক্ষ্যে ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি সব একাকার হয়ে যায়। অনেক বছর ধরেই বিশ্বের বহু দেশের বহু শহরে/ এলাকায় পুরোপুরি বাঙালি রীতিতে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়। যে-সব দেশে বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি, সেসব দেশে জাঁকজমকও অনেক বেশি হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, আইভরি কোস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, সুইডেনসহ ইউরোপের নানা দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষের সকল আনুষ্ঠানিকতা অত্যন্ত জমকালোভাবে পালন করা হয়। এসব দেশের বহু শহরে বৈশাখি মেলার আয়োজন করা হয়, যাতে বিচিত্র ধরনের পণ্যসামগ্রী ও খাবার-দাবারের উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি কাড়ে। বাহারী আলপনা ও ফেস্টুনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয়। গান-বাজনা ও সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি ও স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এসব অনুষ্ঠানে কেউ কেউ বাঙালি সংগীতশিল্পীদের সমাবেশ ঘটিয়ে থাকেন। কোথাও কোথাও দেশীয় খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। এক কথায় পয়লা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালির একমাত্র উৎসব যেখানে সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে মিলিত হয় সবাই। সকলেই কণ্ঠ মিলান এই এক অভিন্ন গানে।
বিশ্বের অসংখ্য দেশে বাঙালিরা আজ উৎসবমুখী জাতি হিসেবে সকলের সমীহ অর্জনে প্রশংসা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাঙ্গালির উৎসবে নেচে-গেয়ে আজ অন্যরাও আনন্দ উপভোগ করছেন। অবশ্য বাংলা গানের যে শৈল্পিক গুণাবলি রয়েছে তা সংস্কৃতিমনস্ক যেকোনো ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। সংস্কৃতিপ্রিয় ও আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি স্বদেশে তো বটেই, বিশ্বের যত জায়গায় বাঙ্গালির বসবাস রয়েছে, তত জায়গায়ই বাঙালি সংস্কৃতির প্রকাশ বিদ্যমান। আর এসবের সর্বজন-পালিত আয়োজন হল নববর্ষ।
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটির রয়েছে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি। বাঙালি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে নববর্ষ উৎসবের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ১৯৬৫ সনে স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ কর্তৃক রমনার বটমূলে আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ মুখে মুখে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত গানটি স্বৈরাচারী ও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সে থেকে বাঙালির প্রাণের উৎসব এই নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের ঋষিবাক্যটিই যেন এখানে সত্যিকার রূপ নিল: “মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়, সে এখন শান্তির নববর্ষ নয়- পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের পর আবরণ ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিটি নববর্ষ সেই অভ্যুদয়ের আহ্বান নিয়ে আসে আমাদের কাছে। এই অভ্যুদয় হচ্ছে মনুষ্যত্ব লাভের দুঃসাধ্য সাধনা।” বাঙালির জাতীয় জীবনে গান বা সঙ্গীতের প্রভাব এখানেই স্তিমিত হয়ে পড়েনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্গীত এক যাদুকরী ভূমিকা পালন করেছিল বলে সুধীজনরা মন্তব্য করে থাকেন।
আমার সোনার বাংলা, ও আমার দেশের মাটি, কারার ঐ লৌহকপাট, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো প্রভৃতি গান বাঙালির অগ্নিমননে ঘিয়ের জোগান দিয়েছিল। অপ্রস্তুত, নিরস্ত্র ও অপ্রশিক্ষিত বাঙালি দামাল বীরদের অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল এসব গান।
১৯৫২ সনের মহান ভাষা আন্দোলনের সাথেও জড়িয়ে রয়েছে সঙ্গীত। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি- এর সুর শুনলেই ভাষা আন্দোলনের ধ্বনি বাঙালির ধমনীতে নাড়া দেয়। আরোও কিছু সঙ্গীত আমাদের বিভিন্ন উৎসবের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। যেমন, বসন্ত উৎসবে ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল; শারদীয়ায় দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী; ঈদুল ফিতরে রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ প্রভৃতি।
তাই দেখা যায় যে, মানুষের জীবনের এক বিশেষ অনুষঙ্গ হল সঙ্গীত। শুধু আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, সঙ্গীত মানুষের আত্মার সাথে বিজড়িত এমন এক সৃষ্টি, যার ভেতরে মানুষ খুঁজে পায় তার ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠীজীবন এমনকি জাতীয় জীবনের মূল উপাদানগুলো। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, সুখ ও দু:খ, প্রশংসা ও খেদ, উচ্ছাস ও যন্ত্রণা- সবকিছুই সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ ও অনুভব করা সম্ভব; আর, সঙ্গীত যেভাবে মানুষের মনকে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে তুলতে পারে, অন্য কোন মাধ্যমে হয়ত তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য বিশেষ বিশেষ সঙ্গীত বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা উৎসবের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
উৎসব বা অনুষ্ঠানে সঙ্গীতের উপযোগিতা প্রসঙ্গে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ আতোয়ার রহমান তাঁর ‘উৎসব’ গ্রন্থে লিখেছেন, “উৎসবের প্রেরণায় ধন্য সংগীতও- যেমন যন্ত্রের তেমনি কণ্ঠের। উৎসবের প্রয়োজনে মানুষ আদিকাল থেকে চর্চা করেছে গীতের- এবং আবিষ্কার করেছে নানাবিধ বাদ্যের যন্ত্র -যেগুলির ভেতর আছে শঙ্খ এবং বাঁশের বাঁশি থেকে শুরু করে ঢাক-ঢোল অবধি। কণ্ঠ এবং যন্ত্রের সঙ্গীত গোড়াতে অবশ্যই ছিল আজকের হিসেবে অমার্জিত, অপরিণত। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন উৎসবের মাধ্যমে সেগুলিকে ক্রমশ করে তুলতে থাকে উন্নত। নৃত্যগীতবাদ্য ছাড়া আজও যেকোনো ধর্মীয় বা লৌকিক উৎসবই নিষ্প্রাণ। আধুনিককালে পশ্চিমের প্রতিষ্ঠান-আয়োজিত সঙ্গীত উৎসবগুলির ভূমিকা হয়েছে সর্বজননন্দিত। ব্রিটেনে আর আমেরিকায়- এবং ইউরোপেরও একাধিক দেশে এ জাতীয় উৎসব এখন সাংস্কৃতিক বিকাশের এক প্রধান ধারা, সাংস্কৃতিক জীবনের বর্ণিল আভায় পরিণত।”
নববর্ষ উৎসবটি মূলত পঞ্জিকাকেন্দ্রীক। বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথমদিন নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়। অবশ্য বাংলা পঞ্জিকার উৎপত্তির রয়েছে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমি। সংক্ষেপে বলতে গেলে মহারাজা বিক্রমাদিত্য (রাজত্বকাল ১০৫-১৫ খ্রী:পু:) সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন, যার নাম ছিল ’বিক্রম সাম্বাত’। এটি ছিল মূলত তিথি, নক্ষত্র, ঋতু প্রভৃতি সময় নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত একটি দিকনির্দেশনার সমাহার বিশেষ। রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল ৫৯০- ৬২৬ খ্রী:) ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে একে দেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ; অর্থাৎ এই সময় হতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে বাংলা পঞ্জিকা বা সনকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করার কৃতিত্ব মুগল সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫)-এর। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় সকল কাজে হিজরি সন অনুসরণ করা হত। হিজরি সন হল চন্দ্রভিত্তিক, আর ভারতীয় পঞ্জিকা হল সৌরভিত্তিক। হিসাবের এহেন ব্যবধান থেকে শুরু হয় নানা ধরনের অসামঞ্জস্য; বিশেষত খাজনা আদায় ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। পঞ্জিকার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংস্করণ তৈরির জন্য আকবর দায়িত্ব দেন তার অন্যতম মন্ত্রী টোডরমল্ল ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। এই দু’জন বিশেষজ্ঞের অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানের ফলে বাংলা ও হিজরি সনের সমন্বয়ে খ্রিস্টিয় ১৫৮৪ইং সনে একটি নতুন পঞ্জিকার প্রবর্তিত হয়। সে থেকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পয়লা বৈশাখ সর্বমহলে গৃহীত ও পালিত হয়ে আসছে।
বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বৈষয়িক সুখ-শান্তি কামনায় ঘরোয়াভাবে নানা আয়োজনে নববর্ষ পালন করে আসছে সুদূর অতীত থেকে। এ উপলক্ষ্যে মেলা ও নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। মেলা থেকে মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে রাখত। উল্লেখ্য, এসব মেলার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন, গৃহস্থালি পণ্য, আসবাবপত্র, বাসনকোসন প্রভৃতি। বর্তমানেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলা চলমান রয়েছে। কোথাও কোথাও মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সঙ্গীত বা গান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়। আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’-কেও সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ও হয়েছে। কিন্তু ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটির কোন সমালোচনা অদ্যাবধি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অর্থাৎ, এ গানটি সকল বাঙালির অন্তরে এক সুদৃঢ় আসন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজনকেও গানটির কলি আওড়াতে শোনা যায়। এভাবেই আমাদের বাংলার অতি প্রিয় উৎসব পয়লা বৈশাখ বিশ্ববিজয়ে সফলতা অর্জন করেছে। আর, সাথে সাথে আলোচ্য এই গানটি সকল বাঙালির অন্তরে বিশ্বসঙ্গীত হিসেবে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলার ঐতিহ্যের যাত্রা সারা বিশ্বে আরোও সুন্দর হোক, সুসংহত হোক। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা ছড়িয়ে যাক।