
আসবে পথে আঁধার নেমে, তাই ব’লেই কি রইবি থেমে-
ও তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি, হয়তো বাতি জ্বলবে না
ড. গোলাম মহিউদ্দিন (৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮-১৮ এপ্রিল ২০০৪) মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল, দৃঢ়চিত্ত এবং অত্যন্ত বিনয়ী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। চিন্তায়, কর্মে ও মননে বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারতেন না। কুমিল্লার গোমতী পাড়ের শান্ত গ্রাম শ্রীপুরে জন্ম ও শৈশব কাটানোর পর কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এস.এস.সি, ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি, এরপর বুয়েট থেকে প্রকৌশল বিদ্যায় যথাক্রমে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন ড. গোলাম মহিউদ্দিন। স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৭৮ সালে সিভিল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। কিন্তু মহৎ পেশা শিক্ষকতার টান ছিল তার অন্তরে, তাই ১৯৮৭ সালে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন; মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই বিভাগেরই চেয়ারম্যান ছিলেন। সংগঠন বিষয়ে ড. গোলাম মহিউদ্দিনের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন, এরপর একে একে বিসিএস (খাদ্য প্রকৌশল) এর সাধারণ সম্পাদক, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স-বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক, National Oceanographic and Maritime Institute (NOAMI) এর সদস্য সচিব, ওল্ড ভিক্টোরিয়ানসের এর সাধারণ সম্পাদক, আখতার হামিদ খান ফাউন্ডেশনের ভাইস-চেয়ারম্যান, বুয়েট-’৭০ এর প্রেসিডেন্ট, ওঊই ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান, আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের সদস্য, শিশু বিকাশ ছায়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির তিনি সদস্য সচিব, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর নগর কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছাড়াও ড. গোলাম মহিউদ্দিন শিক্ষাবার্তা এবং বাংলাদেশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। WB, FAO, CIDA-এর কনসালটেন্ট হিসাবেও তিনি কাজ করেছিলেন। এছাড়া দেশের বাইরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন তিনি। এই বর্ণাঢ্য ও বহুমুখী দ্বায়িত্ব পালন ও অংশগ্রহণ তাঁর কর্মের ব্যাপ্তি বুঝতে আমাদের সাহায্য এবং অনুপ্রাণিত করবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশারফ হোসেন এর ভাষ্যে- “IEB-তে তাঁর অবদান অনেক। IEB-তে Annual Paper Meet চালু করা, আয়োজন করা, IEB-র সাংগঠনিক কাজ ইত্যাদি আমার নজরে এসেছে। কী করে সামাল দিত আমি বুঝে উঠতে পারতাম না। IEB মনে হয় তাঁর Second Home ছিল। প্রথম Home বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের বাসা তো Home ছিল না।”
অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন ১৯৭০ সালেই বুয়েটে পরীক্ষা শেষ করে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারার পদে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ছাত্র হলে পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বিবস্ত্র অবস্থায় ছাত্রদের দৌড়াতে দেখে তিনি রাজশাহী থেকে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় নিজ গ্রামে পৌঁছেছিলেন। যদিও ততদিনে তাঁর নিজ বাড়ি পাক হানাদারদের দোসরদের দ্বারা আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়েছিল। তারপর একসময় ঢাকায় এসে শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে উঠেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রকৌশলী হয়েও তিনি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর চিন্তাভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন বিভিন্ন সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপনে, আলোচনায় এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে। ১৯৯৪ সালে গ্যাট-আঙ্কেল চুক্তির প্রাক্কালে তিনি ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ-এর মেকানিক্যাল বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সর্বপ্রথম এই চুক্তির অশুভ দিক তুলে ধরেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে অশুভশক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়েছে তখন তিনি বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদ (জ্বালানি) আহরণ, বিদেশি বিনিয়োগ, জাতীয় স্বার্থবিষয়ক সেমিনারে বিদেশিদের জন্য তেল-গ্যাসের অংশীদারি চুক্তি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন। অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা, শিল্পায়ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় দেড় দশক ধরে লিখেছেন। তাঁর প্রায় ১৩২টি প্রবন্ধ ও প্রকাশনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল, কনফারেন্স ও সেমিনারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশে অর্থনীতিতে দেশি বিদেশি থাবা’ গ্রন্থটি ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়ে অনেক সত্য বক্তব্য জনগণের সামনে হাজির করেছে। তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে Role of Engineers in Proverty Alleviation, Improving availability of power in South Asia-Search for optimal technological option উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশি বিদেশি থাবা এবং গ্যাস রপ্তানি প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট ও বিশ্বায়ন নামক পুস্তিকা সারা দেশব্যাপী জনগণের সচেতনতা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে।
আমার বিবেচনায় তাঁর দু’টি নির্দিষ্ট ভূমিকা দেশবাসী আজীবন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে; একটি হলো বিএনপি সরকারের আমলে চটগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত রুখে দেয়া, আর আরেকটি হলো প্রায় একই সময়ে সরকারের গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত রুখে দেওয়া। দুটি আন্দোলনই হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে।
৯০-এর দশকের মাঝামাঝি আমি যখন কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই তার কিছুদিন পর অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন-এর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁর গ্রামের বাড়ি, বুয়েট ক্যাম্পাসের কোয়ার্টার, আজিজ সুপার মার্কেটের শিক্ষাবার্তার কার্যালয়, উদীচী অফিস, কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে তাঁকে দেখেছি এবং কোন কোন দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর সাথে তাঁর গাড়িতেও চড়েছি, গন্তব্য পার্টি অফিস কিংবা উদীচী অফিস; গাড়িতে চাপা কলা রাখতে দেখেছি আর খেয়েছিও। আমার সেই সদ্য যুবা বয়সে “রাশেদা-মহিউদ্দিন” জুটি ছিল স্বপ্নের মতো। উল্লেখ্য রাশেদা আপা (অধ্যাপক এ এন রাশেদা) মহিউদ্দিন ভাইয়ের সহধর্মিনী, শিক্ষা বার্তার সম্পাদক, ’৬৯ এ ইডেন কলেজের ভিপি, শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার। ভাবতাম একদিন আমিও এমন হবো! কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি একজন অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন হয়ে উঠা কতটা সাধনার। কুমিল্লায় তাঁর সর্বশেষ সাংগঠনিক সফর ছিল ২০০১ সালে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কুমিল্লা জেলা সম্মেলনের অতিথি হিসাবে। আমি সেই সম্মেলনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সেই সম্মেলন সফল করতে তাঁর খুঁটিনাটি নির্দেশনা আমাকে মনে করিয়ে দেয় ছোটখাট যেসব বিষয় আমরা আপাতদৃষ্টিতে এড়িয়ে যাই সেগুলোও তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে ঠিকই ধরা পরতো এবং স্নেহভরা কণ্ঠে শুধরে দিতেন। আরেকটা আশ্চর্য বিষয় দৃঢ়চিত্ত এই মানুষটিকে কখনো রাগতে দেখিনি, কখনো জ্ঞানের বা পদের গরিমা দেখিনি তাঁর কর্মে-চিন্তায়-আচরণে। কথা বলতেন ধীরে এবং হাস্যোজ্জ্বল মুখে। ২০০৪ সালের ১৮ এপ্রিল ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কর্মযোগী অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন।
তাঁর স্মৃতিতে ক-১/সি , দক্ষিণ বাড্ডা, ঢাকা এই ঠিকানায় ২০১১ সালে রবি শঙ্কর সেন নিশানসহ ছাত্র ইউনিয়নের অপরাপর কিছু সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীর উদ্যোগে এবং রাশেদা আপার দিকনির্দেশনায় গড়ে উঠেছে ‘অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি গ্রন্থাগার”। শিক্ষার্থীদের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নততর করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এই পাঠাগার ২০১৪ সালে স্বল্প পরিসরে আয়োজন করেছিল অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি উপস্থিত বক্তৃতা ও নির্ধারিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা। আমিও তার পরপরই সাধ্য অনুযায়ী যুক্ত হই এই মহৎ উদ্যোগের সাথে। এখন বাড্ডা-রামপুরা অঞ্চলে কলেবর ও ব্যাপ্তিতে বড় হয়ে এটি “ড. গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা” নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিবাবক-শুভানুধ্যায়ীদের অংশগ্রহণে ও উৎসাহে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন যেই স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য আজীবন কাজ করেছেন তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হোক আমাদের সমন্বিত উদ্যোগে।
লেখক : সহ-সভাপতি, ড. গোলাম মহিউদ্দিন স্মৃতি গ্রন্থাগার