
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম বুরকিনা ফাসো। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম প্রধান এই দেশটি একদা ফরাসি উপনিবেশ ছিল। সম্প্রতি দেশটি আলোচনায় এসেছে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওরের কিছু কাজ ও সিদ্ধান্তের কারণে।
প্রেসিডেন্ট ত্রাউরে সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। তাঁর বয়স মাত্র ৩৭, ক্ষমতাগ্রহণের সময় বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট এবং দ্বিতীয় কনিষ্ঠ সরকারপ্রধান। কিছুদিন আগে সৌদি আরব সেদেশে ২০০ মসজিদ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ত্রাউরে সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, তাঁর দেশে যথেষ্ট পরিমাণ মসজিদ রয়েছে। তাঁর দেশের প্রয়োজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি। প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনিয়োগ, যাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। তিনি সৌদি আরবকে এসব অগ্রাধিকার খাতে সহায়তা ও বিনিয়োগের অনুরোধ জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েও তিনি যাননি। পরের মাথায় পালক পরাতে গিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনাশ করা তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। হোক সে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপতি।
তিনি ক্ষমতায় এসে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ৫০% বাড়িয়েছেন কিন্তু এমপি, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বেতন কমিয়েছেন ৩০%। নিজে প্রেসিডেন্টের বেতনভাতা না নিয়ে সেনাবাহিনীতে যে বেতন পেতেন সেটাই নিচ্ছেন। তিনি দেশের কারা আইনে ব্যাপক সংশোধন এনেছেন। কারাবন্দিদের কারাবাসের মেয়াদ কমানোর বিনিময়ে কৃষিখাতে শ্রম দেওয়ার নীতি চালু করেছেন। এক মাস কাজের বিনিময়ে তিন মাসের কারাবাস মওকুফের এই সিদ্ধান্ত কৃষিখাতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তিনি দেশের স্বর্ণ ও ম্যাঙ্গানিজসহ খনিজ সম্পদের ওপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দিতে সফল হয়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএআইডি-এর ফান্ডিং বাতিল করলে প্রেসিডেন্ট ত্রাওরে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, আমরা মার্কিন সাহায্যের জন্য লালায়িত নই। বিদেশি সাহায্য জাতিকে পরনির্ভর করে। মেরুদণ্ড দুর্বল করে। গত তেষট্টি বছর ফ্রান্স আমাদের সাহায্য দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি।
আশির দশকে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ‘আপার ভোল্টা’য় থমাস সানকারা নামের এক সামরিক নেতার উত্থান ঘটে। জনপ্রিয় সেনাকর্তা হিসেবে সেসময় বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। একপর্যায়ে তৎকালীন সামরিক কাউন্সিলের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু মতবিরোধের জেরে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে গ্রেপ্তার করেন ক্ষমতাসীন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ-ব্যাপ্তিস্তে ওউদ্রাগো। ১৯৮৩ সালের আগস্টে সেনাবাহিনীর আরেক অংশ পাল্টা ক্যু ঘটিয়ে তাকে মুক্ত করে। পরে তিনি বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। এই সানকারাই পরে আপার ভোল্টার নাম বদলে রাখেন ‘বুরকিনা ফাসো’। মার্কসবাদী ভাবাদর্শের প্রতি অনুরক্ত এই উর্দিধারী নেতা পরে পাল্টা এক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান।
আজকের দিনে বুরকিনা ফাসোয় আরেক সানকারার উত্থান হয়েছে, অন্তত দেশটির বহু মানুষ তাই-ই মনে করে। যার নাম ইব্রাহিম ত্রাউরে। উর্দিধারী পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল হেনরি দামিবাকে হটিয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্ষমতা দখল করেন ত্রাউরে। সাত বছরের অধস্তন পদমর্যাদার কর্মকর্তার হাতে ক্ষমতা হারান দামিবা। ঘটনাচক্রে ত্রাউরে এখন বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট।
চলতি শতকে আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া সামরিক অভ্যুত্থানগুলোর নেতাদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে, বুরকিনা ফাসোর ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের নব্য উপনিবেশবাদী তৎপরতা তিনি যেভাবে এবং যতটা বলিষ্ঠতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করছেন, নিকট অতীতে গোটা আফ্রিকায় তা নজিরবিহীন।
ত্রাউরের কণ্ঠে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার যে অনুরণন তা ছুঁয়ে গেছে পশ্চিম আফ্রিকাসহ মহাদেশটির নানা প্রান্তে। সানকারার মতো ত্রাউরে যেসব প্রগতিশীল কর্মসূচি শুরু করেছেন এবং পশ্চিমাবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাতে আফ্রিকার ধ্রুপদি বামপন্থি শক্তিগুলোরও প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। ত্রাউরেকে সানকারার মতো মার্কসবাদ-প্রভাবিত নেতা মনে করছেন তারা। এই যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বামপন্থি শক্তি ইকোনমিক ফ্রিডম ফাইটার্সের (ইএফএফ) নেতা জুলিয়াস মালেমা, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) শাসনব্যবস্থার মধ্যে উদ্ভূত কর্তৃত্ববাদ ও দুর্নীতিপরায়ণতার বিরুদ্ধে যিনি এখন বেশ সরব; তিনি পর্যন্ত ত্রাউরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মালি ও নাইজারের সেনাশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমাপন্থি জোট ‘ইকোওয়াস’ থেকে বের হয়ে আসার অন্যতম কারিগর তিনিই। তিনি মনে করেন, পশ্চিম আফ্রিকার অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলে তৈরি হওয়া ইকোওয়াস কার্যত আফ্রিকার স্বার্থকে বিকিয়ে দিচ্ছে।
রীতিমতো বিপ্লবী ভাবমূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হওয়া ত্রাউরে বুরকিনা ফাসোর প্রধান খনিজসম্পদ সোনাকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে ঔপনিবেশিক সাবেক প্রভু ফ্রান্সের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছেন। জাতীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে। গ্রহণ করেছেন একঝাঁক সংস্কার ও উন্নয়ন কর্মসূচি। আশির দশকে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যেভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সানকারা, এখন ঠিক জনহিতকর কর্মসূচি বাস্তবায়নে মনোযোগী তিনি।
আফ্রিকীয় ভ্রাতৃত্ববাদের (প্যান-আফ্রিকানিজম) অন্যতম প্রধান প্রচারক এই নেতা দুই বছরে এমন সব পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন, যা ছয় দশকে দেখা যায়নি। দেশের প্রধান শহর ওয়াগাদগু বিমানবন্দর নির্মাণ, দেশব্যাপী সড়ক যোগাযোগের আধুনিকীকরণ, দেশে প্রথমবারের মতো সোনা পরিশোধনাগার নির্মাণ, আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ খাতকে স্বনির্ভর করতে নবয়ানযোগ্য জ্বালানি উৎস প্রসারে বিশালাকার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, দ্রুতগতির রেলব্যববস্থা উন্নয়ন, কৃষি খাতে সবুজ বিপ্লবের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ- সবই ত্রাউরের প্রশাসনের অল্পদিনের কর্মসূচি। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর দেশটিতে এত বিপুল জনবান্ধব কর্মসূচি দেখা যায়নি।
স্নাতক শেষ করে ২০০৯ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া ইব্রাহিম ত্রাউরে একদম দেশের ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষে উঠে এসেছেন। তবে তার এই উত্থানে সামরিক বাহিনীর তরুণ নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। তার এমন উত্থানের সঙ্গে সাহেল অঞ্চলের ইসলামি জিহাদি তৎপরতার সংযোগ রয়েছে। সাহেল অঞ্চলে মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজারের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলামিক স্টেট, আল-কায়েদাপন্থি বোকো হারাম, আনসারুল ইসলাম এবং আরও নানা ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে। দামিবা ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদীকে নির্মূল করার কথা বলে প্রেসিডেন্ট রোচ কাবোরের শাসন উৎখাত করেছিলেন।
২০১৮ সালে কাবোরের প্রশাসন এই সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের কথা বলে ফরাসি বাহিনীকে ঘাঁটি গাড়ার সুযোগ দেন দামিবা। কিন্তু এসব উদ্যোগের ব্যর্থতাই ত্রাউরের ক্ষমতা দখলের পথ পরিষ্কার করে দেয়। মোটাদাগে বুরকিনা ফাসোয় পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর লুণ্ঠন আর নব্য উপনিবেশবাদী প্রভাবজনিত কারণে সৃষ্ট ‘অবিকশিত’ রাজনীতির ওপর মানুষ যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। দামিবাকে হটিয়ে দিতে ত্রাউরে এই জনঅসন্তোষকে হাতিয়ার করেছেন; বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পর দামিবা ফরাসি সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় নিলে মানুষ আরও ফুঁসে ওঠে। যার রোষ গিয়ে পড়েছিল ফরাসি দূতাবাসের ওপর। মানুষ ধারণা করেছিল, হয়তো ফরাসি সেনাদের কাজে লাগিয়ে দামিবা শাসনক্ষমতায় ফিরে আসার পথ তৈরি করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সে রকম কোনো পরিস্থিতি হয়নি।
সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোর ক্ষমতাকাঠামো ফ্রান্সের ওপর গত কয়েক দশকে কখনোই সেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। ১৯৬০ সালে স্বাধীন হওয়া বুরকিনা ফাসোয় ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানগুলোর ওপর ফরাসি প্রভাব ত্রাউরে-পূর্ববর্তী সময়েও ছিল প্রকট। পশ্চিম আফ্রিকায় কান পাতলে শোনা যায়, ফ্রান্সের মদদপুষ্ট ক্যুর কারণেই প্রাণ হারাতে হয়েছিল সানকারাকে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্সবিরোধী হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় গত তিন বছরে বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজার থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি। বুরকিনা ফাসো থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি সেনারা চলে যায়। এর মধ্যে পশ্চিমা সমালোচকরা দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব মেনে নিতে পারছেন না। ওয়াগনার গ্রুপকে জায়গা করে দেওয়া কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন রুশ প্রশাসনের প্রভাব বলয়ে এসব দেশের ঢুকে পড়া নিয়ে তারা বেজায় চিন্তিত। ক্ষমতা দখলের পর আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে ত্রাউরের রাশিয়া সফর পশ্চিমাদের সেই আলোচনার পালে আরও হাওয়া দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ধ্রুপদি গণতন্ত্রীরা ত্রাউরের গায়ের উর্দি নিয়ে তো বেশি করে নাক সিটকাচ্ছেন। তার যাবতীয় সংস্কার আর কর্মসূচিও গ্রহণ করতে পারছেন না। তবে হ্যাঁ, তাকে আলোচনার বাইরেও রাখতে পারছেন না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বুরকিনা ফাসোর মানুষের কাছে ত্রাউরের বিকল্প নেই। ফ্রান্সের ছায়াতলে দেশের রাজনৈতিক গোষ্ঠীও সেভাবে বিকশিত হয়নি। দেশে সেই অর্থে জনসম্পৃক্ত রাজনীতিকেরও উত্থান হয়নি। অবিকশিত রাজনীতির গর্ভে বারবার আবির্ভাব হওয়া সামরিক শাসনও দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে পারেনি। হয়তো তাদের পক্ষে তা করা সম্ভবও ছিল না; কারণ ফরাসি প্রভাব বলয়ের বাইরে আসার চিন্তাও তারা করেননি।
ইব্রাহিম ত্রাউরেকে বলা হয় আফ্রিকার দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট। জীবন যাপনে তিনি সাধারণ সৈনিকের মতো। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কখনো মিডিয়ার স্পটলাইটে দেখা যায়নি। কোনো রাষ্ট্রীয় সফরেও তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যান না। পরিবারের প্রটোকল সুবিধা নিজেই বাতিল করেছেন। কোনো আত্মীয় প্রেসিডেন্টকে ভাঙালে কঠোর শাস্তির নির্দেশ দিয়েছেন। মিডিয়ার প্রাইম টাইমে প্রেসিডেন্টের মুখ দেখা যায় না বললেই চলে।
সংস্কার বাস্তবে করে দেখাতে হয়, কাগুজে রিপোর্ট কিংবা তর্জনগর্জন দিয়ে কিছু হয় না। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাউরে এ কথাটি প্রমাণ করেছেন।