নজরদারি খবরদারি নিয়ন্ত্রণের পুঁজিবাদ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা টিম : “নজরদারি পুঁজিবাদ” (Surveillance Capitalism) শব্দটি শোশানা জুবফ (shoshana yuboff) তার ২০১৯ সালের বই The Age of Surveillance Capitalism-এ প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং আবার সেখানেই অধ্যাপনা করছেন। কার্ল মার্কসের শিষ্য এই অধ্যাপিকার আলোচ্য বইটি নিয়ে এখন দুনিয়াজুড়ে তোলপাড়। বইটির বিষয়বস্তু এমন একটি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে বিভিন্ন কর্পোরেশন ডিজিটাল মাধ্যমে সৃষ্ট ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সেই তথ্যের বাণিজ্যিক প্রয়োগের মাধ্যমে থেকে মুনাফা করে থাকে। প্রচলিত পুঁজিবাদের সাথে এর একটি স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত পুঁজিবাদী কাঠামোতে পণ্য ও সেবার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা চলে, সেখানে নজরদারি পুঁজিবাদ ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও আচরণকে পণ্যে পরিণত করে এবং তা থেকে আয় করে। নজরদারি পুঁজিবাদের মূল প্রক্রিয়াটি হলো ব্যবহারকারীর অনলাইন কার্যকলাপ থেকে আপনার স্পষ্ট সম্মতি ছাড়াই তথ্য সংগ্রহ করা। এরপর সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে আপনার ভবিষ্যৎ আচরণ অনুমান করা হয়। পরবর্তীতে সেই তথ্য বিজ্ঞাপনদাতা বা অন্যান্য সংস্থার কাছে বিক্রি করা হয়। এই তথ্যের সাহায্য সেই সব সংস্থা আপনার ক্রয় সিদ্ধান্তসহ ব্যক্তিগত নানা কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে চায়। এই প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক মাধ্যম এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে, এবং একটি নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির ব্যবস্থা তৈরি করেছে। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে নজরদারি পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, স্বতন্ত্রতা এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। এই ব্যবস্থায় মানুষকে এমন কাঁচামালের মতো দেখা হয়, যেখান থেকে মূল্য পাওয়ার ফলে একটি নতুন ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়- যেখানে ব্যক্তিরা শুধু তাদের শ্রমের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, বরং তাদের নিজের ডিজিটাল পরিচয় এবং ব্যক্তিগত জীবন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি, নজরদারি পুঁজিবাদ কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানির হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার একচেটিয়া কেন্দ্রীকরণকে ত্বরান্বিত করে, যা পুঁজিবাদী শ্রেণি বৈষম্যকে আরও গভীর করে। এই কোম্পানিগুলো তথ্যের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবন, কেনাকাটার অভ্যাস এবং এমনকি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এই বইয়ে তিনি মূলত পুঁজিবাদের নজরদারি যুগের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ এবং ব্যবহার করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের আচরণ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও সুশানা জুবভের এই গবেষণার কাজ শুধুমাত্র সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যমের উপর নজরদারির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তবে তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজিবাদের নজরদারি সংবাদ মাধ্যম এবং মানুষের স্বাধীন চিন্তা প্রভাবিত করতে নানারকমভাবে কাজ করছে। পুঁজিবাদের নজরদারির যুগে সংবাদ মাধ্যম ও মানুষের স্বাধীন চিন্তা প্রভাবিত হচ্ছে কিভাবে? সুশানা জুবভের মতে, ‘নজরদারির পুঁজিবাদ’ একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করেছে, যেখানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, তাঁদের আচরণ এবং চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সামাজিক গণমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে মানুষের আগ্রহ, আচরণ এবং মতামত ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে এই প্রতিষ্ঠানগুলি। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা মানুষের চাহিদা এবং রাজনৈতিক বা সামাজিক মতামত নিয়ন্ত্রণ করে, যা সংবাদ মাধ্যমেও প্রতিফলিত হতে পারে। যেমন আগে ক্রেতার পছন্দ জানার জন্য ক্রেতার পছন্দ-অপছন্দের ওপর নজরদারি চালিয়ে, তার পছন্দ অনুযায়ী ভোগ্যপণ্য তৈরি করা হতো। আবার রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী বা সমাজ কি চাইছে, সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলি বা সামাজিক সংস্থাগুলি তাদের কর্মসূচি, প্রতিশ্রুতি বা কার্যক্রম ঠিক করত। নজরদারির পুঁজিবাদের যুগে ব্যাপারটা ঠিক উলটো হয়ে গেছে। এখন যে ভোগ্যপণ্য বা পণ্য বিক্রি করে কর্পোরেটদের সবচেয়ে বেশি মুনাফা হবে, তারা সেটাই উৎপাদন করে। বিক্রির জন্য এবার ক্রেতার পছন্দকে তারা প্রভাবিত করে এবং তা পালটে দেয়। একইভাবে রাজনীতি সমাজনীতির ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দ চিন্তা সব কিছুই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রভাবিত করে পালটে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই কথাগুলো আজ থেকে ৩৪ বছর আগে একটা বইয়ে লিখেছিলেন দুই চিন্তাবিদ- নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারমান। নাম- ‘দ্য ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’। আমেরিকার প্রেক্ষাপটে লেখা এই বইটা আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তারও বহু আগে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক, যাকে জেলে বন্দি করে রেখেছিল ফ্যাসিস্ত মুসোলিনি সরকার, তিনি লিখেছিলেন, ‘রাষ্ট্র সম্মতি আদায়ের যন্ত্র’। আন্তোনিও গ্রামসির কথায়, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্র, এর মধ্যে কাজ করে একাধিক মধ্যস্থতাকারী। শ্রমিকরা এই ব্যবস্থায় যন্ত্রের মতো উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের কাজ করে। এখানে শ্রমজীবীদের ‘সম্মতি’, একটি মতাদর্শগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তিগুলি প্রভাবশালী শ্রেণির আধিপত্যের পক্ষে ‘সম্মতি’ আদায় নিশ্চিত করে। অর্থাৎ সম্মতি দেবে মানুষ, কিন্ত এমন পরিবেশ বা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যেখানে শ্রমজীবীরাও বাধ্য হয় শাসক শ্রেণির পক্ষে সম্মতি দিতে। যেমন একজন বেকার যুবক যদি অত্যন্ত কম মজুরিতেও কাজ পায়, তাতেই সে খুশি হয়ে যায় সাময়িক সময়ের জন্য। অথবা কাজ, ন্যায্য মজুরি যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সরকার দিচ্ছে না, কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়েই তাঁদের সাময়িক সমর্থন আদায় করে নেয় শাসক। আবার কেবলমাত্র পুঁজির অনুগত দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে মানুষের গণতান্ত্রিক বা ভোটের পছন্দকে আটকে রাখতে, এদের বিকল্পহীনতার তথ্যই প্রচার করে সংবাদমাধ্যম দ্বারা মানুষের মতকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। ঠিক এমনভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজির সেবাদাস দুই দলের বাইরে অন্য কোনও মতবাদের রাজনৈতিক দল কোনও প্রচারই পায় না, ফলে মানুষও এদের প্রকৃত বিকল্পের খবরই পায় না। এভাবেই মানুষের সম্মতি আদায় করা হয়, বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে। একইভাবে মানুষকে কাজ দিতে পারছে না সরকার, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম দিচ্ছে না, শিক্ষা-চিকিৎসার খরচ সাধারণের নাগালে বাইরে, জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে, মজুরি বাড়ছে না– এসব যে সরকারের জনবিরোধী নীতির কারণেই হচ্ছে, তা ভুলিয়ে দেওয়া হয় সুকৌশলে বিদ্বেষ বিভাজনের লাগাতার প্রচার নির্মাণ করে। প্রচার করা হয়, অন্য ধর্ম বা ভাষা বা জাতির লোকদের জন্যই একজন ব্যক্তির এই সমস্যা। তাই এসব সমস্যা সমাধানের জন্য লড়তে হবে অন্য ধর্ম ভাষা বা জাতির মানুষদের বিরুদ্ধে। এভাবে মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রভাবিত করে তাদের মন বিষাক্ত করা হয়। সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা, এই শব্দটা গোড়ার সময় থেকেই চলে আসছে। সত্যিই কি এটা সম্ভব? না কি এটা একটা অলীক কল্পনা মাত্র! এ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে এবং চলবেও। যে সমাজ শোষক শোষিত এই দু’ভাগে বিভক্ত, যে সমাজ লুটে খাওয়া আর খেটে খাওয়া এই দু’ভাগে বিভক্ত, সেখানে সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা বা পরিচালন ভার কার হাতে আছে, তার ওপরেই নির্ভর করে সেই সংবাদ মাধ্যম কার পক্ষে দাঁড়াবে। সংবাদ মাধ্যমের মালিকানা থাকবে পুঁজিপাতি ধনী শোষক-শাসক শ্রেণির হাতে, আর চাষি-মজুর-খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দুর্দশার খবরও থাকবে, সেটা কি হয়! আধুনিক সমাজে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ শুধু তথ্য প্রদান করে না, সমাজের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করে। তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংবাদ মাধ্যমগুলি সাধারণত সমাজের শাসক শ্রেণির পক্ষে কাজ করে, যা তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে। পুঁজিবাদী সমাজে সংবাদ মাধ্যমের নজরদারির ভূমিকা এবং এর সামাজিক প্রভাব নিয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়া থাকা অত্যন্ত জরুরি। শ্রেণি বিভাজন এবং বাজারের স্বাধীনতা পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান ভিত্তি। এখানে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাতে বৃহৎ পরিমাণে সম্পদ ও শক্তি কেন্দ্রীভূত করে এবং তাদের পুঁজি বৃদ্ধির চেষ্টা করতেই থাকে। এর মধ্যে সংবাদ মাধ্যম এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে শাসক শ্রেণি তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব নিজের পক্ষে রাখার জন্য তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণে সবচেয়ে বেশি নজরদারি চালায়। সংবাদ মাধ্যম তথ্য পরিবেশন করে, কিন্তু কোন তথ্য দেওয়া হবে এবং কেমনভাবে দেওয়া হবে, তা ঠিক করার পদ্ধতি শাসক শ্রেণির ওপরই নির্ভর করে। ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ‘নজরদারি সমাজ’বা ‘Disciplinary Society’ এর ধারণা উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, আধুনিক সমাজে নজরদারি একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে সরকার বা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী জনগণের আচরণ এবং চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। এই ধারণাটি পুঁজিবাদী সমাজের সংবাদ মাধ্যমের কার্যক্রমের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সংবাদ মাধ্যম জনগণের মনোভাব, আচরণ এবং বিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি তাদের জীবনের বিভিন্ন দিককে নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মিশেল ফুকো যৌবনের প্রারম্ভে তাঁর শিক্ষক লুই আলথুসারের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হলেও, মার্কসবাদের শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বের সাথে সহমত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী সমাজ কিভাবে মানুষের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার কুপ্রভাব নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংবাদ মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো জনগণের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করা এবং সমাজে তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা। শুধু খবর পরিবেশন নয়, বরং কোন খবর, কিভাবে এবং কখন পরিবেশিত হবে তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মনের উপরে এক ধরনের ‘নজরদারি’প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংবাদ মাধ্যম কেবল তথ্য গোপন বা বিকৃত করা নয়, তা নির্মাণ করে, নির্বাচন করে এবং প্রচারিত তথ্যের মধ্যে নিজেদের সুবিধা মতো নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। যেমন, কোনও একটি বড় কর্পোরেট কোম্পানি বা শাসক দল যদি কোনও সঙ্কটের মধ্যে পড়ে, তবে সংবাদ মাধ্যম তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে, বিষয়টি গোপন করে সেই সঙ্কটগুলোকে জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পারে। আবার এসম্পর্কে বিকৃত বা অর্ধসত্য তথ্যও উপস্থিত করতে পারে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের দেশে প্রতিদিনই আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে, ব্রডকাস্ট মিডিয়া যেমন টেলিভিশন বা রেডিও এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যেমন বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম, এসবের মাধ্যমে মিডিয়া কোম্পানিগুলো বড় অংশের জনগণের মনোভাবকে প্রভাবিত করে পরিবর্তন করতে সক্ষম। পুঁজিবাদী সমাজে সংবাদমাধ্যম কার্যকরভাবে শ্রেণিসংগ্রামের অংশ হিসাবে কাজ করে। শাসক শ্রেণি, যারা বড় করপোরেটের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মনোভাব এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে তারা নিজেদের শাসন ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক সুবিধা ধরে রাখতে পারে। এই কারণে মিডিয়া সংস্থাগুলো বা সংবাদ মাধ্যমগুলো সাধারণত তাদের প্রতিবেদনে শাসক শ্রেণির পক্ষের বিশ্লেষণ তুলে ধরে এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য নানা উপায় অবলম্বন করে। খবর নির্বাচন, ভাষার ব্যবহার, এবং যে কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট লেখার ধরন জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যে কোনও আন্দোলন বা প্রতিবাদ যদি শাসকের পক্ষে বিপজ্জনক হয়, তবে তা হয় বাদ যায় অথবা ছোট্ট খবর হয় অথবা বিকৃতভাবে উপস্থিত করা হয়। বিজ্ঞাপন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যার মাধ্যমে পুঁজিবাদ সংবাদ মাধ্যম এবং মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সংবাদ মাধ্যমগুলি বিজ্ঞাপন থেকে অর্থ উপার্জন করে এবং বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিজ্ঞাপন পরিবেশন করে। কর্পোরেটের স্বার্থবিরোধী খবর করলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। সংবাদ মাধ্যম অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে আত্মসমর্পণ করে। অবশ্যই সবাই তা করে না। এছাড়াও এই বিজ্ঞাপনগুলি কেবল পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করার জন্যই ব্যবহৃত হয় না, সমাজের মানসিকতা এবং ভোগবাদী সংস্কৃতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, প্রায়শই খবরে প্রকাশ পায়, অভিভাবক সন্তানকে মোবাইল বা বাইক না দেওয়ায় হতাশ হয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে কোনও কিশোর-কিশোরী। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোগবাদ তাকে বুঝিয়েছে, নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধু-খেলা-শিক্ষা-নাচ-গান সব কিছুই মূল্যহীন, কেবল মোবাইল বা বাইক ছাড়া। এভাবে সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সংবাদ বা বিজ্ঞাপন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থে সমাজের ওপর ভয়ঙ্কর নেতিবাচক বিপজ্জনক প্রভাব বিস্তার করছে। সংবাদ মাধ্যম আসলে জনগণের পক্ষে নয় বরং করপোরেট বা শাসক শ্রেণির পক্ষেই কাজ করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং সংবাদ মাধ্যমের মালিকানার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়, যখনই সাংবাদিকরা স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সরকার বা শক্তিশালী কর্পোরেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত চাকরিও ছাড়তে বাধ্য হন অনেকে। সবাই আত্মসমর্পণ করেন, তা নয়। এর বেশকিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে নজরদারি আরও প্রবল। ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে, সোশাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্মগুলোও অবিরাম মানুষের চিন্তা এবং মতামত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে চলেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর বেশিরভাগই সাধারণভাবে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে এবং বিজ্ঞাপন বা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু প্রচারের মাধ্যমে তাদের চিন্তা এবং মনোভাব প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক বা গুগলের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মানুষকে এমন তথ্য এবং সংবাদ দেখায়, যা তাদের আগের পছন্দ বা মনোভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ফলে মানুষের চিন্তাধারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তারা নতুন বা বিরোধী মতামত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এর সাথে রয়েছে যথেচ্ছ অসত্য বিকৃত প্রচার এবং রাজনৈতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর এই ডিজিটাল কৌশল মানুষকে একটি ‘ইকো চেম্বার’-এ (Echo Chamber) পরিণত করে, যেখানে তারা শুধুমাত্র নিজেদের মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্যই দেখতে পায়, এবং এর ফলে তাদের চিন্তা ও মতামতের বৈচিত্র্য কমে যায়। ঠিক এভাবেই মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে বন্দি করে রাখে পুঁজিবাদ। এভাবেই চলে সংবাদ, তথ্য, ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণের খেলা এই পুঁজিবাদী দুনিয়ায়।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..