
কংকন নাগ :
কয়েক দশক ধরেই এ দেশের প্রধানতম অসাম্প্রদায়িক উৎসব ‘বাংলা বর্ষবরণ’। প্রায় প্রতিবছরই এ উৎসব ঘিরে নানা শঙ্কা, হুমকি, ভুল ব্যাখ্যার অবতারণা ঘটানো হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক নানা উৎসব ও আয়োজন ঘিরে ষড়যন্ত্র চলছে। যার আপত সবশেষ উদাহরণ পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উৎসব।
এ ষড়যন্ত্রের শুরু মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের দাবির মধ্য দিয়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে নাম পাল্টে রূপ নেয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য়। এরপর থেকেই মূলত এটি ধীরে ধীরে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হতে থাকে। হয়ে ওঠে বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, বর্তমানে প্রায় সব জেলাতেই আয়োজন হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পাল্টানোর উদ্ভট দাবি ওঠানো হয় কিছুদিন আগে। যে দাবির পেছনে হাওয়া দেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টাও। এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে তিনি মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে থাকেন। যে সুযোগে উগ্র, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো মঙ্গল শব্দটির অপব্যাখ্যা করে দাবি তোলে শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ এখনও (সংবাদ লেখা পর্যন্ত) নামের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না জানালেও পুরো আয়োজন নিয়েই যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তারা।
দীর্ঘদিনের প্রথা অনুযায়ী, মঙ্গল শোভাযাত্রার সকল আয়োজনের মুখ্য ভূমিকায় থাকে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। একেক বছর একেকটি ব্যাচকে মূল আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের অভিভাবকের ভূমিকায় থাকেন শিক্ষকরা। স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার আমলেও যে প্রথা ভাঙা হয়নি। কিন্তু, এবছর হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে পুরো আয়োজনের দায়িত্ব নেয় চারুকলার শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করেছেন তারা। যার ফলে, শোভাযাত্রার মোটিফ নির্ধারণ থেকে শুরু করে কোন পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সরাসরি রাজনীতিকরণের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। যার উদাহরণ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি। অতীতেও বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিকৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রায় রাখা হয়েছে বলে ভুল তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে এ ঘটনার পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টাও করা হচ্ছে। অথচ, প্রকৃত ঘটনা হলো নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি শুধু স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধীতাকারী, রাজাকার কুলের শিরোমনি গোলাম আজমের প্রতিকৃতি বানিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রাখা হয়েছিল, যা ছিল শিক্ষার্থীসহ সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ফসল।
আওয়ামী লীগের আমলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। যদিও শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই সেসময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। দুঃখের বিষয় হলো, আওয়ামী আমলের সেই হস্তক্ষেপের অপসংস্কৃতি বৈষম্যহীন বাংলাদেশেও অব্যাহত রাখা হয়েছে। এসব কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বৈশাখের আয়োজনকে স্বজনপ্রীতিদুষ্ট ও দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী হিসেবে বর্ণনা করে তা বর্জন করেছেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের ২৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তবে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব রাখার বিষয়টি ইতিবাচক বলে অনেকের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে।
শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, বর্ষবরণ উৎসবের আরেকটি অন্যতম অনুষঙ্গ ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠান ঘিরেও নানা অনিশ্চয়তা তৈরির চেষ্টা দেখা গেছে। ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুর পর আয়োজন করা নিয়ে দোলাচল দেখা দেয়। তবে, দোলাচল কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠানটির শিল্পীসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা পর্যায়েও বর্ষবরণ আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঘটনা দেখা যাচ্ছে। বরিশালে প্রতিবছরই উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বর্ণিল শোভাযাত্রা, বর্ষবরণ উৎসব ও বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়। কিন্তু, এবার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে মেলার অনুমতি দিতে অপারগতা জানিয়েছে পুলিশ। ফলে, বন্ধ হয়ে গেছে মেলার আয়োজন। এছাড়া, চট্টগ্রামের ডিসি হিলে প্রায় অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ আয়োজন নিয়েও প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় দুই মাস আগে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হলেও নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে অনুমতি দেয়া হয় উৎসব আয়োজনের মাত্র তিন দিন আগে, বৃহস্পতিবার। এছাড়া বিকাল ৪টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ এবং অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হতে যাওয়া গানের তালিকাও জমা দিতে বলা হয়ছে, যা কিনা শিল্পীর স্বাধীনতা তথা সংস্কৃতি চর্চার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। এসব ঘটনাকে সর্বজনীন উৎসবকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস হিসেবে দেখছেন সেখানকার সংস্কৃতিকর্মীরা। অন্যান্য জেলাতেও বর্ষবরণ আয়োজনকে নানাভাবে সীমিত করার অপচেষ্টা দেখা গেছে।
সব মিলিয়ে এবারের বাংলা বর্ষবরণ-১৪৩২ উৎসব নানা শঙ্কার দোলাচলে দুলছে। অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে প্রত্যয় প্রতিবছর বর্ষবরণ আয়োজন থেকে নেয়া হয়, তাকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস রুখে দিতে হবে। সব শঙ্কা কাটিয়ে এবারের বাংলা বর্ষবরণ উৎসব প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন করাই বর্তমানের মূল লক্ষ্য।