
যেহেতু রাশিয়া-চীন সম্পর্ক গভীর হচ্ছে, তাই তাদেরকে ঘিরে কথাবার্তাও বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের যেকোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ের আদান-প্রদান সংঘটিত হচ্ছে। ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সংস্কার পর্যন্ত প্রধান বৈশ্বিক বিষয়গুলিতে উভয় দেশই প্রায় একই অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু যখন অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা আসে, তখন বিষয়টি প্রায়শই আরও সন্দেহবাদিতার দিকে মোড় নেয়, বিশেষ করে রাশিয়ার মধ্যে প্রাধান্যবিস্তারকারি বিষয়টি হয়: বেইজিংয়ের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ভয়।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের নাটকীয় বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিলে এই উদ্বেগ পুরোপুরিভাবে আশ্চর্যজনক নয়। ২০২১ সালে, রাশিয়ার বাণিজ্যের মাত্র ১৮% ছিল চীন। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, এই পরিমাণ ৩৪%-এ পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যেখানে চীন প্রতিনিধিত্ব করবে আমদানির ৪১% এবং রপ্তানির ৩০%। এই উল্লম্ফন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাণিজ্যে তীব্র সংকোচনের সাথে মিলে যায়, যা মাত্র তিন বছরে রাশিয়ার মোট বাণিজ্যের অর্ধেকেরও বেশি থেকে ২০%-এর নিচে নেমে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে, চীনের দিকে পরিবর্তন কেবল যৌক্তিকই নয়, অনিবার্যও বলে মনে হয়।
তবুও কেবলমাত্র সংখ্যাগুলিই বিপজ্জনক অতিরিক্ত নির্ভরতার ধারণাটিকে সমর্থন করে না। প্রথমত, রাশিয়ার বাণিজ্য পোর্টফোলিও কম তো নয়ই, বরং আরও অধিক হারে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। ভারত, তুরস্ক এবং ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়নের দেশগুলির সাথে বাণিজ্য বাড়ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীনের চেয়েও দ্রুতগতিতে। আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা একতরফা নির্ভরতা নয়, বরং রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভূগোলের পুনর্বিন্যাস। ২০২২ সাল পর্যন্ত, রাশিয়ার বর্হিবাণিজ্য অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে ছিল। সেই ভারসাম্যহীনতা এখন সংশোধিত হচ্ছে।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাশিয়া যে চীনের অর্থনৈতিক “ছোট ভাই” হয়ে উঠছে এই আশঙ্কা বাণিজ্য বা বিনিয়োগের প্রকৃত কাঠামো দ্বারা প্রমাণিত হয় না। আসলে, রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে চীনের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত পরিচালনা করে, যা চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য-অংশীদারদের মধ্যে বিরল। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২০টিরও বেশি দেশে চীন বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। রাশিয়া এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় বললেই চলে।
অধীনস্ত সামন্ত-সম্পর্কের মতো নির্ভরতার ধারণাটি প্রায়শই এই ধারণার উপর নির্ভর করে যে চীনা পণ্য রাশিয়ার বাজার প্লাবিত করেছে। অটোমোবাইল-এর মতো একটি ক্ষেত্রে এটি আংশিকভাবে সত্য। পশ্চিমা নির্মাতারা চলে যাওয়ার পর রাশিয়ার গাড়ির বাজারে এখন চীনা ব্র্যান্ডগুলির আধিপত্য। তবে, এই আধিপত্য স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। রাশিয়ান সরকার ইতিমধ্যেই দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আমদানি শুল্ক বাড়াতে পারে অথবা জাপানি ও কোরিয়ানন সংস্থাগুলিকে প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা দিতে পারে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে, চিত্রটি অধিকতর সূক্ষ্ম। চীন থেকে শিল্প সরঞ্জামের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে এই প্রবণতা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতি বাস্তবসম্মত প্রতিক্রিয়ার চেয়ে নির্ভরতার লক্ষণ অপেক্ষাকৃত কম। তাছাড়া, আমদানি প্রতিস্থাপন নীতি এবং পশ্চিমা সরঞ্জামের জন্য ধূসর-বাজারের পথগুলি ভূদৃশ্যকে মোটেও কম নয়, বরং আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
বিনিয়োগ সহযোগিতা এর চেয়ে স্পষ্টতর গল্প বলে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ২০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের প্রায় ৮০টি পরিকল্পিত প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, মাত্র ৫০টি বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মোট বিনিয়োগ মাত্র ৭৮০ বিলিয়ন রুবল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে নিয়ন্ত্রণমূলক অংশীদারিত্ব অর্জনে চীন খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে প্রবেশের চেষ্টাও করেনি। এমনকি অটো সেক্টরেও, চীনা সংস্থাগুলি স্থানীয়করণের জন্য ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিয়েছে। যৌথ স্বার্থ সত্ত্বেও, পাওয়ার অব সাইবেরিয়া-২ গ্যাস পাইপলাইনের মতো বড় প্রকল্পগুলির অগ্রগতি ধীর।
এই সতর্ক অভ্যাগমন আংশিকভাবে গৌণ নিষেধাজ্ঞার উদ্বেগের কারণে। চীনা বিনিয়োগকারীরা ভূ-রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সতর্ক এবং সতর্কতা অবলম্বন করার দিক থেকে ভুল করতে পছন্দ করেন। ফলত, চীনা পুঁজি সেভাবে রাশিয়াকে ভাসিয়ে দেয়নি যেমনটি কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলো। বিপরীতে, কেউ যুক্তি দিতে পারে যে রাশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক পদচিহ্ন ছোট, খুব বেশি বড় নয়।
রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পিছিয়ে থাকে-এই পুরনো প্রবাদটি এখনও সত্য, এমনকি ২০২২-পরবর্তী পরিবেশেও। এবং চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ-ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দীর্ঘমেয়াদে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্ভাব্য সম্পর্ক। এই ধরণের বৈচিত্র্য কেবল রাশিয়ার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থানকেই শক্তিশালী করবে না বরং বেইজিংয়ের সাথে দর কষাকষির ক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে।
রাশিয়া-চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরালো করতে এবং বহিঃস্থ ধাক্কার ঝুঁকি কমাতে কাঠামোগত উন্নতি প্রয়োজন। নিষেধাজ্ঞা সহ্য করার জন্য সমান্তরাল আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নির্ভরযোগ্য লজিস্টিক করিডোর তৈরি করা, আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা অঞ্চল সম্প্রসারণ করা এবং সবশেষে দীর্ঘ আলোচিত একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই পদক্ষেপগুলি সম্পর্ককে আরও স্থিতিস্থাপক এবং কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করবে।
রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে, একবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীন। সামনের কাজ হল এই বাস্তবতাকে ভয় না পাওয়া বরং এটাকে পারস্পরিক সুবিধার জন্য রূপদান করা। আসল বিপদ নির্ভরতার মধ্যে নয়, বরং ঐতিহাসিক সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত।
[ইগর মাকারভ, অর্থনীতিবিষয়ক উচ্চতর বিদ্যালয়ের (এইচএসই) সহযোগী অধ্যাপক, জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক গবেষণা ও শিক্ষামূলক পরীক্ষাগারের প্রধান এবং সমসাময়িক বিশ্ব অর্থনীতিবিষয়ক এইচএসই-র প্রধান সম্পাদক।]
অনুবাদ : বিপ্লব রঞ্জন সাহা