উদ্বেগজনকভাবে এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস

ঐশ্বর্য সৌরভ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
* সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত পরীক্ষার্থী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে * রংপুরের তারাগঞ্জে অনুপস্থিত চারজন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার * শ্রুতিলেখকের সহায়তা পাননি চট্টগ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা * কক্সবাজারের উখিয়ায় অ্যাডমিট কার্ড না পাওয়ায় পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ * ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কেন্দ্রে * অগ্নিকাণ্ড, অন্যটিতে মোমবাতির আলোয় পরীক্ষা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ১০ এপ্রিল থেকে। প্রবেশপত্র জটিলতার অভিযোগ, শ্রুতিলেখকের সহায়তা না নিতে দেওয়া, অনুপস্থিতি বৃদ্ধি ও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমাসহ নানারকম সংকট লক্ষ্য করা গেছে এবছরেও। গতবারের চেয়ে এবার প্রায় এক লাখ পরীক্ষার্থী কমেছে বলে জানা গেছে। এবার মোট পরীক্ষার্থী ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন। ২০২৪ সালের তুলনায় এবার প্রায় এক লাখ পরীক্ষার্থী কম। গতবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। গতবারও তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪৮ হাজার পরীক্ষার্থী কমেছিল। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। ২০২৩ সালে ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন এবং ২০২২ সালে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ এবং ২০২১ সালে ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ায় এসএসসির প্রবেশপত্র পেল না পরীক্ষার্থীরা এমন খবরও নজরে এসেছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র আটকে রাখা অভিযোগ উঠেছে ময়মনসিংহ সদরের রেনেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ পারভীনের বিরুদ্ধে। গত ৯ এপ্রিল (পরীক্ষার একদিন আগে) দুপুর ২টায় এ নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন ছাত্রী ও অভিভাবকরা। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, পরীক্ষার মাত্র একদিন বাকি। এরই মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার সব সরকারি ফি পরিশোধ করেছেন তারা। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত টাকার জন্য প্রবেশপত্র আটকে রেখেছেন। আগামীকাল পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষক প্রবেশপত্র না দিয়ে তার বাসায় নিয়ে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। অভিভাবক মমতাজ মিয়া বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে বিদ্যালয় কোনো টাকা পায় না। অতিরিক্ত টাকার জন্য প্রবেশপত্র আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু সায়েম হাসান সমকাল পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতে বলেন, এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। এটি সত্য হলে প্রধান শিক্ষককে পুলিশে দেওয়া দরকার। আমি শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। প্রবেশপত্র না পাওয়া অভিযোগ থাকলেও ফরম পূরণ করেও প্রথম দিনে পরীক্ষা দেয়নি ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষার প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিল ২৬ হাজার ৯২৮ জন পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ তারা পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দেয়নি। আর প্রথম দিনে অসদুপায়ের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছে ২২ জন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা শেষে আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রথম দিনের এসব তথ্য জানানো হয়েছে। আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির। অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। এই বোর্ডে অনুপস্থিত পরীক্ষার্থী ৯ হাজার ৬২৩ জন। বাকিদের মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৩ হাজার ৪৯৬ জন, রাজশাহীতে ১ হাজার ৬২২ জন, কুমিল্লায় ২ হাজার ৫৫৩ জন, যশোরে ১ হাজার ৮০০ জন, চট্টগ্রামে ১ হাজার ১৭৩ জন, সিলেটে ৮৭৮ জন, বরিশালে ১ হাজার ৩৩ জন, দিনাজপুরে ১ হাজার ৩৪১ জন, ময়মনসিংহে ৮৪২ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ২ হাজার ৫৬৭ জন পরীক্ষার্থী রয়েছে। অন্যদিকে বহিষ্কৃত হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১০ জন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১০ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুজন পরীক্ষার্থী রয়েছে। গতবছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৩৫৯ জন পরীক্ষার্থী। এ বছর অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া গত বছর অসদুপায় অবলম্বনের জন্য বহিষ্কার হয়েছিল ২৪ জন পরীক্ষার্থী। অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের (ছাত্রী) বড় অংশ পরিবারের চাপে বাল্যবিয়ে করতে বাধ্য হন বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। পরীক্ষার প্রথম দিনে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ১৮ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি বলে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ভুয়া জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে এসব বাল্যবিবাহ হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারাগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল (কারিগরি) মিলিয়ে ১ হাজার ৭৫৭ জন শিক্ষার্থী এবারের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম পূরণ করে। পাঁচটি কেন্দ্রে আজ তাদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১ হাজার ৭৩৯ জন। প্রথম দিনেই অনুপস্থিত ১৮ জন। এর মধ্যে ১০ জন ছাত্রী। তারাগঞ্জ ও/এ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৪০৮ জনের মধ্যে ৭ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। সাতজনের পাঁচজনই মেয়ে। তাদের চারজন ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ও একজন কুর্শা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জলিলুর রহমান বলেন, পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া ওই চার শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। বাল্যবিবাহ না দিতে অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ কুফল সম্পর্কে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে অনেকে গোপনে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমিতে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রথম দিন হাত ঘড়ি (এনালগ (কাটাযুক্ত) নিয়ে ঢুকতে পারেনি পরীক্ষার্থীরা, কেন্দ্রেও পরীক্ষার হলগুলোতে দেওয়াল ঘড়ি ছিল না। এতে বিড়ম্বনায় পড়েন শিক্ষার্থীরা। সৃজনশীল পরীক্ষায় সময় মেনে উত্তর লিখতে হয় তাই ঘড়ির প্রয়োজন জরুরি বলে মনে করেন অভিভাবকরা। রুটিন নিয়েও বিরূপ মন্তব্য লক্ষ্য করা গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তিনবার পরিবর্তন করা হয় রুটিন। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অমানবিকতার শিকার হয়েছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা। শ্রুতিলেখক না থাকায় অনেক কষ্ট আর সংগ্রাম করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত আসা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ব্যর্র্থ হওয়ায় হতাশ অভিভাবকরা। এর জন্য শিক্ষা বোর্ড, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরতদের দোষারোপ করেন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা হল কেন্দ্রে প্রবেশ করার পর কোনোরকম সহযোগিতা না পেয়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে অশ্রুঝরা চোখে বিদায় নেন এসব পরীক্ষার্থী। এদিকে, ঠাকুরগাঁওয়ে মোমবাতির আলোতে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে বৃষ্টিতে ভিজে কেন্দ্রে পৌঁছার পর বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে মোমবাতির আলোয় এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে পরীক্ষার্থীরা। প্রথম দিন ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে। সকাল ১০টায় সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁওয়েও একযোগে পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগ থেকেই জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত ও বৈদ্যুতিক সমস্যার দেখা দেয়। সকাল ৯টার দিকেই শুরু হয় টানা বৃষ্টি, যা চলে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত। এ সময় অনেক পরীক্ষার্থীকে বৃষ্টিতে ভিজে কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে দেখা যায়। কেউ ভিজে গিয়ে কেন্দ্রে ঢুকেছে, কেউ আবার বই-খাতা ও অ্যাডমিট কার্ড বাঁচিয়ে কষ্ট করে কেন্দ্রে পৌঁছেছে। ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী বলে, বাইরে ঝড়-বৃষ্টি, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। আমাদের রুমে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আলো কম থাকায় প্রশ্ন পড়া ও উত্তর লেখা বেশ কষ্টকর ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর পরেও বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটে। তবে কতটি কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটেছে তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আবার অনেকে কেন্দ্রের পরীক্ষা কক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় বিপাকে পড়ে শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে (এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত সাড়ে ৮টার সময় জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের মূল ফটকের বাম পাশে কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শ্রেণি কক্ষগুলোতে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। হঠাৎ আগুন দেখতে পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয় স্থানীয়রা। এসএসসি পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড না পেয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে। তারা সকালে এসে বিদ্যালয়ের গেটে তালা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ সময় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। উখিয়া মরিচ্যা হলদিয়া পালং আদর্শ বিদ্যানিকেতন নামে এক স্কুলে ১৩ জন পরীক্ষার্থীকে কোনো অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়নি। ফলে বৃহস্পতিবার সকালে পরীক্ষা দিতে না পেরে তারা সড়ক অবরোধ করে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা শিক্ষার্থীর অভিভাবক নুর আলম বলেন, আমার মেয়ের ফরম পূরণের টাকা দিয়েছি। সকালে অ্যাডমিট কার্ড দেওয়ার কথা। এখানে এসে দেখি স্কুল তালাবদ্ধ। প্রধান শিক্ষক পালাতক। আমাদের সন্তানদের দুইবছর মাটি হয়ে গেল। এবার সারা দেশে ৩ হাজার ৭১৫টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষাজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষা। এবার মোট পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন এবং ছাত্র ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..