অনিশ্চয়তা, অস্থিরতায় নতুন বছরে যাত্রা
ডা. সাজেদুল হক রুবেল
মঙ্গলের বদলে আনন্দ যাত্রায় বাংলাদেশ। বাস্তব কিন্তু খুবই বৈপরিত্যমূলক। অস্থির পরিস্থিতি আর নানা অশনিসংকেত, গণমানুষের কাছে অমঙ্গলের সংকেত বয়ে আনছে।
বাংলা নববর্ষ। এ ভূখন্ডে বাঙালি, আদিবাসী সকলেই কয়েক শত বছর ধরে পহেলা বৈশাখে উৎসবে মেতে উঠেন। বাংলা সনের সূচনা হয়েছে মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে, ১৫৮৪ সালে। তখন কৃষিকাজ এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি করে নতুন একটি সন প্রবর্তন করা হয়, যেটিকে প্রথমে ‘ফসলি সন’ বলা হতো। পরে এটি ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিত হয়।
বাঙালির নববর্ষ উদযাপন মূলত গ্রামীণ উৎসব হিসেবেই শুরু হয়েছিল। কৃষকরা খাজনা মিটিয়ে জমিদারের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যেত, জমিদাররা সেই দিন পুণ্যাহ নামের উৎসবের আয়োজন করতেন। সেখানে গান, নাচ, নাটক হতো। এই ঐতিহ্য মূলত বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ।
পহেলা বৈশাখের এইদিনে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুরু হয়। এই শোভাযাত্রা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে একটি রঙিন, বর্ণিল, এবং গণমুখী সংস্কৃতি আন্দোলনে পরিণত হয়। ২০১৬ সালে এটি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ডক্টর ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর আজ খড়গহস্ত হচ্ছেন।
কেন হঠাৎ করে চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের ৩৬ বছরের চলে আসা এই কর্মসূচিকে নিয়ে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই অতি খবরদারী! এটাকি জনদাবি ছিল? স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে, সংষ্কার এর যাত্রাপথ, সেখানে আবশ্যকীয় ছিল? গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিড কি এহেন সিদ্ধান্তে উপকৃত হবে? নাকি বিশেষ অশুভ গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি সরকারের নতজানু প্রবণতার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ এই সিদ্ধান্ত?
নুরুল আবছার, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, তাঁকে গত ১০ এপ্রিল সকালে কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন থেকে আটক করে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মী তাঁকে ‘অপরিচিত লোক’ দাবি করে ধরে ফেলে এবং পরে রামু থানায় সোপর্দ করে। এ সময় তিনি স্থানীয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমন কান্তি চৌধুরী জানান, প্রাথমিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদের পর এবং পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে তাঁর পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
আটকের পর প্রায় ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়, যা নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই এটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করছেন।
একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া শুধু অপমানজনকই নয়, বরং তা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও অবমাননা করে।
৭৪ সালের বিশেষ এক ক্ষমতা আইনে, বিগত হাসিনা সরকারের ফ্যাসিস্ট কায়দায় মেঘনা আলমকে গ্রেফতার ও কারাগারে ডিটেশন। এই ঘটনা কিসের ইঙ্গিত জনমনে দিচ্ছে? বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে হালকা করে ‘বিস্ময়’ বলা গেলেও, আসলে এগুলো শুদ্ধ নাটক- তাও আবার থ্রিলার, রোমান্স ও ট্র্যাজেডির এক অদ্ভুত মিশেল। এমনই এক নতুন অধ্যায়ে আমরা পেয়েছি ‘মেঘনা আলম’ নামক এক চরিত্রকে, যিনি নিজেকে দাবি করলেন সৌদি রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী, আর কিছুদিন পরই তার ঠাঁই হলো কাশিমপুরে। হ্যাঁ, জেলেই! মডেল ও “মিস আর্থ বাংলাদেশ ২০২০”-খ্যাত মেঘনা আলম।
কারণ? বিশেষ ক্ষমতা আইন! সেটিই এখন একজন সাবেক সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়ীর উপর প্রয়োগ করা হলো- যেহেতু তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় কূটনীতিতে ‘ঝাঁকি’ দিয়েছেন। কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করার দায় যেন এখন পুলিশের সাথে সাথে নায়িকাদেরও।
নারী, মিডিয়া ও মতপ্রকাশের এক ত্রিকোণ যুদ্ধ দৃশ্যমান করে। মেঘনা আলমের ঘটনার ভেতর দিয়ে আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানও একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে। একজন নারী যদি ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ শক্তির কথা বলেন, বা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন, তাহলে তার ঠাঁই কোথায়? উত্তর- সংবাদ শিরোনাম, ফেসবুকের মিম, এবং... কারাগার। সৌদি রাষ্ট্রদূত এখনও চুপ, সরকার তৎপর, আমরা কি মেঘনার অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে যাচাই করেছি?
বাংলাদেশে মব ট্রায়াল, সামাজিক রায় ও রাষ্ট্রের আচরণ যেন অদ্ভুতভাবে একসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। ২০২৫ এর এস.এস.সি পরীক্ষায় এবার পরীক্ষার্থী কমেছে প্রায় এক লাখ। পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনেকের অনুপস্থিতি চোখে পড়ে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধুমাত্র পরীক্ষার প্রথম দিনেই ফরম পূরণ করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি ২৭ হাজার পরীক্ষার্থী। এই সংখ্যাটি নিছক সংখ্যা নয়- এর পেছনে লুকিয়ে আছে সমাজের নানা বাস্তবতা। কেউ হয়তো দারিদ্র্যের কারণে, কেউ অসুস্থতা বা পারিবারিক সমস্যার কারণে, আবার কেউ হয়তো শিক্ষা ব্যবস্থায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা যখন পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করি, তখন এই অনুপস্থিতদের কথাও ভাবা দরকার। কেন তারা অংশ নিল না? কী তাদের ঠেকিয়ে রাখল? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংষ্কারের মহাযজ্ঞে অধিকার বঞ্চিত এই ছাত্র-ছাত্রী হয়তো হিসেবেই নয়। কারণ তারা মব সন্ত্রাসের পথে যায় নাই।
এদেশের কল-কারখানায়, সেবা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি হতে বঞ্চিত, এর পাশাপাশি আউটসোর্সিং নামের আরো নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা বর্তমানে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেখানে বর্তমান শ্রম আইন যত সামান্য অধিকার সাধারণ শ্রমিকদের দেয় এই আউটসোর্সিং ব্যবস্থা তাও কেড়ে নেয়। আউটসোর্সের শ্রমিক কামরান হোসেন এর মৃত্যু প্রমাণ করে দেশে বৈষম্য কতটা প্রকট ও নির্মম। অতিরিক্ত পরিশ্রমে, অতিরিক্ত শ্রম ঘন্টায় এই মৃত্যু ঘটেছে।
আরেকদিকে, বাংলাদেশের নাম বদলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। কতিপয় ধর্মীয় রাজনৈতিক দল এ প্রস্তাবে সমর্থন ও জানাচ্ছে। জনগণও এথেকে অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাচ্ছে।
সরকারের পহেলা বৈশাখে প্রগতিবিরোধীদের কাছে সমর্পণ, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাপরাধীর স্বাক্ষীর মব ভায়োলেন্সের শিকার হওয়া, বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শ্রমিক নিষ্পেষণ আরো তীব্র হয়ে উঠার মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বস্তির কিংবা আনন্দের নয়।
প্রথম পাতা
সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীদের লাগাম টানার চেষ্টা করছে সরকার
নির্বাচন নিয়ে বিলম্ব দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে
লেনিনের একটি দিন
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এখনও শেষ হয়নি
শ্রমিকনেতা আবু তাহেরের মুক্তি দাবি সিপিবির
তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের তোষণ করছে
আশা-নিরাশার বর্ষবরণ
‘রঙ্গ’
চাল-আটাসহ বাড়তি দাম সবজির
রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের একযুগ, শ্রমিকের জীবন...
Login to comment..