কমরেড মন্মথ নাথ দে

আলি আককাছ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

মানুষ জন্মে মানুষ হয়েই। পরবর্তীতে সে হয়ে উঠে- মুসলিম, হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের। যেটি তার ইচ্ছে নিরপেক্ষ। এবং সেই ইচ্ছে নিরপেক্ষ পরিচয়টিই সে জন্মের পর থেকে শৈশব, কৈশোর, যৌবন এমনকি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বহন করে। তার পর? হ্যাঁ, তার পরেই আবার চলতে থাকে পরিবর্তন। সে যে জাতি বা জনগোষ্ঠিরই হোক সে তার নিজের মতো করে গড়ে তোলে জীবন, সবকিছু। এ বিবর্তনে কেউ বা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান বা অন্য কোনো ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে হয়ে ওঠে সকল মানুষের, মানবতার। কেউ কেউ এই মানবতার সাধনা করে হয়ে উঠেন মহামানব। তেমনই একজন মহামানব আমাদের মন্মথ নাথ দে- পাচু বাবু। জন্ম শেরপুর জেলার চর মধুয়া গ্রামে- ১৯১০ সালের ১০ ডিসেম্বর। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। এক সময় তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন এই কমিউনিস্ট নেতা তার নিরলস কাজের মধ্য দিয়েই হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি কমিউনিস্ট। মন্মথ নাথ দে জীবনের সাধনা দিয়ে হয়ে ওঠেছিলেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নেতা। হ্যাঁ, তার সাথে আমার পরিচয় সেই চারুপাঠের সময়। আমি তখন হিন্দুপাড়া প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। ৪র্থ কিংবা ৫ম শ্রেণিতেই হবে। তার নাম আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. গফুর দাদার মুখে শুনেই তার সঙ্গে কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিলাম। পরবর্তীতে কমরেড ধরনী দে’র মাধ্যমে সে কাজটি সম্পন্ন হয়। মাঝেমধ্যেই ধরনী দে তিনি নরন্দী আসলেই আমাকে খবর দিতেন। আমিও যেন এই ভাল মানুষটির ভক্ত হয়ে উঠি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন পুরোধা। সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এ পদ বহাল থাকে তার। অতঃপর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন ১৯৮০ সালে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তাকে যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তার জীবনের ২০টি বছর কাটে জেলে। এই ভাল মানুষটির ভক্ত হয়ে উঠি। আস্তে আস্তে সময় গড়াতে থাকে ’৭০ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা, ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ছিল একনিষ্ঠ ভূমিকা। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি কমরেড ধরনীদার অনুপ্রেরণায় এবং কমরেড মন্মথ নাথ দে’র দিক নির্দেশনায়। ধরনী দা বলতেন- ‘না পাকিস্তান থাকছে না’ কমরেড মন্মথ নাথ দে হাসতেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধ, দেশ স্বাধীন হলো, শুরু হলো কমিউনিস্টদের প্রকাশ্যে রাজনীতি। তখন আর মন্মথ নাথ দে’র সাথে লুকিয়ে কথা বলতে হয় না। চলতে থাকে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট রাজনীতি। তার পর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু। রাজনীতি ঝুঁকে যায় ডানে। বামদের ঘাড়ে নেমে আসে অরাজনৈতিক সামরিক সরকারদের নিপীড়ন, অত্যাচার, জুলুম। কমরেড মন্মথ নাথ দে সর্বশেষ গ্রেপ্তার হন ১৯৮৩ সালে। হায়রে কি নিয়তি, স্বাধীন দেশে আজীবন মুক্তি সংগ্রামী কমরেড মন্মথ নাথ দে’কে আবার কারাবন্দি করা হয় সামরিকদের মাধ্যমে। জেলখানায় এ মহাপুরুষ বীর মুক্তি সংগ্রামী শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের ফলে তার দুটি কিডনিই প্রায় নষ্ট হয়। ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় জেলখানা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু নির্মম অত্যাচারের ধাক্কা সামাল দিয়ে তিনি আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেননি। যে দেশটির জন্য তার সংসার করা হলো না, বিলিয়ে দিলেন তার জীবন-যৌবন- সব কিছু, সেই দেশরই সামরিক জান্তা তাকে এত বেশি অত্যাচার করলো যার জন্য জেলখানায় থাকাকালীনই তার দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। বিষণ অসুস্থ অবস্থায় জেলখানা থেকে মুক্তি পেলেন কমরেড মন্মথ নাথ দে। কিন্তু তার আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসা হলো না। ’৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে কমরেড শাহ নেওয়াজ সরিষাবাড়ি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হলে কমরেড মন্মথ নাথ দের সর্বশেষ অবস্থান হয় এমপি হোস্টেলে। যে গ্লোকোজ ফ্যাক্টরি ছিল তার প্রিয় আস্তানা সেটা ছেড়ে এমপি হোস্টেল। আমরা নিশ্চিত কমরেড মন্মথ নাথ দে আর ফিরছেন না। এমনি একদিন খবর এলো দাদা তার আদরের লিটনকে দেখতে চান। কী আর করা, ঢাকায় যাওয়ার নির্দেশ এলো। লিটন, নিয়তি বৌদি আর আমি চলে গেলাম ঢাকায় এমপি হোস্টেলে। লিটনকে কাছে পেয়ে তার সিটে বসিয়ে এতোদিনের জমানো ফাস্টফুডগুলোর প্যাকেট খুলে দিতে থাকলেন। হঠাৎ করে এ যেন মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের দেখা মিলল। আমার চোখে পানি আসলো। তার পর হঠাৎ একদিন খবর এলো কমরেড মন্মথ নাথ দে আর নেই। ১৯৮৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। দু’চোখ ছাপিয়ে জল গড়ালো, আর আমি অভিশাপ করতে থাকলাম সেই সামরিক অফিসারকে। দেবতার মতো মানুষকে যারা পিটিয়ে মারতে পারে তারা কি মানুষ? না পশু? হ্যাঁ, পশুই। যথাযথ দাহ অনুষ্ঠান চলছে ’৮৮ এর ১৯ মার্চ। জামালপুর মহাশ্মশান জনাকৃর্ণ, সবার চোখেই জল, একজনকে দেখলাম ঠিক হাজী সাহেবের পোশাকে উপস্থিত। জিজ্ঞেস করলাম আপনিও এসেছেন, ভদ্রলোক চোখ মুছতে মুছতে বললেন- না এসে পারলাম না। তার ঘটনা আমি জানি, স্ত্রীর সাথে ভুল বুঝাবুঝি এতটা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, কমরেড মন্মথ নাথ দে যদি যথাযথ বন্ধুর ন্যায় তার পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক টিকতো কি না তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। চিরকুমার লড়াকু রাজনৈতিক কমরেড মন্মথ নাথ দে এটাই ছিলেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..