কৃত্রিম মেধার জগতে ডিপসিক-এর প্রবল ধাক্কা, কেঁপে উঠল মার্কিন দৈত্যরা

প্রবীর পুরকায়স্থ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
প্রবল কম্পনের অভিঘাতে জেগে উঠে নড়েচড়ে বসেছে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির জগৎ। এই কম্পনের উৎস একেবারে নাম-না-জানা চীনের একটি সংস্থা। তারা সামনে এনেছে তাদের কৃত্রিম মেধার (এ আই বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) এ আই মডেল ডিপসিক। আর তার ধাক্কাতেই টলোমলো দশা মার্কিন এআই জগতের দানব আকৃতির সংস্থাগুলির। গত এক মাস জুড়ে মার্কিন প্রযুক্তি জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবল গুঞ্জন। এই ক্ষেত্রের মার্কিন বিনিয়োগকারীরা দেখছেন তাদের প্রথম পছন্দের সংস্থা এনভিডিয়ার সকরুণ পারফরমেন্স। চীনা সংস্থা ডিপসিকের এআই মডেল এমন গতিতে সামনে চলে এসেছে যে তাকে এআইয়ের জগতে স্পুটনিকের উত্থানের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। প্রথমে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার সঙ্গে এবং তার পর শোকে ভেঙে পড়ে বিলাপ করতে করতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রের মার্কিন বিনিয়োগকারীরা দেখলেন শেয়ার বাজারে তাঁদের প্রিয় সংস্থা এনভিডিয়ার শেয়ারের দর কীভাবে তলিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা দেখলেন ডিপসিক-এর উত্থানের দরুন মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলির শেয়ার থেকে প্রায় লক্ষ কোটি ডলার একেবারে মুছে গেল। সবচেয়ে নজর করার মতো বিষয় হল, যে এনভিডিয়া অত্যন্ত দামি গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) তৈরি করে, তাদের শেয়ারের দামই ধাক্কা খেল সবচেয়ে বেশি। একদিনে এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম পড়ে গেল প্রায় ৬০ কোটি ডলার। জিপিইউ প্রথম দিকে তৈরি করা হয়েছিল ইমেজ বা ছবি সংক্রান্ত তথ্যগুলির সমান্তরাল প্রসেসিংয়ের জন্য। সেকারণেই এর নাম গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট। কিন্তু এখন যে কোনও কম্পিউটেশনাল কাজের জন্য জিপিইউ ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার করা হয় এআই মডেল তৈরি করার জন্যও। চীনাদের তৈরি সাশ্রয়ী এই এআই মডেলটির দিকে এখন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে অন্যরা। ওপেনএআই, অ্যনথ্রপিক, গুগল, মেটার মতো মার্কিন কোম্পানিগুলি যে বিপুল খরচে তাদের এআই মডেল তৈরি করেছে, ডিপসিক সেটাই করে দেখিয়েছে তার মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ খরচে। তার চেয়েও বড়ো কথা, চীনকে আটকাতে আমেরিকা সেদেশে উন্নত চিপ রপ্তানি বন্ধ করার জন্য কঠোরতম নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এতে মদত ছিল অন্যদেরও। তা সত্ত্বেও ডিপসিক তাদের শস্তার এআই মডেল তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এআই-এর ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি পঙ্গু করে দিতে নির্দিষ্টভাবে টার্গেট করা হয়েছিল যাতে তারা উন্নত জিপিইউ পেতে এবং ব্যবহার করতে না-পারে। কারণ মনে করা হয়েছিল এআই-ক্ষেত্রে যে কোনও বড় ধরনের অগ্রগতির জন্য জিপিইউর প্রয়োজন আবশ্যিক। ওপেনএআই-এর বর্তমান গুরু স্যাম অল্টম্যান গত বছর ভারত সফরে এসে একথা বলে গিয়েছিলেন যে, এআই মডেলের যা মূল ভিত সেটা তৈরি করছে যে-সব বৃহৎ মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থা, তারা এআই ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি ঘটিয়েছে, আরও অনেক ছোটো টিমের পক্ষে কম টাকা বিনিয়োগ করে সেরকম মডেল তৈরি করার ‘কোনও রকম আশাই নেই’। এক কথায়, কম টাকায় ছোটো টিম নিয়ে উন্নত এআই মডেল তৈরির সম্ভাবনাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অল্টম্যানের সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের টেক গুরু নন্দন নিলেকানি বলেছিলেন যে, ভারতের বেসিক এআই মডেল তৈরি করার কোনও দরকারই নেই। ভারত শুধু বাজারে চালু মডেল কাজে লাগাবে। এভাবে প্রযুক্তি ক্ষেত্রের ব্যাটন তিনি কার্যত তুলে দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। তবে তাঁর মতের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন অরবিন্দ শ্রীনিবাসন। তিনি এআই সংস্থা পারপ্লেক্সিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সেই সংস্থার সিইও। স্পষ্টতই স্যাম অল্টম্যানের বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বলা যায়, কার্যত একটা জুতোর ফিতের দামের সমান খরচে শুধুমাত্র ডিপসিক তাদের মডলেই তৈরি করেনি, এই মডেল তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেই সব কোম্পানির সঙ্গে যারা এর পিছনে লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, ডিপসিক সেই হার্ডঅয়্যারও ব্যবহার করেনি যা ‘তৈরি করা’ হয়েছিল এই ধরনের অগ্রগতির রাশ টেনে ধরতে। এনভিডিয়া এইচ-৮০০ চিপ তৈরিই করেছিল বিশেষ করে চীনের বাজারের জন্য। এবং এই চিপ এমনভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল যাতে চীন এআইতে কোনও বড়ো অগ্রগতি ঘটাতে না পারে। পরে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি ক্ষেত্র একদিন হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে উঠে অবাক বিস্ময়ে দেখল এই ঐতিহাসিক সত্য যে, একগুচ্ছ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের অগ্রগতিকে থামিয়ে রাখা কঠিন। এখানে যে মডেলের কথা আমরা আলোচনা করছি তা মোটেই চ্যাটজিপিটি কিংবা ডিপসিক চ্যাটবট নয়। এই এআই মডেলগুলি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, চমৎকারভাবে বড় নিবন্ধের সারসংক্ষেপ করে দিতে পারে, এমনকি গবেষণা পেপারের সাংসংক্ষেপও তৈরি করে দিতে পারে। এসব কাজকে ধরা যেতে পারে গুগল সার্চের একটা উন্নততর সংস্করণ। ভার্চুয়ালি যদি সব ইন্টারনেট কনটেন্ট ‘ইনজেস্ট’ বা গলাধঃকরণ করানো যায়, তাহলে এমন কিছু বেশি বিষয় পড়ে থাকে না যা থেকে নতুন অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো যায় চ্যাটজিটিপির হাতিয়ারটিকে ব্যবহার করে। নতুন এই মডেলগুলি ব্যবহার করে লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল (LLMs) যেগুলি চ্যাটজিপিটি এবং এধরনের আরও অনেক মডেলের ভিত্তি, এছাড়াও ডিপসিক এআই মডেলে রয়েছে রিজনিং মডেল যা তৈরি করা হয়েছে আরও শক্তিশালী লার্নিংয়ের সাহায্যে। একথাও তর্ক হিসাবে হাজির করা হয়েছে যে, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স-এর (এজিআই) পবিত্রতম আকাক্সিক্ষত বস্তুটি হল মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রতিরূপ সেই মেশিনটি, যার নাম রিজনিং মডেল। আগে সেখানে সাফল্য অর্জন করতে হবে। যদিও স্যাম অল্টম্যান কিংবা তাঁর এআই-এর দলবল আমাদের এ-কথা বিশ্বাস করতে বলছেন যে, এজিআই-এর লক্ষ্যে পৌঁছনোও অত সোজা নয়। এখানে আমরা রিজনিং মডেলের নতুন অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছি। এবং এখানেই ডিপসিক এমন মডেল তৈরি করতে পেরেছে দৈত্যাকার মার্কিন ডিজিটাল সংস্থাগুলি যা করতে পারে তার সমান কিংবা তাদের চেয়েও বেশি। কিংবা একটা সংবাদ শিরোনামে ডিপসিক মডেল সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে, আমেরিকার এআই লাঞ্চটা কি চীনই খেয়ে নিল? প্রযুক্তি জগৎ যেখানে ধাক্কাটা খেয়েছে সেটা এই নয় যে, প্রযুক্তিক্ষেত্রে দৈত্যাকার মার্কিন সংস্থাগুলি এআইয়ের যে উন্নতি ঘটিয়েছে তাকে ধরে ফেলেছে চীন। আসল কথাটা হল মাত্র ৮০০ কোটি ডলারের কোম্পানি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যাদের আগে তেমন কোনও সাফল্য নেই তারা এই কাজটা করে ফেলেছে মার্কিন সংস্থাগুলির খরচের কয়েক ভগ্নাংশ মাত্র খরচ করে। ওপেনএআইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন এআই মডেল তৈরিতে ডিপসিকের সময় লেগেছে মাত্র দুমাস এবং খরচ হয়েছে ৬০ কোটি ডলারেরও কম টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, এই কাজটা তারা করে ফেলেছে এনভিডিয়ার চীনের বাজারের জন্য পঙ্গু করে দেওয়া এইচ-৮০০ চিপের সাহায্যে (চীনে হার্ডঅয়্যার রপ্তানির ক্ষেত্রে এমনই বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। চীনের দাবি নিয়ে যাদের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে তাদের জন্য ডিপসিক প্রকাশ্যে এনেছে তাদের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বা মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদিম যা যে কেউ নিখরচায় ব্যবহার করতে পারে। পাশাপাশি তাদের টিম ঠিক কী কী কাজ করেছে তার নথিপত্র সহ সমস্ত পেপার বিশদে প্রকাশ করে দিয়েছে। এবার তাহলে প্রশ্ন হল ডিপসিকের পিছনে কোন কোম্পানি রয়েছে? তাদের পরিচয়ই বা কী? ডিপসিকের পিছনে যারা রয়েছে, আর্থিক জগতে তাদের নাম ‘কোয়ান্টস’ (Quants)। এরকম একদল কোয়ান্টস রয়েছেন ডিপসিকের পিছনে। কোয়ান্টস বলে তাদের যারা অঙ্ক, মডেলিং ও প্রোগ্রামিং জগতের লোকজন কিন্তু কাজ করেন আর্থিক জগতে। ২০০৮ সালে এরাই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিটকে, যা বিশ্ববাজারে আবির্ভূত হয়েছিল সাবপ্রাইম সংকট হিসাবে। ২০০৮ সালে শেয়ার বাজারে বিপুল ধ্বস নামার পর কোয়ান্টসদের বাজারও দারুণভাবে পড়ে গিয়েছিল। তবে আর্থিক জগৎ এদের ছাড়া অচল। চীনে আর্থিক বাজার অনেক বেশি কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যে কোয়ান্ট ডিপসেক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি হলেন লিয়ান ওয়েংফেঙ। তিনি একটি ব্যবসায়ে ক্ষতির মুখে পড়ে ২০১২ সালে ১২০০ কোটি ডলার পুঁজির এক তৃতীয়াংশ খুইয়েছিলেন। তখন লিয়াং ঠিক করেন কিছু ডলার তিনি সরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং কোয়ান্টসদের নিয়ে নিজস্ব একটি টিম তৈরি করে এআইতে বিনিয়োগ করবেন। ঘটনা এটাও নয় যে ডিপসিক একেবারে নতুন কোনও অঙ্কের হদিশ পেয়েছে যা দিয়ে তারা এআই-এর সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। সমস্যা সমাধানে দেদার টাকা খরচ না-করে এবং যত খুশি কম্পিউটিং শক্তি কাজে লাগানোর বদলে, তারা ঠিক করেছিল বুদ্ধিমানের মতো ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজে লাগাবে যাতে দুটি নতুন মডেল গড়ে তুলে তা বাজারে ছাড়া যায়। এই দুটি মডেলকে বিশ্লেষণ করেছেন জেফ্রে ইমানুয়েল (ইনিও সকলের পরিচিত) এবং এআই-এর জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত প্রযুক্তিবিদ। তিনি লিখেছেন, ‘ডিপসিকের এআই মডেলের রয়েছে মূলত বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেওয়ার মতো পারফরমেন্স। সেই পারফরমেন্সের স্তর বিশ্বের সেরা মডেল ওপেনএআই এবং অ্যানথ্রপিকের সমান (মডেল এবং অন্যান্য ওপেন সোর্স মডেল প্লেয়ার-কে পিছনে ফেলে রেখে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ডিপসিক)। এই সব মডেলকে বলা হচ্ছে DeepSeek-V3 (জিপিটি-4o এবং ক্লড ৩.৫ সনেটের উত্তর)। এবং DeepSeek-R1 ও (ওপেনএআই এর O1 মডেলের উত্তর)। ‘আর দাম? অন্যরা এর পিছনে যত খরচ করেছে বা খরচ করবার কথা, বড়োজোর তার ৫ শতাংশ। ইমানুয়েলের আন্দাজমাফিক হিসাব হল অন্যান্য সর্বাধুনিক প্ল্যাটফর্মগুলির তুলনায় ডিপসিক ৪৫ থেকে ৫০ গুণ বেশি দক্ষ। ডিপসিক মডেলগুলি শুধুমাত্র সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়াই হয়নি, এমআইটি লাইসেন্সের আওতায় মডেলের সফটঅয়্যার বা হার্ডঅয়্যার ডিজাইনগুলি যে কোনও লোক যাতে নিখরচায় কাজ লাগাতে পারে (ওপেন সোর্সড মডেল) সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এই মডেলের গুরত্ব কতটা তা দেখা যাবে GitHub-G। ডিপসিক একইসঙ্গে দুটি বিস্তারিত টেকনিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বুঝিয়ে বলা হয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপে তারা কী কী করেছে। সুতরাং, এই সব মডেল, সেগুলির পিছনে থাকা তত্ত্ব, কীভাবে তারা সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধানগুলি করেছে, সব কিছুই এমনভাবে লেখা রয়েছে যে ডিপসিক যা কিছু করেছে সাধারণ লোকেরা শুধুমাত্র তা খুঁটিয়ে দেখতে এবং ব্যবহার করতেই পারবে না, বরং সেগুলির পুরুৎপাদন করে তাদের সার্ভারে চালাতে পারবে। ডিপসিক বাজারকে যে রাম ধাক্কা দিয়েছে ডিজিটাল জগতে তার তিনটি বড়ো ধরনের তাৎপর্য রয়েছে। এর মধ্যে একটা হল এনভিডিয়া। এই সংস্থাই এআই বাজার ফুলেফেঁপে ওঠার লাভ সবচেয়ে বেশি ঘরে তুলেছে। ডিপসিক বাজারে চলে আসায় এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম এখন কমছে। এই কমাটা এখনই স্পষ্ট। দ্বিতীয় তাৎপর্য হল, এখন আরও অনেক সংস্থা এআই-এর প্রতিযোগিতার দৌড়ে নেমে পড়তে ইচ্ছুক। কারণ তারা জেনে গেছে যে, এআই-এর বাজারে ঢোকাটা ঠিক ততটা চড়া দামের নয় যা মার্কিন বৃহৎ কোম্পানিগুলি তাদের বুঝিয়েছিল। সর্ববৃহৎ সংস্থাগুলিই যে প্রতিযোগিতায় জিতবে এর কোনও মানে নেই। প্রাণী জগতের বিবর্তনেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল! তৃতীয় ও শেষ তাৎপর্য হল, নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রযুক্তিকে আটকানো যায় না। পারমাণবিক ও মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে ভারতকেও আটকে রাখা যায়নি। একই ভাবে এআইয়ের জগতে চীনের উন্নতিকেও ঠেকিয়ে রাখা গেল না। এখানেই সব শেষ নয়। এআইয়ের ক্ষেত্রে যদি কম্পিউটিং ক্ষমতাকে বাড়িয়ে চলাটাই মডেল উন্নত করার একমাত্র পথ এবং তার ফলে বাজারে সুবিধা পাওয়ার শেষ কথা না-হয়, তাহলে এআই শিল্প এখন যে বিশালাকার ডেটা সেন্টার তৈরি করার কথা ভাবছে তার আর দরকার হবে কি? মাইক্রোপ্রসেসরের উন্নতি এবং তার জেরে পার্সোনাল কম্পিউটারে বিপ্লবের কথা অনেকেরই মনে আছে। তাহলে ডিপসিক মুহূর্ত এআই-এর জগৎকে তেমনই একটা ধাক্কা দেবে? মনে করুন আইবিএমের সময়কার কথা। তখন আইবিএম মেশিন রাখার জন্য বিশাল বিশাল সব ঘর বানানো হয়েছিল। সেগুলিই ছিল কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে অগ্রগতির হলমার্ক। ঠিক একই প্রত্যাশায় ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট পদের দ্বিতীয় দিনেই ঘোষণা করেছিলেন যে, ওপেনএআই- এর স্টারগেট প্রকল্পের জন্য তিনি ৫০০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করছেন। এমনটা ঘোষণার আগে তিনি ভেবেছিলেন যে, এআইয়ের জন্য বিপুল সংখ্যায় ডেটা সেন্টারের দরকার পড়বে যেখানে শক্তিশালী জিপিইউ-এর বড়ো বড়ো সব ইউনিট সাজিয়ে রাখা হবে। এবং এই টাকার প্রায় পুরোটাই বরাদ্দ করা হয়েছিল এনভিডিয়ার জন্য। এর ফলে সামনে এসেছিল যে প্রশ্ন তা হল, ওই সব শক্তিশালী জিপিইউগুলো কোন শক্তিতে চালানো হবে। কারণ ডেটা সেন্টারগুলি নিজেদের চালু রাখতে মাতালের মতো বিপুল পরিমাণ এনার্জি বা শক্তি গলাধঃকরণ করবে। ট্রাম্প বলেছিলেন তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনার নাম হবে ‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল।’ এবং যতিচিহ্নহীনভাবে ডেটা সেন্টারগুলিকে সচল রাখবে প্রাকৃতিক গ্যাস। এভাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হলে নিশ্চিতভাবেই আমেরিকা আরও বেশি গ্রিন হাউজ গ্যাসের (জিএইচজি) নিঃসরণ বাড়াবে। ডিপসিকের কারণে আমেরিকার এখন আর তত বেশি প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে না। ফলে আমেরিকায় এখন প্রাকৃতিক গ্যাসের পক্ষে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুচালিত বিদ্যুতের সঙ্গে বাজারের প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা কঠিন। কারণ এগুলির উৎপাদনের খরচ কমে গিয়েছে এবং সেই খরচ ক্রমে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের খরচের চেয়েও অনেক কমে যাবে। তাই বৃহৎ-এরাই অন্যদের তুলনায় সেরা, এই ধারণাটাকেই ডিপসিক স্রেফ ছক্কা হাঁকিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। এবং একইসঙ্গে আমেরিকায় আরও বেশি, আরও দ্রুত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বিপদকেও কমিয়ে ফেলেছে। এক বিখ্যাত দার্শনিক একদা বলেছিলেন: ‘দশকের পর দশক চলে যায় যখন কিছুই ঘটে না। আবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটে যায় যা কয়েক দশক জুড়ে ঘটার কথা।’ অন্তত এআইয়ের জগতে তেমন মুহূর্তগুলিই এসে হাজির হয়েছে বলে মনে হয়। সূত্র : পিপলস ডেমোক্রেসি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..