ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা : চীনের দৃষ্টিতে

ওয়াং ওয়েন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা সকল দেশের জন্য অমঙ্গল না-ও ডেকে আনতে পারে, বিশেষ করে চীনের ক্ষেত্রে। চীনের একাধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মতে, ট্রাম্পের নীতিমালা অজান্তেই চীনকে শক্তি জোগাতে পারে। সে জন্যেই তার একটি জনপ্রিয় ডাকনাম জুটেছে, ‘চুয়ান জিয়ানগুয়ো’ যার অর্থ ‘চীনকে আবার মহান করো’। ট্রাম্পের প্রথম দফা অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে চীনের উত্থানে অবদান রেখেছিল : প্রথমত, তার প্রথম রাষ্ট্রপতিত্ব রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সামজিক বিভাজনকে উন্মোচিত করে বহু চীনা নাগরিকদের চোখে আদর্শ গণতন্ত্রের যে ভাবমূর্তি ছিল তা ধূলিস্যাৎ করেছিল। কয়েক দশক ধরে চীনের নাগরিকদের একটা অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আদর্শ জ্ঞান করে মনে করত যে, ওই দেশটি সত্যিই একটি ‘অপরূপ দেশ’, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনা নামের আক্ষরিক অনুবাদ। কিন্তু ট্রাম্পের কার্যাবলী, যাকে অনেকে বলেন একটি ‘রাজনৈতিক শিক্ষা’- তার মধ্য দিয়ে প্রচলিত ধারণায় বদল এনে চীনের স্থিতিশীলতা ও শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প চীনকে প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার পথে চালিত করেছেন। দু’ দশক বা তার চেয়ে আরেকটু আগেকার সময়পর্বে চীন প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহ দিতে শুরু করে, যদিও অনেকে মনে করতেন যে এই ক্ষেত্রে কোনো দেশ-বিদেশের সীমারেখা করা হয় না। কিন্তু ২০১৮ সালে হুয়ায়েই সংস্থার মুখ্য অর্থনৈতিক আধিকারিক মেং ওয়ানঝৌয়ের গ্রেফতারি এবং চীনা কারিগরি সংস্থাগুলির উপর দমনপীড়ন নামিয়ে না আসা অবধি দেশ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে পূর্ণ মনোনিবেশ করেনি। ২০২৪ নাগাদই চীন সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে সাফল্যসহ প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে ফেলল। এই পথ বদলের ফলাফলে ২০২৪ সালে ১৫৯ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি চিপ রপ্তানির মত একটি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হল যা ২০১৮-র দ্বিগুণ। তৃতীয়ত, চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্রুত পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে চীনা জনগোষ্ঠীর আরও বৃহত্তর অংশের মধ্যে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে যে, পৃথিবীটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও আরো বড়ো একটি সত্তা। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে চীন এখন দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির সাথে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে। ২০১৮-২০২৪ সময়পর্বে এই দেশগুলির সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি ঘটেছে ৪০% হারে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যক্ষেত্রের নির্ভরতা ১৭% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১%-এ। বিগত সময়ের তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে, চীনকে আটকে রাখার জন্য ট্রাম্পের প্রথম দফা ও বাইডেনের নীতিসমূহের চূড়ান্ত ফলাফলে চীনই বিগত ৮ বছরে মাঝারি হারে আরও শক্তিশালী হয়েছে। সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিতে, চীন ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা মোকাবিলা করার জন্যে ইতিমধ্যেই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ইউরোপ ও কানাডার ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সাপেক্ষে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রত্যাবর্তন নিয়ে চীনের সংবাদ মাধ্যম ও চিন্তাশীল মানুষেরা অনেকটাই শান্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের প্রথম দফার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং প্রযুক্তিক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাকে সফলভাবে সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতার জেরে সম্ভবত চীন অনেকটাই নিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। ২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প তিব্বতের ডিংরি অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করেছে, আর ওদিকে এক বিশাল দাবানল গ্রাস করেছে লস এঞ্জেলেস অঞ্চলকে। তিব্বতে চীন সরকার দ্রুততার সাথে দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী মোতায়েন করে ৫০,০০০ মানুষকে একদিনের মধ্যে স্থানান্তরিত করেছে। ওদিকে লস এঞ্জেলেসে রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অব্যবস্থার জেরে শোচনীয় রূপ ধারণ করে ১০ দিন ধরে দাবানল সবকিছু ভস্মীভূত করে গেছে। ভূমিকম্প পরিস্থিতির মোকাবিলায় উদ্ধারকার্য থেকে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে চীনের তৎপরতার ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে লস এঞ্জেলেসে প্রলম্বিত দাবানলের জেরে ধ্বংসের মাত্রা ৯/১১-র আক্রমণকেও ছাপিয়ে যাওয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক দোষারোপের খেয়োখেয়ি। এই বিপরীতধর্মী তৎপরতাই স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাগুলিকে। অ-পশ্চিমী দেশগুলির অধিকাংশ এখনও তুলনায় শান্ত, ট্রাম্পের ধরনের নয়া ফ্যাসিবাদ আটলান্টিকের অন্য পারে, বিশেষ করে ইউরোপ ও কানাডায় বিভীষিকা ছড়াচ্ছে। বিশ্ব কূটনীতির উচ্চতম স্তরে এখন প্রশ্ন উঠছে : ডেনমার্ক কি গ্রিনল্যান্ডের ওপর তার অধিকার হারাবে? ন্যাটো কি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাবে না? কানাডা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১-তম রাজ্যে পরিণত হবে? এক সময়ে যেগুলিকে বিদঘুটে ধারণা মনে করা হত এখন সেগুলিই প্রকাশ্যে আলোচিত হচ্ছে। চীনে অনেকেরই ধারণা, ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার আন্তর্জাতিক প্রভাব ট্রাম্পের প্রথম দফাকে ছাপিয়ে যেতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে অ-পশ্চিমী দেশগুলির অনেকেই মনে করছে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা মূলত তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়েই বেশি কেন্দ্রীভূত হবে আর মাঝেমধ্যে অস্থিরতা তৈরি করবে পশ্চিমী মিত্রদের মধ্যে। অ-পশ্চিমী পর্যবেক্ষকরা জানেন যে, ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষকে রাতারাতি শেষ করবেন না। প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল বিবাদেরও সত্ত্বর কোনও সমাধান করতে যাবেন না। ৬০% কর চাপিয়েও ট্রাম্প পারবেন না চীনের দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য বৃদ্ধিকে রুখতে। তিনি করবেন না এবং করতে পারবেনও না, চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থানকে রুখতে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় পরিবেশ সমঝোতা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ নানা সমঝোতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আসা চালিয়েই যাবে। ফলাফল কী হবে? মার্কিন আবিশ্ব আধিপত্য ভাঙতে শুরু হবে। এই ধারা বজায় থাকলে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে হয়ে আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে। বাণিজ্য যুদ্ধ, প্রযুক্তিগত সংঘাত বা চুক্তি প্রত্যাহার- ট্রাম্পের এই নীতিগুলির ফলে যাই হোক না কেন, চীন নিকৃষ্টতম পরিস্থিতির জন্যেও প্রস্তুত হয়েই আছে। অতীতের মতই প্রত্যাহ্বানকে সুযোগে পরিণত করার মত শক্তি চীনের রয়েছে। ২০২৮ এলে, চীনের মানুষ আরো আত্মবিশ্বাসের নিয়ে বলবে, ‘ধন্যবাদ, ট্রাম্প’। ওয়াং ওয়েন চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চোংইয়াং অর্থনীতি বিদ্যা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ এবং চীন-মার্কিন মানববিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা বিনিময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। চীনের পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ের বিশিষ্ট লেখক। সূত্র : পিপলস ডেসপ্যাচ সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..