বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : সমস্যা ও করণীয়

নজরুল ইসলাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
[এই প্রবন্ধটি আকারে বৃহৎ হওয়ায় এর পরিলক্ষণসমূহ বাদ দিয়ে আমরা শুধু ইস্যুসমূহের তালিকা এবং সেসব ক্ষেত্রে করণীয় প্রস্তাবগুলি তুলে ধরছি- সম্পাদক।] ভারতের সাথে সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ তিনদিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন দ্বারা এই দুই দেশ আবদ্ধ। তবে ভারতের সাথে সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য বরাবরই একটি স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে থেকে গিয়েছে। একদিকে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনের জন্য ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতা; অন্যদিকে রয়েছে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য কায়েমের সম্ভাবনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে বিভিন্ন সমস্যা। নিচে প্রথমে ‘পরিলক্ষণ’ অংশে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক এবং তাতে পরিদৃষ্ট সমস্যাবলী তুলে ধরা হলো এবং তারপর ‘করণীয়’ অংশে সেসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আলোচনা করা হলো। সবশেষে একটি সংক্ষেপিত উপসংহার পরিবেশিত হলো। ইস্যুসমূহ ১। বাণিজ্য, ঋণ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি; ২। নদনদী পানি প্রবাহ ভারত কর্তৃক সৃষ্ট অসুবিধাসমূহ; ৩। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহার, ইত্যাদি চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের তুলনামূলক সুবিধা বেশি ও আমাদের অর্জন কম; ৪। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল- কোরিয়া, জাপান ও ভারতের জন্য বরাদ্দ; ৫। সীমান্ত সমস্যা; ৬। ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু; ৭। অন্যান্য ইস্যু। এই ইস্যুগুলির ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমরা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বা অন্ধ ভারতবিরোধিতার কৌশল যুদ্ধ বাদ দিয়ে যেভাবে যৌক্তিক দর কষাকষির মাধ্যমে অগ্রসর হতে পারি সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাব ক্ষেত্র অনুযায়ী তুলে ধরা হলো। প্রস্তাবিত করণীয়সমূহ ১। বাণিজ্য ও ঋণ, ইত্যাদি ভারতের সাথে বাণিজ্য এবং চলতি হিসাবে বাংলাদেশের ঘাটতি থাকা মানে এই নয় যে, ভারত বাংলাদেশকে শোষণ করছে। যেমন- ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানির মোট পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে সাথে বাণিজ্যে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত ছিল ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শোষণ করছে! সাধারণভাবে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের উপর আমদানি চাপিয়ে দিচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার একটি বড় উদাহরণ হলো বিদ্যুৎ। বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ এমন একটি ভ্রান্ত বিদ্যুৎনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ করে যার অধীনে মোট বিদ্যুতে (মূলত ভারত থেকে) আমদানিকৃত বিদ্যুতের অংশ ২০১৬ সালের ৫ শতাংশ থেকে ২০৪১ সালে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। তদুপরি, যে ধরনের চুক্তির অধীনে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনা সাব্যস্ত তা জাতীয় স্বার্থের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যেমন, একদিকে বিদ্যুতের দাম অত্যন্ত বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এবং অন্যদিকে বিদ্যুতের প্রয়োজন না হলেও অর্থ পরিশোধ করার বিধান রাখা হয়। সুতরাং, এসব চুক্তি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে এবং বিদ্যুৎ নীতি পরিবর্তন করতে হবে। একইভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের আপেক্ষিক সুবিধা থাকার কথা। কাজেই বাংলাদেশকে কেন ভারত থেকে কৃষিপণ্য আমদানি করতে হবে সেটাও বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের বহু কিছু করণীয় আছে। একইভাবে ভারত প্রদত্ত বিভিন্ন ঋণের অধীন প্রকল্পসমূহ একদিকে ভারতের স্বার্থ-অভিমুখী, অন্যদিকে তাতে ভারত থেকে আমদানীর বাধ্যবাধকতা থাকে। কাজেই ভারতের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ এবং ঋণের শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অনেক কিছু করণীয় আছে। শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য যাতে বাংলাদেশিদের ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে যেতে না হয় সেজন্য দেশের শিক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন আরেকটি বড় করণীয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন দেশের তৈরি পোশাক ও অন্যান্য শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ভারতীয়র পরিবর্তে বাংলাদেশিদের অধিক হারে নিয়োগ বৃদ্ধি করবে এবং তা দেশের বাণিজ্য এবং চলতি হিসাবে ঘাটতি হ্রাসে সহায়ক হবে। ২। নদনদী নদনদী বিষয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যে রূপ অন্যায্য আচরণ করছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন। নদনদী বিষয়ে বিগত সরকার মূলত ভারতের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু ভারত কোন সদিচ্ছা না দেখিয়ে কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করেছে। ১৯৯৬ সালে সাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তিকে বিগত সরকার একটি বিরাট সাফল্য হিসেবে প্রচার করেছে। কিন্তু বাস্তবে এই চুক্তির ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে গঙ্গা প্রবাহের কোনো বৃদ্ধি ঘটেনি। তিস্তা নিয়ে ভারত বাংলাদেশের বিগত সরকারকে কেবলই একটা চুক্তির আশার পেছনে দৌড় করিয়েছে। কিন্তু কোনো চুক্তি হয় নি; এবং তিস্তার উজানে আরও ১৫টি বাঁধ নির্মাণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে এসব বাঁধ বাংলাদেশে হড়কা বন্যা বৃদ্ধি করেছে। কাজেই সদিচ্ছা নয়, স্বার্থের ভিত্তিতে ভারতের সাথে নদনদী নিয়ে লেনদেন করতে হবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক নদনদী বিষয়ে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সনের সনদ স্বাক্ষর করতে হবে এবং ভাটির দেশকে এই সনদ যেসব সুরক্ষা প্রদান করে তা ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিনিময়ে কিছু না পেয়ে ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, এবং বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা একটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ নামক যে প্রস্তাব এবং দাবী উত্থাপন করা হয়েছে, তার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা প্রয়োজন। র্যা ডক্লিফ সীমান্তের কারণে নদীপ্রবাহের জন্য ভারতের উপর বাংলাদেশকর্ম নির্ভর করতে হয়; আবার এই র্যা ডক্লিফ সীমান্তের কারণেই ট্রানজিট ও বন্দরের জন্য বাংলাদেশের উপর ভারতকে নির্ভর করতে হয়। কাজেই এই দুই সুবিধার বিনিময় হতে পারে। ভারত নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে উন্মোচিত করতে পারে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দরের সুবিধা দিতে পারে। তৃতীয়ত, নদনদী বিষয়ে বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক পন্থা থেকে প্রকৃতিসম্মত পন্থায় উত্তরণ করতে হবে। যেখানে বাণিজ্যিক পন্থা নদনদীর পানিকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে শুষে নিঃশেষিত করায় প্রবুদ্ধ করে, সেখানে প্রকৃতিসম্মত পন্থা নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রাখায় উৎসাহিত করে। প্রকৃতিসম্মত পন্থা অবলম্বন করলে বাংলাদেশ ভারতকে নদনদীসমূহকে উন্মুক্ত করার দাবী আরও জোরালোভাবে জানাতে পারবে এবং ভারতে যারা এই অবস্থান থেকে ফারাক্কা বাঁধসহ অন্যান্য বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে তাদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশের সুযোগ করে দিবে। সংক্ষেপে, প্রচলিত বাণিজ্যিক পন্থাভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতের কাছ থেকে নদনদী বিষয়ক অধিকার অর্জনের সুযোগ কম। সেজন্য উপযুক্ত তিনটি ধারায় পদক্ষেপ নিতে হবে। ৩। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহার, ইত্যাদি আগেই উল্লেখিত হয়েছে, বিনিময়ে কিছু না পেয়ে ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, এবং বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হয়েছে। তবে একবার দিয়ে দেওয়া হলেও এসব সুযোগ যে প্রত্যাহার করা যাবে না তা নয়। সুতরাং, নদী এবং ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশকে ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলার কথা ভাবতে হবে। এছাড়া অভিন্ন নদনদীর প্রবাহ আরও হারানো রোধ কিংবা ইতোমধ্যে হারানো প্রবাহ ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা কঠিন। ৪। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের জন্যও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ জোন (EPZ) গড়ার অনুমতি দিয়েছে। সেলক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে বাংলাদেশ প্রাইভেট EPZ আইন অনুমোদন করে। এই আইনের অধীনে বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল গড়ে ওঠে, তারমধ্যে একটি হলো চট্টগ্রামে অবস্থিত ২৪৯২ একরের কোরিয়ান ঊচত, যেটা কোরিয়ান ণড়ঁহমড়হব কোম্পানির একটি সাবসিডিয়ারি এবং কোরিয়ান ঊচত কর্পোরেশন (ইউ) লিমিটেড বলে নিবন্ধিত। আরেকটি উদাহরণ হলো জাপানী কোম্পানিসমূহের জন্য নির্ধারিত প্রায় ১০০০ একর সম্বলিত নারায়ণগঞ্জ জেলার ‘আড়াইহাজার অর্থনৈতিক অঞ্চল’। বাংলাদেশকে প্রদত্ত জাপানি উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা ‘জাইকা’র ঋণের অধীনে জাপানের সুমিমোতো কোম্পানি এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। সুতরাং, বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন একেবারে ব্যতিক্রম কিছু নয়। যেটা বিবেচ্য তা হলো, এই অনুমোদনের শর্তাবলী বাংলাদেশের স্বার্থানুনোগ কিনা। প্রতিটি অঞ্চলেরই স্বকীয়তা রয়েছে এবং সেগুলো ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কোরিয়ান এবং জাপানীদের জন্য অনুমোদিত রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের শর্তাদি একটি তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ৫। সীমান্ত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া খুব সভ্য রীতি নয়। সীমান্তে এরূপ বেড়া দেওয়ার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের প্রতি এক ধরনের অসম্মান প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে ভারতের বক্তব্য হলো, বেড়ার অনুপস্থিতিতে ভারতে বাংলাদেশীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটে। একটা সময় ছিল যখন ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তখন এটা বলা সম্ভব ছিল যে, সমৃদ্ধতর জীবনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের নাগরিকেরা ভারতে অবৈধভাবে অভিগমন করছেন। এখন পরিস্থিতি সেরূপ নয়। বস্তুত ২০২২ সালের আগে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশী ছিল। সম্প্রতি ভারতের প্রবৃদ্ধি হার বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পাওয়ায় ২০২৪ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় (২,৭৩১ ডলার) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের (২,৬৪৬ ডলারের) চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু স্পষ্টতই, এই পার্থক্য এমন বেশী নয় যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের মরনপণ হয়ে অবৈধভাবে ভারতে অভিগমন করতে হবে। চোরাচালান রোধের যুক্তিও তেমন শক্তিশালী নয়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাসঙ্গিক পণ্যের সীমান্ত মূল্য এমন পর্যায়ে আনা যায় যাতে বৈধ বাণিজ্যের চেয়ে অবৈধ বাণিজ্য (চোরাচালান) বেশি আকর্ষণীয় না হয়। এটাই চোরাচালান রোধের উৎকৃষ্ট পন্থা। দ্বিতীয়ত, পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য দেখায় যে, যেখানে দুই দেশের পণ্যের সীমান্ত মূল্যের ব্যবধান বেশি সেখানে কাঁটাতারের বেড়া চোরাচালান রোধ করতে পারে না, বরং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি উভয়ের সদস্যরাই চোরাচালানের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। সীমান্তের যে অংশে কাঁটাতারের বেড়া ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে, সেখানে তা নিকট ভবিষ্যতে বিরাজমান থাকবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে এসব এলাকায় যাতে বাংলাদেশ অভিমুখে সারারাত ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে রাখা ইত্যাদি উপায়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবন এবং জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। সম্প্রতি ভারত সরকার তার নাগরিকদের নিবন্ধন অভিযান শুরু করেছে। ভারতের বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের অভিমত অনুযায়ী এই অভিযানের উদ্দেশ্য হলো ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের শণাক্ত করা এবং তাদেরকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো (অপারেশন পুশব্যাক)। এমনকি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগে, যখন এক পর্যায়ে পূর্ব-বাংলা (বর্তমানের বাংলাদেশ) এবং আসামের সমবায়ে একটি অভিন্ন প্রদেশ ছিল, তখন যারা বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়েছেন তাদেরকেও এই অপারেশন পুশব্যাকের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, ভারতের এই আচরণ একাধিক কারণে অগ্রহণযোগ্য। প্রথমত, যারা বহুকাল ধরে আসামে বসবাস করছেন তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সে এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের ন্যায্য অধিকার লাভ করেন। দ্বিতীয়ত, অভিবাসনের এই অধিকারের ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ এক ধরনের বর্ণবাদ, যা আধুনিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই বাংলাদেশকে ভারতের এই ‘পুশব্যাকে’র উদ্দেশ্যে পরিচালিত নিবন্ধন কর্মসূচির জোরালো বিরোধিতা করতে হবে। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর আমানবিক এবং আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিবিরুদ্ধ সহিংস আচরণ বন্ধ করতে হবে। ফেলানীকে হত্যা এবং কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার যে চরম অমানবিক আচরণ বিএসএফের সদস্যরা করেছে তা যথাযথ তদন্ত করে দোষীদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তা নিতে হবে। সীমান্ত সংক্রান্ত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রায় এক শতাব্দিকাল ঝুলিয়ে রাখার ফলে যেসব অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটেছে ভারতকে তার দায় স্বীকার করতে হবে এবং সীমান্ত চিহ্নিত করার জন্য বাকি যেসব পদক্ষেপের প্রয়োজন তা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। ৬। ভূ-রাজনীতির প্রভাব বাংলাদেশকে ভূ-রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে থাকতে হবে। একটি স্বল্পআয়ী উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশকে যে দেশের সাথে যেরকম সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন সেটাই করতে হবে। এক্ষেত্রে “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়” এই নীতি অনুসরণ করাই শ্রেয় হবে। তবে এই নীতি অনুসরণে সফল হতে হলে নিম্নরূপ দুটি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, এই নীতি প্রয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। অর্থাৎ, কী কারণে কোন দেশের সাথে কী সম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে তা ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রতিযোগী সকল দেশের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের মানুষকে আস্থায় নিতে হবে। অর্থাৎ, নিজ দেশের নাগরিকদের নিকটও এসব বিষয় সততার সাথে তুলে ধরতে এবং ব্যাখ্যা করতে হবে। এতে দুটি লাভ হবে। প্রথমত, গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তের প্রতি জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে এই নীতি প্রত্যাশিত ফল না দিতে পারে তাহলেও জনগণ বিরূপ হবে না। ৭। অন্যান্য ইস্যু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অন্যান্য ইস্যু নিরসনেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব ইস্যুর কিছু বৃহৎ অর্থে সেবা-বাণিজ্যের মধ্যে পড়ে। যেমন, দুই দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের অভিগম্যতার ক্ষেত্রে সমতার ইস্যু। এ ধরনের যেকোনো ইস্যু নিরসনের নীতিভিত্তি হবে ন্যায্যতা। নিঃসন্দেহে কোন সমাধান বেশি ন্যায্য সে বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালত কিংবা মধ্যস্থতাকারীর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত কিছু ভাল দৃষ্টান্ত রেখেছে, যেমন সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ নিরসনের বিষয়টি জাতিসংঘের ‘সমুদ্র আইন বিষয়ক সনদ’ (United Nations Convention on the Lwa of the Sea (UNCLOS))-এর ভিত্তিতে Permanent Court of Arbitration-এর মাধ্যমে সমাধান অর্জিত হয়েছে। তেমনি ভারত এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদী-বিষয়ক জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদ সাক্ষর করে এবং এই সনদের ভিত্তিতে উপযুক্ত স্থায়ী আদালতের মাধ্যমে নিরসন অর্জনে সচেষ্ট হতে পারে। উপসংহার বাংলাদেশ ও ভারত ভৌগলিক অবস্থান এবং অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতি দ্বারা আবদ্ধ। এই বন্ধন পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। কাজেই দুই দেশেরই প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে এমন সম্পর্ক স্থাপন যাতে সর্বোচ্চ পরিমাণে পারস্পরিক সুবিধা লাভ করা যায়। সেজন্য বহুমুখী তৎপরতার প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, যে নদনদী আজ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে একটি কাঁটা হিসেবে কাজ করছে, জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদের অনুসারে আচরণ করলে এই নদনদীই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের রাখীবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে। উভয় দেশেরই প্রয়োজন এ ধরনের সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া লেখক : অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..