লড়াই-গৌরব-অর্জনের ৭৭ বছর

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
৬ মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মদিন বা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আজ থেকে ৭৭ বছর আগে (১৯৪৮-২০২৫) তদানীন্তন পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালের ৬ই মার্চকে আমরা আমাদের পার্টির জন্মদিন হিসাবে পালন করে থাকি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে পাকিস্তানে জন্ম নিয়ে আমাদের এই পার্টি পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই সর্বদা স্থবীর হয়ে বসে ছিল। যেমন আরো পেছনে গেলে কেউ বলতে পারেন যে পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার আগেই ভারত-উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। সে অর্থে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গর্ভেই ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। আবার পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির গর্ভে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা হয়ে প্রাদেশিক আকারে আবির্ভূত হয়েছিল এটাও সত্য। আবার সেখানেও সেই পার্টি থেমে থাকেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে সেই প্রাদেশিক পার্টিই পুনরায় ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে’ পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে এ ধরনের উৎক্রমণ হয়েছে। তাই বলে একে আমরা প্রথম জন্ম, দ্বিতীয় জন্ম এভাবে দেখি না! তাই সাধারণভাবে এ অঞ্চলের পার্টিকে ‘পূর্ব বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ’ এই ভৌগলিক অঞ্চলের পার্টি হিসাবেই তুলে ধরা হয়ে থাকে। এখন অবশ্য আমরা ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ এই নামেই সর্বত্র পরিচিত। যদিও আমাদের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে- পাকিস্তানে। আমাদের পরবর্তী ৭৭ বছরের পথ পরিক্রমায় ‘অর্জন ও গৌরবগুলি’ চিহ্নিত করতে হলে আমাদের ‘পূর্ব পাকিস্তানের (১৯৪৭-১৯৭১) ২৪ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস’ এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘৫২ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের’ দিকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা যদি নির্মোহভাবে দীর্ঘমেয়াদী বিচার করে আমাদের গৌরব-সাফল্য-অর্জন ইত্যাদি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে এই ৭৭ বছরের ইতিহাস আপদে-বিপদে, অর্জনে-বিসর্জনে, গৌরবে-অগৌরবে, ব্যর্থতায়-সাফল্যে ভরপুর এক দ্বান্দ্বিক ইতিহাস। এখানে শুধুই গৌরব-সাফল্য-অর্জন ছিল তা বলাটা একটু একপেশে হয়ে যাবে। তবে আজ জন্মদিনে আমরা বিশেষভাবে উদযাপন করবো আমাদের গৌরব ও সাফল্যগুলিকে, চিহ্নিত করবো প্রধান ব্যর্থতাকে, প্রতিজ্ঞা করবো সামনে ব্যর্থতার জেরগুলি কাটিয়ে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। এই ৭৭ বছরে আমাদের পার্টির অন্যতম প্রধান সাফল্যের দিক হচ্ছে পাকিস্তান আমলে অত্যন্ত কঠোর নিপীড়নের মধ্যে থেকেও আমরা জাতীয় রাজনীতির মৌলিক কর্তব্যগুলি থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন হইনি। ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও সর্বশেষ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্রই আমাদের ভূমিকা ছিল গৌরবময় ও ইতিবাচক। আমরা অন্য বামদের মতো টুকরো টুকরো হয়ে খণ্ডিত আকারে চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেই নি। বরঞ্চ আমরা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে নিজস্ব স্বতন্ত্র বাহিনী স্বত্ত্বা বজায় রেখে গণযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনে মূল্যবান ভূমিকা রেখেছি। এই দিক থেকে দেখলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ভূমিকা ছিল সত্যিই গৌরবময় তবে আমাদের পক্ষে ভিয়েতনাম বা চীনের পার্টির মত মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্ব প্রদান সম্ভব হয়নি। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম। প্রগতির একটি ধারা শুরুও হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃত্বে বা আমাদের তদানীন্তন মিত্র জোটের মাধ্যমে আমরা আমাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে সামনে এগিয়ে নিতে পারিনি। প্রগতির ধারা উল্টে যায় ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। দক্ষিণমুখী যাত্রা শুরু হয়। এই ব্যর্থতাও আমাদের স্বীকার করতে হবে। তবে এরপর সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের অনেক গৌরবজনক ভূমিকার কথা বর্তমানে অনেকেই স্বীকার করেন। আমরা জানি, বিশেষ করে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সকল শ্রমিক সংগঠন সমন্বয়ে স্কপ গঠন এবং কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন করে কমিউনিস্ট পার্টির দ্রুত প্রসার ঘটেছিল এবং পার্টির মূল নেতারা জাতীয় নেতার আসনে আসীন হতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও এবারো পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্টরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা দখলকারী পার্টিতে পরিণত হতে পারেনি। তবে জাতীয় রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হতে আমরা পেরেছিলাম। ৯০ দশকে বিশ্ব সমাজতন্ত্রেও বিপর্যয় হলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপরেও তার প্রতিকূল প্রভাব এসে পরে। পার্টি থেকে একাংশ বের হয়ে যান। তারপরেও কমিউনিস্ট পার্টি তার সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। নতুনভাবে বাংলাদেশে দ্বি-দলীয় মেরুকরণের পরিবর্তে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে পার্টি। দুই বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কিছুদিন পালাক্রমে সরকার বদল চলতে থাকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল একক বুর্জোয়া দল অওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ক্রোনী ক্যাপিটালিজম। ২০২৪ সালে আগষ্ট মাসে রক্তাক্ত গন-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার অবসান হয়। কিন্তু এর ফলে কোন বিপ্লব বা রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। এই আগস্ট অভ্যুত্থানে পার্টি ও বামজোটের কর্মীরা নানাভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও এতে নেতৃত্ব দিতে পারে নি। বর্তমানে বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলির মধ্যে এখন পর্যন্ত আমাদের শক্তি-সামর্থ্য অনেক কমে যাওয়ার পরেও আমরাই সর্ববৃহৎ। কিন্তু আমরা এও জানি যে আমাদের বিপ্লবী ঐক্য, গুণ ও মানের অনেক অবনতি হয়েছে। তবু এখনো দেশের বামশক্তি আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তাই এই জন্মদিনে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে আমাদের গৌরবজনক ঐতিহাসিক কালপর্বগুলি থেকে। একটি গৌরবময় পর্ব আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আরেকটি আমাদের এরশাদবিরোধী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর্ব। এই দুই পর্বে সংগ্রাম থেকে শক্তি, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনের দিকে আমাদের তরুন প্রজন্মেও কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে আদর্শ উপহার দেয় তা হচ্ছে আমাদের ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা। আমরা বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে ধারণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কোনো সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী প্রভুত¦কে মেনে নেইনি–ভবিষ্যতেও নিব না। কারো কাছে আমরা নতজানু হব না। আমাদের পার্টি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সজাগ থাকবে। আর আমরা ৯০-এর ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা নিব যে শহরের শ্রমিক ও গ্রামীণ সর্বহারাকে পার্টিতে সংগঠিত করতে হবে। যদি আমরা তা না পারি তাহলে পেটি-বুর্জোয়া-বুর্জোয়া নেতৃত্বের হাতে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার স্বার্থ-ও নিরাপদ থাকবে না। এমনকি সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিও তাদের হাতে নিরাপদ নয়। ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা ও সাম্প্রদায়িকতার ভূতও তারা তাড়াতে পারছে না। তাই আসুন কমিউনিস্ট পার্টির জন্মদিনে আমরা আরেকবার শপথ নেই- আমরাই হব একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি ও গ্রামীণ সর্বহারা দরিদ্র মানুষের চ্যাম্পিয়ান। জাতীয় স্বার্থ ও শ্রেণিস্বার্থের এই মেলবন্ধনই হোক জন্মদিনের মূল প্রতিজ্ঞা। দুনিয়ার মজদুর এক হও। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিপাত যাক। স্বাধীনতা ও বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
প্রথম পাতা
বাঁওড় ইজারা বাতিল ও জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ
সয়াবিনের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও ঊধ্বমুখি দাম অনেক পণ্যে
শ্রেণিদৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চিত্তভূমি
খুন-ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের আহ্বান
ধর্ষণ-নিপীড়নকারী ও মব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার কর
নারীর জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে সংগ্রাম জোরদার করুন
কমরেড লাকী আক্তারের বিরুদ্ধে মব সন্ত্রাস বন্ধের আহ্বান সিপিবির
গণতন্ত্র রক্ষায় বাম-প্রগতিশীলদের ঐক্যের বিকল্প নাই
‘ছায়া’
হামলা-মামলার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে বামজোটের বিক্ষোভ সমাবেশ
দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ব্যর্থ হচ্ছে

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..