এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ কমরেড তাজুল ইসলামের স্মরণে সিপিবি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে শ্রদ্ধা শেষে রেড স্যালুট জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দএকতা প্রতিবেদক :
দেশের মানুষের মুক্তির লড়াইকে অগ্রসর করতে গেলে এক ঝাঁক নিবেদিত প্রাণ মানুষ দরকার। এই সংগ্রামের একজন হয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কমরেড তাজুল তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন মানব মুক্তির সংগ্রামে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী সংগ্রামে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করে দেশবাসীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হয়েই আছেন। আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতি ও আত্মত্যাগের অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন কমরেড তাজুল।
গত ১ মার্চ সকাল ৯টায় সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তিভবনের সামনে এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম শহীদ তাজুল ইসলাম স্মরণে স্থাপিত অস্থায়ী বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ কথা বলেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) আয়োজনে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আসলাম খানের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
এসময় রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন গণতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়া। এটি না পারায় ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল। এবার আবার ২০২৪ এ গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হলো। এ সময় ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠীকে এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। এই অবস্থা পরিবর্তনে শুধুমাত্র শাসকের অবসান নয়, দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে হবে। এর জন্য পুরো ব্যবস্থা বদল করার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। সিপিবি শোষণমুক্ত সমাজ তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন করতে চায়।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রুখে দাঁড়ানো এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ছাড়া মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না। আজ অনেকে সংস্কারের নানা কথা বললেও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে নিরব থাকছেন।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, দেশি-বিদেশি শাসকগোষ্ঠী এ দেশে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির উত্থান ঠেকাতে চায়। এজন্যে প্রচার মাধ্যমসহ নানা পর্যায়ে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ঘোষণা করে চলেছে। তারা মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার কথা বলে এমন এমন কিছু কথা সামনে আনে যাতে মানুষের মধ্যে প্রথমে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং পরে মানুষকে হতাশ করে।
তিনি এই অবস্থা উত্তরণে দেশ ও দেশের মানুষের সংকট দূর করে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান ও ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সচেতন দেসবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
এসময় সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান একদিনের সংঘটিত হয় নাই। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। কমরেড তাজুলসহ অসংখ্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। ৯০-এ আন্দোলনের শেষ দিকে এসে বিজয়ীরা কখনো শুধুমাত্র নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করেনি। আজ দেখছি ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেকে শুধুমাত্র কিছুদিনের আন্দোলনকে সামনে আনছেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনকে উহ্য রাখার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, মনে রাখবেন গণঅভ্যুত্থানের নায়ক সাধারণ মানুষ। তারা তাদের জীবন দিয়ে সংগ্রাম করে অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। আর সুবিধা নিয়ে যায় শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলো।
সকাল ১০টায় অস্থায়ী বেদীতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ মার্কসবাদী, বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি ঢাকা মহানগর উত্তর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটি, ঢাকা জেলা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি), জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ (স্কপ), বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফন্ট, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, সিপিবি সূত্রাপুর থানা, সিপিবি ধানমন্ডি থানা, সিপিবি প্রকৌশলী শাখা, ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা মহানগর কমিটি, সাপ্তাহিক একতা, সিপিবি অফিস শাখা, সোমেন-তাজুল পাঠাগার, এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ এলায়েন্সসহ বিভিন্ন দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ।
আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে পুরো কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী আহূত শিল্প ধর্মঘট ও হরতালের সমর্থনে আগের দিন মধ্যরাতে আদমজী জুটমিল এলাকায় কমরেড তাজুলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা প্রচার মিছিল বের করলে, তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর হামলায় কমরেড তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন শ্রমিক মারাত্মক আহত হন।
১ মার্চ ভোরবেলা গুরুতর আহত অবস্থায় কমরেড তাজুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।