
জনগণের যে বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণি বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামে ব্রতী, তাদের চিন্তাচেতনার গতিধারা সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা বৈপ্লবিক শ্রেণিদৃষ্টিতে যাচাই করে দুইভাবে পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত বিগত চব্বিশ বছরে পর্যায়ে পর্যায়ে যে লোক-অভ্যুদয় হয়েছে, তার ঘটনাবলির মধ্যকার চেতনার উত্তরণগুলি বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণির চিন্তার নব নব উপাদান বের করে আনা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত গত চব্বিশ বছরে যেসব রাজনৈতিক নিবন্ধ রচনা এবং সাহিত্য চর্চা ও সৃষ্টি হয়েছে তার হিসাব-নিকাশ করলেও মুক্তিসংগ্রামের চেতনার উপাদানগুলির সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে।
এখানে লোক-অভ্যুদয়ের ব্যাপারটিকে প্রাথমিকভাবে যাচাই করে নিতে গেলে দেখা যাবে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী গণ-আন্দোলন শ্রেণিসজ্জার দিক দিয়ে পরিমাণগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। জনগণের একটি বিশেষ অংশ, ছাত্রসমাজ, বরাবরই এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে। ছাত্রসমাজ ১৯৫২-এর বাংলা ভাষার সংগ্রামের স্রষ্টা ছিল। তারাই উনিশ শ উনসত্তরের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি সমন্বিত ১১ দফা আন্দোলনের স্রষ্টা হয়েছে। গণ-আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণকারী ছাত্রসমাজের সঙ্গে ক্রমবর্ধমানহারে সংগ্রামী জনতার সংযোগ স্থাপিত হয়েছে গত চব্বিশ বছরে। স্বাধীন পূর্ব বাংলার ঘোষণাটিও এসেছে ছাত্রসমাজের মধ্য থেকে।
শ্রমিকশ্রেণি বসে থাকেনি। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব-বিরোধী সংগ্রামে পূর্ব বাংলার সাধারণ ধর্মঘট প্রমাণ করেছিল যে মূলত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণির হাতেই যাওয়া উচিত। কিন্তু এ ঘটনা পারম্পর্য রক্ষা করতে পারেনি। এই কারণেই সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে শ্রমিকশ্রেণি বরং লালন করারই দায়িত্ব নিয়েছে। পূর্ব বাংলার গণমুক্তিসংগ্রামের ছাত্রসত্তাকে জনৈক বুদ্ধিজীবী পূর্ব বাংলার একটি ছাত্র সম্মেলনে কাব্যিকভাবে উপস্থিত করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য: নদীমাতৃক পূর্ব বাংলার একটি নতুন ধরনের নদী হচ্ছে ছাত্র আন্দোলন। এই নদী পূর্ব বাংলার মুক্তি আন্দোলনের প্রাণ।
হৃদয়গ্রাহী হলেও এটা নৈসর্গিক ব্যাখ্যা- বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নয়। এতে ছাত্র-সমাজের চরিত্রের পরিবর্তশীল রূপটি অথবা ছাত্র-সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত পূর্ব বাংলার ব্যাপকতম জনগণের সক্রিয় ও সচেতন ভূমিকা বেরিয়ে আসে না। তবু এই ধরনের ব্যাখ্যা যে সামনে আসে, তার কারণটিও ইতিহাসের দিক দিয়ে সত্য। ছাত্র-সমাজের পতাকাতেই পর্যায়ে পর্যায়ে শহীদের বুকের রক্ত ঢেলে আঁকা হয়েছে পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যমাত্রা।
(চলবে)