‘স্বর্গের ঝটিকা বাহিনী’ না কি ‘ক্ষণিক বিদ্যুৎ চমক’?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
বাংলাদেশে ৫-ই আগস্ট রাজপথে জেনারেশন জি-র নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়। আশ্চর্য হয়ে বাংলাদেশের মানুষ দেখে যে হাজার হাজার তরুণ বুলেট উপেক্ষা করে প্রাণ দিয়ে হলেও গণভবনের দিকে এগোতে থাকে। এই সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সন্তানদের ওপর গুলিবর্ষণে অপরাগতা জানায়। অবশ্য জাতিসংঘের ফলকার তুর্ক জানাচ্ছে যে তিনি আগেই সেনাবাহিনীকে সর্তক করেছিলেন যে সেটা করলে তাদের ক্ষতি হবে। পুলিশরাও এসময় অস্ত্র সংবরণ করে বা পালিয়ে যেতে শুরু করেন। কোথাও কোথাও তারা নৃশংস হামলারও শিকার হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। আর সরকারের ভাড়াটে মাস্তান বাহিনী পালিয়ে যায় আরো আগেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি ঘটে তা হচ্ছে দোর্দন্ড প্রতাপশালী একনায়ক শেখ হাসিনা ভারত এবং বাংলাদেশের দুই সামরিক বাহিনীর যৌথ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পালিয়ে ভারতে চলে যান, সেখানেই আশ্রয় নেন।
এই বিষ্ময়কর ঘটনার সঙ্গে অনেকে ‘ফরাসী বিপ্লবের’ সাদৃশ্য দেখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এবং ভেবেছেন যে তারা ফরাসী বিপ্লবের মতো ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ স্থাপন করবেন। ‘সাম্য-মেত্রী-স্বাধীনতা’ না হলেও তারা এই বিপ্লবের মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র কায়েম করবেন। বাংলাদেশের মালিক হবে বাংলাদেশের আপামর জনগণ।
গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে তরুণদের এই আকাঙ্ক্ষা ছিল মূলত ‘গণতন্ত্রের’ আকাঙ্ক্ষা। কারণ এর আগে ২০০৮ থেকে পর পর তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে তরুণ জনগণ তার ভোটাধিকার হারিয়েছে। এছাড়া সাধারণ জনগণও ছিলো দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে পিষ্ট। দুর্নীতি ও মাস্তানিতে ভারাক্রান্ত। সকল জনগণই মুক্তি চাচ্ছিলেন।
কিন্তু জনগণ জানতো না যে তরুণদের এই স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ‘ফরাসী বিপ্লবের’ মতো কোনো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত হবে না। এই স্বতঃস্ফুর্ত তরুণদের পেছনে কোনো বিশেষ বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠনের একক নেতৃত্ব ছিল না। এটি ছিল হাসিনাবিরোধী এ টু জেড ঐক্যবদ্ধ একটি গণ-অভ্যুত্থান। এতে পেছনে থেকে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াত, দক্ষিণপন্থি হেফাজত-বিএনপিসহ, বামপন্থি দলগুলিও কম-বেশি সমর্থন দিয়েছিলেন। এতে বাম-ডান-মধ্য ও প্রতিক্রিয়াশীলরা সকলেই কম-বেশি সমবেত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মতাদর্শগত কোনো ঐক্য ছিল না। শুধু একটি প্রশ্নে তারা একমত হয়েছিলেন- ‘হাসিনা তুই কবে যাবি’ ‘এক দফা-এক দাবি’ ছিল এটাই।
আন্দোলনের এই নেতিবাচক ঐক্যটি, আন্দোলনের বিজয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই ভেঙ্গে যায়- শুরু হয় নেত্বত্ব ও কর্মসূচি নিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ। কেউ কেউ ক্ষমতার প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে নতুন সরকারের সদস্যে পরিণত হন। কেউ কেউ নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন। কেউ বা ফরাসী বিপ্লবের বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কেউ কেউ অবশ্য অনেক হয়েছে ভেবে আবার শিক্ষালয়ে ফিরে যান, কেউ বা এখন হতাশ হয়ে বসে পরেছেন। এই আন্দোলনে যেসব রাজনীতি সচেতন ছাত্ররা নিজ নিজ মতাদর্শের ব্যানারে যোগ দিয়েছিলেন তারা নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে পরষ্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হন। অথবা নিজ দলে ফেরত যান। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যে জাতীয় চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল তা আর বিরাজ করছে না। মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে বির্তক আনার কারণে এটা হয়েছে। বর্তমানে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ঐক্য কায়েমের জন্য এদের মূল অভিভাবক ড. ইউনূস এদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে চলেছেন। কিন্তু তিনি কি সফল হবেন? তার সাফল্যের মতাদর্শগত ভিত্তিই বা কি হবে? এটা কি ইসলামি শাসনব্যবস্থা হবে নাকি বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে না কি কোনো না কোনো রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা? কেন প্যারি কমিউনের মতো এরা ‘স্বর্গের ঝটিকা বাহিনী’ হতে পারলো না?
ফরাসী বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির যে সচেতন বাহিনী জনগণের প্রজাতন্ত্র তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্যারিসে ৭২ দিন প্যারি কমিউন গঠন করে টিকে ছিলেন এবং পরে অসময়ে বিপ্লব করার খেসারত দিয়ে বুর্জোয়া কসাইদের হাতে করুণ মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই হঠকারি শ্রমিকদের কে কার্ল মার্কস নাম দিয়েছিলেন ‘স্বর্গের ঝটিকা বাহিনী’।
তারা ৭২ দিন ৎরমযঃ ঃড় ৎবপধষষ সহ উরৎবপঃ উবসড়পধপু বা প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। যদিও তারা তাদের আদর্শ গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারেন নি, কিন্তু ইতিহাসে তারা আজো অমর হয়ে আছেন। তাদের সাম্যের স্লোগান, মৈত্রীর স্লোগান, স্বাধীনতার স্লোগান যে আসলে ছিল বুর্জোয়াদের সাম্য, বুর্জোয়াদের মৈত্রী, বুর্জোয়াদের স্বাধীনতা সেটা অনেক মূল্য দিয়ে পরে আমরা সবাই বুঝেছিলাম।
বাংলাদেশের তরুণরা ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল তৈরি করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছেন। গণপরিষদ নির্বাচন করে শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা ও বক্তব্য দিয়েছেন তা বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকেও পশ্চাৎপদ। নতুন নাগরিক পার্টি ডিসেম্বর ও জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিরোধীতাও করছে। এই পার্টির সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা মানুষ দেখছে। এরা নির্বাচনের বিরোধীতা করছে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের দ্বৈত ভূমিকা আছে কি না এ প্রশ্নও মানুষের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে বা বড়জোর জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে জেন-জি-র স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা কার্যকরী হতে হলে তাদেরকে অবশ্যই তাদের বর্তমান পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে হবে। কিন্তু তাদের সহায়তা করার জন্য তাদের পেছনে দেশের কোনো সংগঠিত বামপন্থি রাজনৈতিক দল নেই। নেই কোন শ্রমিক-কৃষকের সংগঠিত জনগণের শ্রেণি সচেতন অগ্র বাহিনী। তাই জনগণের প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ এখনই কায়েম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলেই মনে হয়। আকাঙ্ক্ষা তাদের মহৎ হতে পারে সাধ্য তাদের সীমিত।
ক্ষণিক বিদ্যুৎ চমকই বটে!
তবে ২০২৪-এর আগস্টে তারা যে ‘বিদ্যুতের চমক’ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে সকলেই স্বীকার করবেন। কিন্তু এটা ছিল ক্ষণকালীন চমক। কারণ সেই চমকের পর পরই দেশে কতকগুলি নেতিবাচক ঘটনা ঘটে গেছে। হাসিনা চলে গেছেন কিন্তু শূন্য স্থান দখল করেছেন যারা তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। ফলে আসলে শূন্য স্থানকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই।
দেশে ধর্মীয় গোড়া শক্তি এবং যুদ্ধাপরাধীদের নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি মাঠে নেমে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ‘সাম্য-মেত্রী-স্বাধীনতা’ বা ‘বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ নয়, তারা চান ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খিলাফত, আল্লাহর আইন বা মৌলবাদি রাজত্ব। কারো কারো ভাষায় এর মূর্ত প্রতিচ্ছবি হচ্ছে তালেবানি রাজত্ব। তারা চান ১৯৪৭ এ ফিরে যেতে, মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিতে।
দেশে ‘মব’ জাস্টিসের নামে লুটপাট ও নতুন মাস্তানি শুরু হতেও আমরা দেখেছি। চাঁদাবাজি ও দখলদারি প্রবণতা নতুন করে সর্বত্র দেখা দিতে শুরু করেছে।
আমরা দেখেছি Property Right না মেনে দুর্বল সম্প্রদায় এর বাড়িঘর লুটপাটের মহোৎসব। আমরা দেখেছি নারী ও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর উপর অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত হামলা। আরো দেখা যাচ্ছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ আবহমানকালের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিহিলিষ্ট কায়দায় প্রত্যাখ্যান ও ধ্বংস করার প্রবণতা। মাজার ও মূর্তি ভাঙ্গার নৈরাজ্য।
এসব প্রবণতা প্রমাণ করে যে আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে যে ‘আলোর ঝলক’ ছিল তা ক্ষণকালের বিদ্যুৎ চমকের মতোই ক্ষণকালীন হয়েছে। এখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তৈরি করে এসব প্রবণতাকে কি আটকানো যাবে?
কি বলছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয়েছে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল। তারা স্লোগান দিয়েছেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। কিন্ত তারা দাবি করেছেন যে, তাদের ভাষায় এই ‘বিপ্লবে’ কোনো ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ দ্বারা পরিচালিত হবে না। এটা হবে অভিনব বাম-ডান-মধ্য-সকলের মিশ্রিত অন্তর্ভুক্তিমূলক তখাকথিত এক জাতীয় সংগ্রাম। তারা ভুলে গিয়েছেন যে হাসিনা চলে যাওয়ার পর এ ধরনের মিশ্র ঐক্যের রাজনীতি বর্তমানে অচল। এখন আপনাকে স্থীর করতে হবে আপনি কোন দিকে থাকবেন। ডানে না বামে? সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে না বিপক্ষে? সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে না বিপক্ষে? শ্রমিক-কৃষকদের পক্ষে না বুর্জোয়াদের পক্ষে?
এই শ্রেণি বিভেদের কালে শ্রেণি সমন্বয়ের সাদা পতাকা তুলে ধরে তারা একটা অসম্ভবকে সম্ভব করার অলীক স্বপ্ন দেখেছেন।
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
আমরা চাই তরুণরা সফল হোক, তারা তাদের উপযুক্ত মিত্র ও অভিভাবকরদের চিনে নিক। ফিরে আসুক ‘সিরাতুল মুস্তাকিমের’ পরে। সেই পথ হচ্ছে ‘আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব’-র গণতান্ত্রিক পথ।
তাই এই মুহুর্তের দাবি হচ্ছে ন্যূনতম সংস্কার করে করে থ্রি এম এর প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেইভাবে জনগণের ক্ষমতা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে ফিরিয়ে দিলেই আসলে কায়েম হবে প্রকৃত ‘রিপাব্লিক’। কিন্তু যদি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংস পার্টি তৈরি করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হয়– তাহলে কিন্তু আবার সেই পুরনো খেলার পুনরাবৃত্তিই হবে।
তাই তরুণ দলকে জানাই হুঁশিয়ারি বা অগ্রীম সর্তকবাণী। যদিও তাদের ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাস ফেলছে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান। তিনি জানাচ্ছেন অগ্রীম সর্তকবাণী। তাই বরং কম কিন্তু ভালো অল্প কিছু সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা গেলেই, এ যাত্রা আমাদের তরুণদের উদ্যোগ সফল হবে বা হয়েছে বলে আমরা মনে করবো। বাকি কাজ দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব শক্তিতে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রথম পাতা
গণতন্ত্র রক্ষায় বাম-প্রগতিশীলদের ঐক্যের বিকল্প নাই
‘ছায়া’
হামলা-মামলার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে বামজোটের বিক্ষোভ সমাবেশ
দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ব্যর্থ হচ্ছে
নারীর জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে সংগ্রাম জোরদার করুন
কমরেড লাকী আক্তারের বিরুদ্ধে মব সন্ত্রাস বন্ধের আহ্বান সিপিবির
সয়াবিনের সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও ঊধ্বমুখি দাম অনেক পণ্যে
শ্রেণিদৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চিত্তভূমি
খুন-ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের আহ্বান
ধর্ষণ-নিপীড়নকারী ও মব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার কর
বাঁওড় ইজারা বাতিল ও জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ
Login to comment..