নারীর বিষয়ে একটি গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, যুগ যুগ ধরে নারীরা বৈষম্য, বঞ্চনা এবং উপেক্ষার শিকার হয়ে আসছেন। বর্তমান সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রচেষ্টা নারীদের অধিকারকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে, তবে বাস্তব জীবনে সেই স্বীকৃতি অনেক ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে থেমে যায়। নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সীমানায় বেঁধে রাখা- এগুলো আমাদের চারপাশের প্রচলিত চিত্র।
বর্তমান সমাজে নারীরা যেমন বঞ্চিত, তেমনি সাধারণ মানুষও দিন দিন অসহিষ্ণু ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। মানুষ একে অপরের সমস্যায় আগ্রহ হারাচ্ছে, যা মানবিকতাকে বিপন্ন করে তুলছে। এখন সমাজে তৈরি হয়েছে নারীর প্রতি অবিচার এবং সমাজের ক্রমবর্ধমান স্বার্থপরতার সংস্কৃতি।
নারীরা সমাজের নানা স্তরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে তাদের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না, অনেক ক্ষেত্রে তারা সমান যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান। এই বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়াগুলো কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবেও গভীর। সমাজে নারীর অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনগত সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা নানা বাধার সম্মুখীন হন। যদিও এই সব খাতে নারী উন্নয়নের অনেক প্রচেষ্টা চলছে, তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল বা শহরের নিম্নবিত্ত শ্রেণির নারীরা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। এছাড়াও, নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, যা তাদের জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দাম্পত্য জীবনে অথবা কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হয়রানি নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের আঘাত হানে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সমাজে নারীর কাজকে প্রায়শই ‘অদৃশ্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়। গৃহস্থালী কাজ, সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব এবং অন্যান্য গৃহস্থালী দায়িত্বকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখা হয় না। এর ফলে নারীরা সমাজের উৎপাদনশীলতার অংশ হিসেবেও অবমূল্যায়িত থাকেন। এই অবমূল্যায়ন নারীসমাজের উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। নারীরাও এ সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে আসতে পারেন। চাকরিজীবী নারীদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা বিদ্যমান। যদিও তারা কর্মজীবনে সফলতার মুখ দেখছেন, ঘরের ভেতর তারা প্রায়ই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। অনেক নারীকেই ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েও চুপ থাকতে হয়, কারণ তারা পরিবার বা সমাজের সম্মান বজায় রাখার নামে কষ্ট সহ্য করেন। কর্মক্ষেত্রে নারী যতই শক্তিশালী হোন না কেন, ঘরের ভেতরে যদি তাকে প্রতিনিয়ত অবিচারের শিকার হতে হয়, তাহলে তা নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু এই উন্নয়ন এখনও সর্বজনীন বা সম্পূর্ণ নয়। নারীরা এখন উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি- সব ক্ষেত্রেই উন্নতি করছেন। তবে, অনেক ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থায় উপদেষ্টা এবং সংস্কার কমিটিতে নারী নেওয়ার কথা থাকলেও, প্রায়শই তা কেবল কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে নারীদের সেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয় না। এমনকি যদি কোনও নারীকে নেওয়া হয়ও, তার মতামতকে প্রভাবিত করার সুযোগ দেওয়া হয় না, বা তাকে দৃষ্টিগোচর ভূমিকা থেকে সরিয়ে রাখা হয়।
নারীকে সমাজে সত্যিকারের সমতা পেতে হলে এইসব বৈষম্যকে চিহ্নিত করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক উদ্যোগ নয়, নারীকেও তার অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এইসব বৈষম্য মোকাবিলা করার জন্য নারীদের একটি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তাদেরকে নিজস্ব অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে এবং সমাজে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে হবে।
আমাদের সমাজে শুধু নারীরা নয়, মানুষও ধীরে ধীরে স্বার্থপর হয়ে উঠছে। শহরের ব্যস্ত জীবনে মানুষ নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বদলে, মানুষ এখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার সময় কিংবা ইচ্ছা নেই। ফলে এক ধরনের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতা সমাজে প্রসার লাভ করছে।
মানুষের এই স্বার্থপরতার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা এবং আর্থিক অস্থিরতা। বর্তমান সমাজে মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। শিক্ষা থেকে কর্মজীবন- সব ক্ষেত্রেই মানুষকে টিকে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। এই প্রতিযোগিতা মানুষকে নিজেদের মধ্যে একটি আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে বাধ্য করছে।
তাছাড়া, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক সংযোগের সহজলভ্যতা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের অভাব দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগণিত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও বাস্তব জীবনে মানুষ একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায় না। এটি একটি বিশাল মানসিক দূরত্ব তৈরি করছে, যা মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও সহযোগিতার মানসিকতাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা এবং ‘নিজের কাজ’ নিয়েই ব্যস্ত থাকার প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সমাজে এমন পরিস্থিতির উদাহরণ দেখতে পাই যেখানে একজন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছে, অথচ চারপাশে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করতে চায় না। বরং ফোন হাতে ভিডিও ও তোলায় ব্যস্ত থাকছে। এই মানসিকতার পেছনে এক ধরনের সামাজিক ভীতি ও অসচেতনতাও কাজ করে। কেউ সাহায্য করতে গিয়ে নিজে বিপদে পড়বে না তো, এমন চিন্তা থেকেই অনেক মানুষ দূরে সরে থাকে। এটি একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এবং এর সমাধান খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
নারীর অধিকার, সমতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন আইনি, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি, মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে নারীদের সমানভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের সক্ষমতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান বেতন এবং সুযোগের বিষয়টি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিশেষে, বলা যায় যে নারীর প্রতি সমাজের অবিচার এবং মানুষের ক্রমবর্ধমান স্বার্থপরতা দুটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা একটি উন্নত, মানবিক এবং ন্যায়সংগত সমাজ গঠন করতে সক্ষম হব। এছাড়াও, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতির ওপর জোর দিতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্ম একটি সহযোগিতামূলক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।