দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা

মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাবলি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রতিনিয়তই নানা আলাপ আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন ‘গণঅভ্যুত্থান’ আবার কেউ বলছেন দেশে ‘বিপ্পব’ সংঘটিত হয়েছে। নানা জনের নানা বক্তব্য শুনে আমার পুরোনো একটি স্মৃতিকথা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটি সম্ভবত দেশের স্বাধীনতা-উত্তর পঁচাত্তর সালের পরের ঘটনা। তখন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিপ্লব বিপ্লব বলে চারিদিকে মহা হই চই চলছে। এর মধ্যে তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতা আব্দুস সবুর খান হঠাৎ বলে উঠলেন- মিয়ারা বিপ্লব বিপ্লব বলে আর অযথাই রাজনীতির মঞ্চ গরম করবেন না। বিপ্লব কারে কয় তা আপনারা জানেন না। আপনারা বোঝেনও না। আসল বিপ্লব এলে আপনি আমি কেউ বাঁচবো না। সব খড়কুটোর মত বঙ্গোপসাগরে ভেসে যাব। আজকে স্বাধীনতা-উত্তর পাঁচ দশক পরে কিছু অর্বাচীন বালকের মুখে ‘বিপ্লব’ নামক শব্দটির যথেচ্ছার ব্যবহারে তাই সেই পুরানো দিনের স্মৃতি আবার নতুন করে মনে পড়ে গেল। কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে মধু মক্ষিকার দল যেন মৌমাছির চাকে হুমড়ি দিয়ে পড়েছে। আর এই হুমড়ি দিয়ে পড়ার ফলে কখন কী বলছে তা তারা নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না। দেশের মানুষ যে হতাশার গহ্বরে ডুবে ছিল, সেই গহ্বরেই হাপিত্তেশ করে ছটফট করছে। দেশে একটি নতুন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতার আসনে বসেছেন। এই নতুন সরকার সংবিধানের কোন ধারা অনুসরণ করে ক্ষমতার মসনদে বসে জনতার মাথার ওপর দিয়ে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন তা আমি জানি না। সবচেয়ে চমকপ্রদ কথা হলো এই সরকার কতদিন ক্ষমতার মসনদ আকড়ে থাকবেন তা-ও স্পট করছেন না। শুধু মুখে বলছেন জনগণ যতদিন চাইবে ততদিন তারা ক্ষমতার মসনদে থাকবেন। প্রশ্ন হলো- কোন জনগণ তাকে ক্ষমতার আসনে বসতে দিয়েছেন। আঠারো কোটি জনসংখ্যার দেশে কত শতাংশ জনগণ তাকে সংবিধানের কত ধারা বলে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। সরকার তো নিজেই সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন। সংস্কারের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে এই সরকার এখন চার/পাঁচটি সংস্কার কমিটি গঠন করেছেন। তারমধ্যে একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিটি। এক্কেবারে বালখিল্য চপলতা। সংবিধানের গায়ে হাত দেয়ার অধিকার কে দিয়েছে। এই সংবিধানের সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তা করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ। নির্বাচিত সংসদ ব্যতিত সংবিধানের গায়ে আঁচড় দেয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে একটি অসাংবিধানিক কাজ। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দেড় মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে সরকার এই সময়ে জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি ফিরাতে পারেন নাই। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষের মনে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে। চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, দখলবাজি, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে পিটিয়ে মানুষ হত্যা ইত্যাদি লোমহর্ষক ঘটনা প্রতিনিয়ত জনমনে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি করে চলেছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিককালে বিক্ষুদ্ধ পাহাড়ি জনপদের মধ্যে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। বন্যার্তদের সহযোগিতার নামে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত বিপুল ত্রাণসামগ্রীসহ কোটি কোটি টাকা নিয়ে চলছে নানা লুকোচুরি ও তেলেসমাতি কারবার। গণমানুষের দৈনন্দিন জীবনের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার বাজার ব্যবস্থাপনা। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল নতুন সরকার তার এই চিরচেনা দুর্বিষহ অবস্থার হাত থেকে মুক্তি দিবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে জনগণ এ ব্যাপারে সরকারের কোনো উল্লেখ করার মত ভূমিকা এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করে নাই। সরকার নিজেকে বিপ্লবী সরকার বলে মুখে ফেনা তুললেও বাজার ব্যবস্থাপনায় বিন্দুমাত্র স্বাক্ষর রাখতে পারে নাই। সেই চিরাচরিত মুক্তবাজার অর্থনীতির মশাল জ্বালিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে মাত্র। আর বাজার সিন্ডিকেট গোষ্ঠী বগল বজিয়ে সরকারের এইসব তুঘলকি কারবার উপভোগ করছে। শিল্প বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় খাত গার্মেন্ট কারখানা। নানা মিডিয়ার কল্যাণে শুনলাম সেই গার্মেন্ট কারখানাগুলিতে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। বহু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে। অনেক কারখানা লোকআপ ঘোষণা করেছে। এইসব কোনটাই আনন্দের খবর নয়। এর ফলে শ্রমিক অসন্তোষের মাত্রা যে আরো বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ঘটনা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অবস্থা যদি চলমান থাকে খুব শিগগির গার্মেন্টস শিল্পগুলি আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। চারিদিকে কি এক ভয়াবহ অবস্থা। আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পচন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কখনও সংসদীয় পদ্ধতি, কখনও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, কখনও সেনা সমর্থিত সরকার, কখনও বা ডাইরেক্ট সেনা শাসন ইত্যাদি দিয়ে পঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকার এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোন কাঠামো আর তাকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। সুতরাং দেশের চলমান পরিস্থিতি দেখে হতচকিত হওয়ারও কিছু নেই, আবার উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। সবার দায়িত্ব হলো কোনো প্রকার অপপ্রচারে কান না দিয়ে কেবলমাত্র লক্ষ্য স্থির রেখে কাজের গতিপ্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আগামী দিনের নতুন সম্ভাবনা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাংলাদেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উনার জীবদ্দশায় একটা কথা প্রায়ই বলতেন যে, “সমাজতন্ত্র গর্ভধারিণী ধনতন্ত্র মাতার গর্ভে প্রসবের বেদনা উঠিয়াছে।” আমি তখন সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে পর্দাপণ করেছি। সুতরাং সেই বয়সে উনার এই কথার গুরুত্ব তেমন একটা না বুঝলেও রাজনৈতিক জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তা ভীষণভাবে উপলদ্ধি করেছি। এরপর যতই দিন যাচ্ছে এই উপলদ্ধির গভীরতা ততই গভীর হচ্ছে। লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..