গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী চ্যালেঞ্জ
এ কে এম জামীর উদ্দীন
এভাবে আর স্রেফ ২-৩ মাস দেশ পরিচালনা করা হলে সাধারণ মানুষ বলবে আওয়ামী লীগের আমলই ভালো ছিল। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান আগেও হয়েছে। এই দেশে স্বৈরাচারী শাসনের ইতিহাস আওয়ামী লীগ একা তৈরি করেনি। এই ভূখণ্ডে এরশাদ বা আয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারও ছিল। তাদেরও পতন হয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান এলোমেলো অবস্থা আগের পরিস্থিতিগুলোতে দেখা যায়নি।
আমরা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছি, যেখানে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লুট করা হয়। লুট করতে গিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। লুটের শিকার হওয়া কারখানায় আগুন লেগে ইতোমধ্যে নিখোঁজ ১৭৫ জন। নারায়ণগঞ্জে গাজী টায়ারের কারখানায় আগুনে নিখোঁজ স্বজনদের মতে, ওইসব ব্যক্তি লুট করতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছেন। ১৭৫। এটি নিছক কোনো সংখ্যা নয়। ১৭৫টি প্রাণ। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই সঙ্কট কেন তৈরি হলো? এই সঙ্কট তৈরি হওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্রসহ বুদ্ধিজীবীরা কম দায়ী নয়। কেননা, লুটকে তারা উৎসাহিত করেছেন। হাসিনা পালানোর পর গণভবন লুট হয়েছে। সেই লুটকে কেন্দ্র করে আপনাদের উচ্ছ্বাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে। সেলফি তুলেছেন। মব দুই রকমের আছে। একটি অনলাইন মব, আরেকটি বাস্তব জগতে মব। বাস্তব জগতের মবকে শনাক্ত করা কঠিন। কেননা, ওইখানে হাজার হাজার লোক থাকে। গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতায় ওই মব গণভবন লুটপাট করেছে। অভ্যুত্থানের স্পিরিট দিয়ে এটাকে আমরা ওই মুহূর্তকার পরিস্থিতি হিসেবে হয়তো জাস্টিফাই করতে পারি। কিন্তু, এই দেশের দায়িত্বশীল জায়গায় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা এই ধরনের হামলার নিন্দা তো করেনি, ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহিত করেছে। সংবাদপত্র ও কথিত বুদ্ধিজীবীরা এসব ধ্বংসলীলায় অনলাইনের মব হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। মনে রাখবেন, অনলাইনের মব শনাক্ত করা যায় খুব সহজে। তাদের চিহ্ন মুছে দেওয়া যায় না।
ধানমন্ডি ৩২-এর বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম পোড়ানো হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশের সচেতন মহলের পক্ষ থেকে তেমন কোনো দুঃখবোধ আমরা দেখিনি। মিউজিয়াম শুধুমাত্র বিনোদন বা দর্শনার্থীদের ভিজিট করার স্পট নয়। এটি ইতিহাস চর্চারও জায়গা। মানুষের সঙ্কট মোছনের জন্য নতুন পথ বের করার জন্য গবেষণার স্থান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আজ থেকে ২০০ বছর পর যদি এই ভূখণ্ডে কোনো রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৈরি হয়, তখন গবেষকরা মিউজিয়ামের সাহায্য নেবেন। তারা বিশ্লেষণ করবেন, কীভাবে তাদের পূর্বপূরুষ অনুরূপ সঙ্কট মোকাবিলা করেছিল। পৃথিবীতে কোনো কোনো মিউজিয়াম ৮০০ বছরেরও পুরনো। যুদ্ধের সময়ও আগ্রাসী বাহিনী মিউজিয়ামে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে মিউজিয়ামে আক্রমণ করাকে মানুষ হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে গণ্য করা হয়। ২০০৩-এর ১০ এপ্রিল ইরাকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মিউজিয়ামের ঘটনাকে গণহত্যার চেয়েও বড়ো ঘটনা হিসেবে গ্লোবাল মিডিয়া চিহ্নিত করেছিল। সেখানে বিদেশি গোষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু, বাংলাদেশে মিউজিয়াম লুট হয়েছে দেশীয় মানুষের মাধ্যমে। এখানকার বুদ্ধিজীবী বা সংবাদপত্রের এর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ দেখিনি। শুধু মুজিবভক্ত নয়, মুজিববিরোধীদের জন্যও এটি একটি বড় গবেষণার জায়গা ছিল। ১৯৭১ আর মুজিবকে আপনি-আমি অস্বীকার করতে পারবো না। এতো বড়ো একজন শাসক মাত্র চার বছরের মধ্যেই কেন এতো অজনপ্রিয় হয়ে গেলো বা ওই সময়ের প্রেক্ষিত জানার জন্য এই মিউজিয়ামের ভূমিকা কোনো বিশেষণ দিয়ে এখানে লেখা যাবে না। মিউজিয়ামের মতো ভাস্কর্যও একই ভূমিকা রাখে। সমস্যা হচ্ছে, হাসিনা সরকার এতো বেশি মুজিবের অপ্রয়োজনীয় ভাস্কর্য স্থাপন করেছে, যা অপ্রয়োজনীয় ও সরকারি টাকা লুট করার নামান্তর। সঙ্কট হচ্ছে, যখন আপনি নির্বিচারে সব মনীষীর ভাস্কর্য ভাঙাকে উৎসাহিত করবেন, আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এখানকার ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হিন্দুসহ অন্যদের ধর্মীয় আচারকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। একইসঙ্গে ভাস্কর্য স্থাপনকে অন্যান্য ধর্মের মূর্তি পূজা হিসেবে গণ্য করে। এসব বিষয়ে ড. ইউনূসের মন্তব্য ছিল, ‘হাসিনা তার বাবার লিগ্যাসিকে ধ্বংস করেছে।’ কথা সত্যি। কিন্তু, তার এই মন্তব্য এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল না। তাকে লুটেরা মবকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য শক্ত বার্তা দেওয়া উচিত ছিল। একই সঙ্গে আমরা হিন্দুদের ওপরও কম-বেশি মাত্রায় হামলা দেখেছি। ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে কথিত বুদ্ধিজীবীদের চুপ থাকা। ফলস্বরূপ গাজী টায়ারের কারখানায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে লুট করার ঘটনা আমরা দেখেছি। উন্মুত্ত মবকে উৎসাহিত করার কারণেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আশঙ্কা করছি, এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। সভ্য দুনিয়ায় এই ধরনের ঘটনা বিরল। ফলে এখানকার সাধারণ মানুষ আগামী কয়েকমাস পরেই এই দেশে অসভ্যতার স্কেল আওয়ামী লীগ আমলে কতটুকু ছিল আর এই সরকারের আমলে কতটুকু তা মাপতে শুরু করবে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেয়ে আরও খারাপ হওয়ার মতো ক্ষেত্র বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই এখন তৈরি করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা মূখ্য। বাহিনী হিসেবে পুলিশের নৈতিক অবস্থান এখন দুর্বল। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীদেরকে পুলিশের অধিকাংশ পোস্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এসব হাজার হাজার পুলিশ সদস্যের নিয়োগ আপনি বাতিল করতে পারবেন না। এই সঙ্কট গুরুতর। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এদের মধ্যে কীভাবে ন্যূনতম দেশপ্রেম জাগ্রত করা যায়, তা নিয়ে ভাবা জরুরি ছিল। বিপরীতে আপনারা উল্টো সঙ্কট তৈরি করেছেন। আনসারদের প্রতিবাদ কর্মসূচি আপনারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সচিবালয় ‘ক্লিয়ার’ করার জন্য ছাত্রদেরকে আনসারদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে হয়েছে। শতশত আনসারকে জেলে পুরা হয়েছে। আনসারের পুরো নাম- বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এদের ভূমিকাও বিশাল। আনসারদের এই প্রতিবাদকে আপনারা ‘প্রতিবিপ্লব’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। কতটা হাস্যকর এ ধরনের ট্যাগিং! অর্থাৎ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য আরও একটি বাহিনীর নৈতিক ভিত্তি আপনারা নিজেরাই দুর্বল করে দিয়েছেন। কেননা, তাদেরকে আপনারা প্রতিবিপ্লবী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। আপনারা বলছেন, আনসারসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী এখনই সব দাবি আদায় করে নিতে চায়। আপনাদের মতে, এটা ঠিক নয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি তো আপনারা ক্ষমতাসীনরাই তৈরি করেছেন। সরকার পরিবর্তন হওয়ার এক সপ্তাহ না হওয়ার আগেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন শত শত কর্মকর্তাকে তাদের দাবির প্রেক্ষিত আপনারাই পদোন্নতি দিয়েছেন। অন্যদিকে সব দোষ আনসার বা রিক্সাওয়ালাদের মতো গরিব লোকদের।
এই ধরনের একাধিক অসঙ্গিত নিয়ে আপনারা চলছেন। এই ধরনের ভুল নিয়ে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের বিচার করার যোগ্যতা আপনারা হারিয়ে ফেলবেন। স্বৈরশাসকদের বিচার আগেও হয়নি। এরশাদ মাত্র বছর পাঁচেক জেল খেটেছিল। কারও দুঃশাসনের বিচার করতে হলে নৈতিক ভিত্তি লাগে। দয়া করে এই ভিত্তি আর দুর্বল করবেন না। স্বৈরশাসকদের বিচার না হলে এর চেয়ে আরও বড়ো স্বৈরশাসক সামনে তৈরি হবে। উদাহরণ, এরশাদ পরবর্তী হাসিনা।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি খুবই বৈচিত্র্যময়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের ঐতিহাসিক পরাজয় হয়েছিল। কারণ, ওই যুদ্ধে তারা পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নিয়েছিল। সেই জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের এক দশক শেষ না হওয়ার আগেই বিপুল বিক্রমে বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে। একইভাবে যদি বলি, ১৯৭১-এর স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ১৯৭৫-এ এই দেশের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়। ওই সময়ের আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের বিরক্তি ইতিহাসের পাতায় পাতায় বর্ণিত আছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলের দুঃসহ স্মৃতি এ দেশের মানুষের মনে আছে। এর জের ধরে বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের এতো ত্যাগের পরও ২০২৩-এর তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলনকে তারা অভ্যুত্থানে পরিণত করতে পারেনি। ফলে আজকের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনারা যেভাবে দেখছেন, সেটি শ্বাশত নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, স্বৈরশাসনের নেতৃত্ব দেওয়া এই দলের নেতাকর্মীদের শাস্তি হওয়া আবশ্যক। এটি করতে হলে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্র কাঠামো দরকার। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আপনারা সেই কাঠামো এখন দুর্বল হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টাই দৃশ্যত আগ্রহ নিয়ে পদে বসেছেন। তাদের সেই আগ্রহকে আমরা সম্মান জানাই। চেয়ারের কাজ হচ্ছে, সিস্টেমকে ইতিবাচক অর্থে সচল রাখা। এর জন্য উন্নত কোনো দেশে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখে না। আর যদি ভুল করে, তাহলে তিরস্কার সহ্য করতে হয়।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা
Login to comment..