অভয়ারা কোনোদিনও মরেনি, অভয়ারা মৃত্যুহীন!

সাত্যকি রায়

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

[আর জি কর-এ নারী চিকিৎসককে নৃশংসভাবে গণধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে কলকাতায় যে গণবিক্ষোভ সংঘটিত হয় তা জাতীয় গণ্ডি ছাপিয়ে বৈশ্বিক রূপ নেয়। এ ঘটনার মধ্যে শাসকশ্রেণি ও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তারই বিশ্লেষণে এ লেখা] সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠেছে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত শুধু সময়ের বিভাজন ও যতিচিহ্নগুলো মুছে দিয়েছে তা নয়; জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি তার ভৌগোলিক পরিসরকে অতিক্রম করে রাজ্য ও দেশের সীমানার বাইরে নিজেদের সমবেত অস্তিত্বকে সদর্পে ঘোষণা করে চলেছে। যারা এই আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী অথবা প্রত্যক্ষদর্শী সবাই একবাক্যে অনুভব করছে এত স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ যা সর্বজনীন আকার ধারণ করেছে এবং যা গভীরভাবে গণতান্ত্রিক তা যেন গোটা সমাজটাকে এক বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছে। গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব নয়, গণতন্ত্র মানে মানুষের নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সমবেত সচেতন অংশগ্রহণ। গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়, গণতন্ত্র মানে শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা নয়, গণতন্ত্র মানে সমবেত স্বরের নির্মাণ, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে তার পূর্বানুমান ও নৈতিকতার আধারগুলিকে স্মরণ করিয়ে দিতে সরাসরি রাস্তায় অবতীর্ণ হয়। এই নির্মাণ এখন প্রতিদিন শহরে, প্রান্তরে কলকাতায়, জেলায়, স্বদেশে, প্রবাসে ঘটে চলেছে। এই প্রতিবাদ কেন এত স্বতঃস্ফূর্ত, এত আন্তরিক, এত সর্বব্যাপী? প্রথমত, আটপৌরে বাঙালি পরিবারের মেয়ে অভয়া, যে টাকার জোরে নয়, ক্ষমতার জোরে নয়, মেধার জোরে সমস্ত আর্থিক সামাজিক প্রতিকূলতা জয় করে এমবিবিএস পাস করে সরকারি মেডিকেল কলেজে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার দুর্লভ সুযোগ ছিনিয়ে নিতে পেরেছে, সেই মেয়ে যে ক্ষতবিক্ষত নিম্নবিত্তের জীবনে সাফল্যের উজ্জ্বল নিদর্শন, যে শুধু তার মা-বাবার আশা-ভরসা নয় আপামর বাঙালির লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সে আজ আক্রান্ত, ক্ষতবিক্ষত। ডাক্তার, মোক্তার, শিক্ষক, গায়ক, নাট্যকার, অধ্যাপক, দোকানদার, পেশাজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, অটোচালক, রিক্সাচালক সবাই যেন হারিয়েছি তার দিদি, বোন অথবা মেয়েকে। দ্বিতীয়ত, অনেকে বলছেন এই ধরনের ঘটনা তো অন্য রাজ্যেও ঘটেছে। ঠিকই তো, অন্য রাজ্যে কেন আমাদের রাজ্যেও নারী নির্যাতন, খুন এসব ভাবা যায় না এরমকম তো নয়। হাথরাস যেমন আছে, কামদুনিও আছে। কিন্তু সরকারি কাজে নিযুক্ত সরকারি পরিসরে কর্মরত একজন ডাক্তারের নারকীয় হত্যাকাণ্ড- এরকম ঘটনার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। সরকারি পরিসরে একজন কর্মচারীর অধিকার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত। তাঁর কাজ ও অধিকার দুটোই সরকারি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সুরক্ষিত, যেখানে ব্যক্তিগত আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা কম। সে-রকম একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সর্বোচ্চ পেশাদারী কাজে নিযুক্ত একজন ডাক্তার তাঁর কাজের জায়গায় সহকর্মীদের উপস্থিতিতে নৃশংসভাবে অত্যাচারিত ও খুন হলেন। যারা তুলনামূলক অরক্ষিত পরিসরে নানা কাজে নিযুক্ত এবং যারাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা শুধু হতবাকই নন বরং চরম আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে ডাক্তার, শিক্ষক, অধ্যাপক, শিল্পী এসব পেশার যে কোনও কারণেই হোক একটা আলাদা মর্যাদা আছে। অর্থাৎ ডাক্তার একই সাথে গ্যাংস্টারও হতে পারে, শিক্ষক চোরাচালানেও যুক্ত থাকতে পারে, শিল্পী বা নাট্যকার একই সাথে পকেটমারও হতে পারেন এই সাবলীল আন্তঃপেশার সন্তুরণে বাঙালি বিশেষ একটা স্বচ্ছন্দ নয়। এ কথা ঠিক যে গত দশ-বারো বছরে ভদ্রলোকী সংস্কৃতি, এলিটিজম ও ইন্টেলেকচুয়ালিসমের প্রতিপক্ষে সাবলটার্নদের উত্থানকে খুঁজে পাওয়ার নামে বেশ একটা ‘সব চলতা হ্যায়’ টাইপের মূল্যবোধ আশকারা পেয়ে এসেছে, কিন্তু তার পরেও মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল জাল নম্বর, ওষুধ কেনাবেচা ও সেক্স রাকেটর মাথায় বসে থাকার অভিযোগ সত্যিই বাঙালি মনে যেন রেড এলার্ট জারি করে দিয়েছে। না এতটা হজম করা আমাদের পক্ষে মুশকিল! চতুর্থত, একবার ভেবে দেখুন অভয়ার প্রতি এই অত্যাচার বহুমাত্রিক ক্ষমতার আস্ফালনের সাক্ষ্য বহন করছে। প্রথমত, সে একজন মানুষ হিসেবে দুর্নীতির শক্তপোক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল। তাই অভয়া নারী না-হলেও হয়তো ক্ষমতাধারী চক্রের দ্বারা খুন হতেন। দ্বিতীয়ত, পিতৃতন্ত্রের আস্ফালন– নারী হয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখানো। অতএব ক্ষমতা প্রদর্শন ও প্রতিবাদ দমনের ভাষা হয়ে উঠেছে নৃশংস সমবেত যৌন নিপীড়ন। তৃতীয়ত, অভয়া সাধারণ পরিবারের মেয়ে। এমপি বা এমএলএ অথবা ক্ষমতাসীন কেউকেটাদের ছেলেমেয়েদের উষ্মা ধোপে টেকেনি আর কোথাকার পানিহাটির সাধারণ পরিবারের মেয়ে এই বিস্তৃত দুর্নীতির মায়াজাল ভেদ করার দুঃসাহস করবে এটা মেনে নেওয়া যায় কি? তাই বহুমাত্রিক ক্ষমতার আক্রোশের বলি আমাদের ঘরের মেয়ে অভয়া। শহরজুড়ে ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে নানা ধরনের প্রতিবাদ চলছে। জেনে হোক বা না-জেনে এই প্রতিবাদ রাজনৈতিক। কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা না থাকলেও এই প্রতিবাদ রাজনৈতিক। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন, সাদা-কালো পতাকা নিয়ে যে অভিনব প্রতিবাদ কলকাতা দেখল সেটিও একান্তভাবেই রাজনৈতিক। ঠিক যেমন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের ফুটবল ম্যাচ জেতার একটি তীব্র রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ছিল। সমস্যা হল একদল মানুষ এবং সম্ভবত যারা ক্ষমতার কাছাকাছি রয়েছে অথবা কাছাকাছি যেতে ইচ্ছুক তারা এই আন্দোলনের স্যানিটাইজেশনে [নির্বিষকরণে] ব্যস্ত। অরাজনীতিকরণের বিশেষ প্রটোকল তৈরি হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা থাকবে না, কোনও সরকার বিরোধী স্লোগান চলবে না, মেঘের আড়ালে থাকা শত্রুকে চাক্ষুষ দেখতে পেলেও চিনতে পারা যাবে না, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে গুটিকয়েক লোক ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না, ইত্যাদি। শুধু অভয়ার প্রতি সমব্যথী হয়ে জাস্টিসের দাবি করতে পারবেন এর বেশি একেবারেই নয়। টিভির অনুষ্ঠানের সান্ধ্যকালীন চর্চায় এই আন্দোলন কত বেশি অরাজনৈতিক তা শুধু ঘাড় ধরে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তাই নয়, কোনও দলের নাম ইঙ্গিত করা বা কারোর পদত্যাগ দাবি করা যেন অভয়ার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা মৃতের প্রতি শোক জ্ঞাপনের বিমূর্ত নৈর্বক্তিক অবয়ব নির্মাণের মাঝে খুবই বেখাপ্পা ও অসহ্য লাগছে- এ কথা প্রমাণ করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। অভয়ার মৃতদেহ যখন সরকারি প্রশাসনের সক্রিয় সহায়তায় লুঠ করা হচ্ছিল তখন সেই মৃতদেহের গাড়ি আটকে পরিবারের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়ার জন্য লড়াই করছিল কারা? তারা মীনাক্ষী মুখার্জি ও ধ্রুবজ্যোতি সাহা। এরা কারা? এরা বাম যুব সংগঠনের নেতা, তাই এদের নাম মুখে আনা যাবে না কারণ তাহলেই রাজনীতিকরণ হয়ে যাবে! যে মেডিকেল মাফিয়ারা অভয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ী, যারা পরিকল্পিত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালাবার চেষ্টা করছিল অথবা যে কাউন্সিলরের সক্রিয় সহযোগিতায় অভয়ার মৃতদেহ পরিবারকে না-জানিয়ে তড়িঘড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল এরা কোন দলের? তৃণমূল কংগ্রেসের। ওদের বিরুদ্ধে চিৎকার করে স্লোগান দিলে ওটা রাজনীতি হয়ে যাবে। যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন তাহলে অভয়ার ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে রাজনীতির কলুষ ঢুকে যাবে! অতএব মূল কথা হল এক প্রকার ‘ভ্যানিলা প্রতিবাদ’ চলতে পারে। ওই প্রতিবাদ মিছিলে ঘাতকও থাকতে পারে, শাসক দলের নেতা-নেত্রী, পারিষদ বর্গও থাকতে পারে এবং পিঠ বাঁচাতে থাকতেও হবে। সব মিলিয়ে বেশ একটা সর্বজনীন ব্যাপার। বিমূর্ত জাস্টিসের আহ্বান অথবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা এরকম আরও চলতে থাকবে বেশ কিছুদিন। সমাজের সুবিধাভোগী অংশ এক দিদির খুন ও মৃতদেহ লোপাট করার প্রধান কারিগর প্রশাসনের মাথা আরেক দিদির কাছে আর্জি জানিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে এক ক্লীব প্রতিবাদ জানিয়ে বুঝিয়ে দেবেন আমরা শেষ বিচারে বিপদের কারণ নয়, আমরা বিষধর গোত্রের নই। তাই পুলিশমন্ত্রীও প্রতিবাদ সভা করেছেন। শুধুমাত্র আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে উই ওয়ান্ট জাস্টিস বলে চিৎকার করতে এখনও অবধি দেখা বাকি আছে! এসবের একটা শেষ আছে। প্রতিবাদ সবসময় কোনও দলের পক্ষ থেকেই হতে হবে একথার কোনও মানে নেই। আর দলের পক্ষ থেকে না-হলেই সেটা অরাজনৈতিক এরকম দাবি করারও কোনও কারণ নেই। কিন্তু যেটা সন্তর্পনে চলছে সেটা হচ্ছে শত্রুকে অদৃশ্য করে দেওয়ার রাজনীতি। যৌন অত্যাচারের পাশবিক বিবরণ মানুষকে বিহ্বল করে তুলছে, নারীদের নিরাপত্তা, কাজের জায়গায় সুরক্ষা, রাতে-দিনে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি যথাযথভাবেই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সামনে উঠে আসছে। কিন্তু এই কথাটাও খেয়ালে রাখা দরকার অভয়া মহিলা বলে খুন হননি, অভয়া পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি-চক্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলায় ক্ষমতাবানদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। এই কঠিন সত্যটি যত পিছনে চলে যাবে ক্ষমতাবানদের ততই সুবিধা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে হাসপাতালে নিরাপত্তা বাড়বে, নারীদের জন্য হয়তো আরও বেশি কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকার করবে, কিন্তু যে-বার্তাটি ক্ষমতাবানরা মাথায় গেঁথে দিতে সক্ষম হবে তা হল আপনি নারী হন বা পুরুষ, ক্ষমতার দুর্নীতিচক্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার পরিণতি কিন্তু নির্মম। নারী হলে শুধু খুন নয়, নির্মম যৌন অত্যাচারের পরে খুন! মিছিল একদিন শেষ হবে তারপর ঠিক যেমন বেশ কিছু সারদার চোরেরা দিব্যি মাথা উঁচিয়ে নেতাগিরি করে বেড়ায় অথবা গরু পাচারকারীরা জেল থেকে প্রমাণের অভাবে বেরিয়ে আসে, বিলকিস বানুর হত্যাকারীরা ছাড়া পেয়ে যায়, ঠিক সেইরকমই হয়তো কয়েক বছর বাদে অভয়ার হত্যাকারীরাও ক্ষমতাবানদের সুরক্ষায় জনজীবনে স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে বেড়াবে। বিভিন্ন ধরনের চাকরির পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণে নিজেদের ভবিষ্যৎ খুইয়ে যে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা জাস্টিস চাই বলে চিৎকার করেছিল তারা জাস্টিস পায়নি। কলেজ পড়ুয়া আনিস খানের মা-বাবা আজও জাস্টিস পায়নি, কামদুনির মেয়ে, হাঁসখালির মেয়ে, সন্দেশখালির পিঠে-গড়া মহিলারা কেউ-ই জাস্টিস পায়নি। আজকের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদ, এই উই ওয়ান্ট জাস্টিসের পিছনে আসলে আছে অজস্র ক্ষেত্রে জাস্টিস না-পাওয়ার ক্ষোভ, হতাশা, আশাহতের দীর্ঘশ্বাস। শাসকপক্ষের কেউ তাতে গলা মিলিয়ে যদি ভাবেন গোটা প্রতিবাদটাকেই পক্ষহীন করে তোলা যাবে সেটা হয়তো অতটা সহজ হবে না। প্রশ্ন হল এই নৃশংস হত্যাকারীদের সরকার আড়াল করতে ব্যস্ত কেন? তার একমাত্র কারণ হল ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের দুষ্টচক্রটিকে সুরক্ষিত রাখা। পশ্চিমবাংলায় এই ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের দুষ্টচক্রটির দুটি বাহু। একটি হল এক্সটরশান, যার সহজ উপায় হল ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট লুঠ করা, বা এক কথায় যাকে রাষ্ট্রীয় মদতে তোলাবাজি বলা যেতে পারে। আর অপর বাহুটি হল সরকারি বা বেসরকারি অনুদানের রাজনীতি, যা অধিকারের ধারণা বর্জিত এবং সে-কারণেই একপ্রকার সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক আনুগত্য তৈরি করতে যথেষ্ট উপযোগী। এই দুইয়ের মিশেলই হল পশ্চিমবাংলার বর্তমান শাসকদের ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। এই ব্যবস্থাপনাকে সুরক্ষিত রাখতে যদি অজস্র অভয়াকেও বলি দিতে হয় তাতেও কোনও আপত্তি নেই। মিছিল হবে মোমবাতি জ্বলবে, স্লোগান, কবিতা এই সবকিছুকে অতিক্রম করে অভয়ারা শেষ বিচারে এই দুষ্ট চক্রের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তবেই তো দিদি অপরাজেয় হয়ে উঠবেন। মুশকিল হল ক্ষমতাবানরা চিরকাল এইভাবেই ভেবে এসেছেন। যুগে যুগে শাসকরা ক্ষমতার উপযোগী আখ্যান রচনা করে থাকেন। প্রতিবাদও ক্ষমতার আখ্যানের অধীন হয়ে ওঠে তখনই যখন প্রতিবাদের ভাষা শাসকের কাছে সমর্পনের আদলে তৈরি হয়, যখন প্রতিবাদেও থাকে ক্ষমতাবানদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের ইঙ্গিত, ঘাতককে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা। আর এই ক্ষমতার আখ্যানে সর্বদা অব্যক্ত ও অদৃশ্য করার চেষ্টা করা হয় তাদের যাদের মধ্যে রয়েছে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষার বিপজ্জনক গুণ। কিন্তু এ-কথাও সত্য এবং যা ইতিহাসে একাধিকবার প্রমাণিত তা হল ক্ষমতাহীনদের মধ্যকার এই বিপজ্জনক স্বরের কাঁধে চেপেই বার বার এসেছে আগামীর আহ্বান। তাই আমি এবং আমরা এখনও বিশ্বাস করি যে জল্লাদদের পাশবিক অত্যাচারে নিগৃহীত অভয়ার বেঁচে থাকার শেষ অস্ফূট আর্তনাদ একদিন-না-একদিন আজকের ক্ষমতাহীন বিপজ্জনক অব্যক্ত নামগুলোর মধ্যে দিয়েই বজ্রনির্ঘোষ হয়ে উঠবে। হে ক্ষমতাবানেরা! মনে রাখবেন আমার এই দিদির হত্যা দশ লক্ষ টাকা দিয়েও চুপ করানো যাবে না। অভয়ারা বারবার মাথা তুলে দাঁড়াবেই, অভয়ারা কোনোদিনও মরেনি, অভয়ারা মৃত্যুহীন! সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..