নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গতিপ্রকৃতি
এম এম আকাশ
যেভাবেই (ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা গণঅভ্যুত্থান বা ‘বিপ্লব’) হোক, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর বর্তমানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি ‘নির্দলীয়’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তা স্ব-স্বাক্ষরের মাধ্যমে অনুমোদন করেছেন। সেনাবাহিনী ও প্রশাসন যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে (Formally) রাষ্ট্রপতির আদেশের অধীনে সেহেতু ধরে নেয়া যায় এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুষ্ঠানিক আনুগত্যও রয়েছে। বিদেশিরাও ড. ইউনূসকে পত্র দ্বারা অভিনন্দন জানিয়ে তার নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছেন। এসবই এই সরকারের ইতিবাচক শক্তির দিক।
কিন্তু এই নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার। তাকে নির্বাচন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর সরে যেতে হবে বা নিজেকেই পুনরায় নির্বাচিত করতে হবে। তারা কতদিন পর নির্বাচন দেবেন এবং কখন সরে যাবেন (বা যাবেন না?) সে প্রশ্ন এখনই কেউ কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে তুলতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যেতে উদগ্রীব তারা বেশিদিন ধৈর্য ধরতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না।
বলে রাখা ভাল, বেশিরভাগ সময় আমরা দেখেছি সরকার একবার কায়েম হলে, জনগণ চাইলেও তারা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চান না! আর জনগণ কখন যে তাদের চাইছেন না সেটা প্রকাশের কোনো শান্তিপূর্ণ ভাষা যেমন—: রেফারেন্ডাম বা ভোট ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক সুযোগ না থাকলে জনগণকে আবার পথেই নামতে হয়! এজন্য কোন কোন সংবিধানে নিয়ম করা হযেছে যে, যে কোনো সময়ে শতকরা ৫০ ভাগ ভোটার না চাইলে, তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করতে ও নির্বাচন দিতে সরকার বাধ্য। মার্কস অনুসারীরা এটাকে “Right to Recall at aû time” ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ৫০ ভাগের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে কীভাবে? এ জন্যই যে কোনো ক্রান্তিকালে বিপ্লবের পর বিপ্লবকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পাহাড়া দেওয়ার জন্য বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বদা মাঠে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে সজাগ থাকতে হয় ও বিপ্লবী আন্দোলন জারি রাখতে হয়। ট্রটস্কী একেই নাম দিযেছিলেন “Theory of Permanent Revolution”. এই ধরনের ক্রান্তিকালীন বিপ্লবী ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধ না হলেও, বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের বৈধ ইচ্ছার প্রকাশ হিসাবে স্বীকৃত হয়ে থাকে। যদি কেউ বর্তমানে ড. ইউনূসের ক্ষমতাকে সে ধরনের একটি ক্ষমতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চান তাহলে তাকে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী ক্ষমতা হিসেবে দেখবেন আর এর মেয়াদকাল হবে বিপ্লবী জনআকাঙ্ক্ষাগুলোর মেয়াদকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সেটা ৯০ দিনও হতে পারে আবার ৯০০ দিনও হতে পারে!
এই সরকার হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের একটি ফসল। এর একটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় বাস্তব বৈধতা আছে। জনগণের কতকগুলি জনপ্রিয় সংস্কারের দাবিও ম্যানডেট হিসেবে এর সামনে রয়েছে। হত্যার বিচার হচ্ছে প্রথম দাবি। দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে এক দখলদারের বদলে যেন সমধর্মী আরেক দখলদার প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসতে না পারে। তৃতীয় সবচেয়ে বড় দাবি হচ্ছে একটি বৈষম্যমুক্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে, টাকার খেলাবিহীন, সন্ত্রাসবিহীন, প্রশাসনিক কারসাজিমুক্ত, অংশগ্রহনমূলক, Free and Fair Election অনুষ্ঠিত করা। তাই স্বৈরতন্ত্রেও অবশেষগুলি অপসারণ, স্বৈরতন্ত্র পরিপালন করে যে সব প্রতিষ্ঠান (আইন, বিধি এবং সংগঠন) তা সংস্কার বা তার প্রতিস্থাপন বা তা সম্পূর্ণ দূর করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেমন এ সরকারের দায়িত্ব তেমনই নির্বাচনটি যেন সুষ্ঠু হয় ও নির্বাচনের ফল যেন “পুনর্মূষিক ভবঃ” না হয় সেজন্য ন্যূনতম আশু প্রয়োজনীয় কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করাটাও এই “জন-আকাক্সিক্ষত” সরকারের দায়িত্ব। সরকারপ্রধানকে তাই বলতে হবে তার ন্যূনতম সংস্কার পরিকল্পনাগুলো কী? তখনই বোঝা যাবে ন্যূনতম সময়সীমাটি কী।
ড. ইউনূসও বলেছেন যে তাঁর টিমের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, সন্তানতুল্য ছাত্র-তরুণদের ‘না বলতে না পেরে’ তিনি নিজে এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়েই তিনি চলে যাবেন। অতএব মনে হয় “Kings Party” তৈরির কোনো ইচ্ছা এখন পর্যন্ত ড. ইউনূসের নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে তিনি বা তার টিম রং বদলাবেন কি না সে বিষয়ে আন্দোলনকারীদের অবশ্যই সজাগ থাকা উচিৎ। ড. ইউনূস ব্যতিক্রম হতে পারেন, কিন্তু সে ভরসায় নিশ্চিন্ত থাকা ঠিক হবে না।
আমরা জানি অতীতে, ২০০৬-০৭ সালে সেনাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট শক্তিগুলো ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি সেদিন তাতে সম্মতি না দিয়ে তার ঘনিষ্ট বন্ধু ড. ফখরুদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার বা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পরবর্তীতে বাইরে থেকে তিনি তার সমর্থনও প্রদান করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তখন তিনি ভবিষ্যৎ নির্বাচনে যাতে “যোগ্য প্রার্থীরা” (Clean and Honest) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেজন্য একদিকে যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি আপসের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন। যদি এ প্রস্তাব ব্যর্থ হয় অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলি যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হন তাহলে ব্যাকআপ প্ল্যান হিসেবে পাশাপাশি তিনি সেই সময় জনগণকে চিঠি লিখে দ্রুত একটি তৃতীয় বিকল্প রাজনৈতিক দল তৈরি করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোবাসনাও প্রকাশ করেছিলেন।
এবারো কি একই সমস্যা দেখা দিতে পারে? অর্থাৎ আগাম নির্বাচনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যদি এবারো মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীর বদলে টাকাওয়ালা, পেশীশক্তির অধিকারী ও প্রশাসনিক প্রশ্রয়সম্পন্ন প্রার্থীদেরই অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে এবারো কি তাকে একটি নতুন বিকল্প দল তৈরি করে মাঠে নামতে হবে না? নতুন বিকল্প শক্তি বা দলের প্রয়োজনটি তাই নির্ভর করবে নির্বাচনে অবতীর্ণ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রেণিচরিত্রের ওপর। তাদের শ্রেণিচরিত্র আগের মতই থাকলে যোগ্য প্রার্থীর অভাব আগের মতই থেকেই যেতে পারে।
২০০৬ সালের পটভূমি ছিল সেনাবাহিনীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর এবার পটভূমি হচ্ছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
সেদিন শেষ চেষ্টা হিসাবে ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ড. ইউনূস একটি অভিনব শান্তি ফর্মুলা দিয়েছিলেন—: “সংকট নিরসনে সাতটি প্রস্তাব– অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান, দুই জোট শান্তিচুক্তি করে নির্বাচনে অংশ নেবে, অনধিক দুই বছরের জন্য কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হবে, কে রাষ্ট্রপতি হবেন তা আগেই ঠিক করা হবে, কোয়ালিশন সরকার অভিন্ন বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে, এই সরকার নির্বাচনী সরকার হিসেবে কাজ করবে। এরপর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক বা দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে এবং নির্বাচনের ফলাফল সবাই সানন্দে মেনে নেবে।” কিন্তু সেবার শেষ পর্যন্ত দুই দলের মধ্যে ভাগাভাগির এই সমঝোতা হয়নি, মিলিটারি তখন উভয়ের বিরুদ্ধে ‘মাইনাস টু’ এর চেষ্টা করলে সেটাও সম্ভব হয়নি, ড. ইউনূসের ব্যাকআপ প্ল্যান নতুন রাজনৈতিক শক্তিও কার্যকরী করা যায়নি। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ জুন এই পাঁচ মাস ড. ইউনূস ব্যাকআপ প্ল্যান অনুযায়ী নিজস্ব রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তার সেই বিকল্প রাজনৈতিক দলের নাম দিয়েছিলেন “নাগরিক শক্তি”। বিকল্প নতুন দলের প্রস্তাবিত মতাদর্শ ছিল “সামাজিক উদারনীতিবাদ” (Social Liberalism) যেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির অধীনে ধনী-গরিব, শোষক-শোষিত একত্রে কাজ করবেন, যেখানে রাষ্ট্র হবে ন্যূনতম মাত্রার রাষ্ট্র এবং সিভিল সোসাইটির ধনী-গরিব সদস্যরা যৌথভাবে বা এককভাবে “Social Enterprise” গড়ে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে সমাজে অপার শান্তি ফিরিয়ে আনবে! সেই অল্প সময়ে রাজনৈতিক দলটি গড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে যোগাযোগমাধ্যম, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরের শক্তি, গ্রামীণ ব্যাংক পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও তরুণদের ব্যাপকভাবে কাজে লাগাবেন বলে ভেবেছিলেন। বলাবাহুল্য যে, তার এসব স্বপ্ন সফল হয়নি। মিলিটারিও সেবার সফল হননি। মাইনাস টু (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই দলকে মাইনাস) বা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মৌলিক সংস্কার কোনোটাই উপর থেকে অভিযানের দ্বারা সমাপ্ত করতে পারেন নি তারা। সংস্কার অর্ধসমাপ্ত রেখেই তাদের বিদায় নিয়ে নির্বাচন দিতে হয় এবং মোটমুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। তারপর ১৭ বছর ধরে কী হয়েছে তা সবাই জানেন। সেদিনের ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা কে কোথায় আছেন সেটিও সবার আজ জানা আছে।
কেউ বলতে পারেন অতীতে ব্যর্থ হলেও এবার হয়তো ড. ইউনূস সফল হবেন। ড. ইউনূস ১৭ বছর পর এবার আবার সুযোগ পেয়েছেন তার এবং তার মিত্রদের নিয়ে স্বপ্ন সফল করার। একজন উদারনৈতিক, সামাজিক স্বার্থ সচেতন, প্রয়োগমুখী ও পাশ্চাত্যমুখী শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো বা বামপন্থি কোনটির প্রতিই হয়তো পক্ষপাতিত্ব পোষণ করেন না। বিদেশিদের মধ্যে নিঃসন্দেহে আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বন্ধুদেরই (ক্লিন্টন পরিবার) তার বেশি পছন্দ। চীনের সঙ্গে তার মাখামাখি নেই বলেই শোনা যায়। ভারতের সঙ্গে তার অম্ল-মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশের ভেতরে তার প্রতি এখন পর্যন্ত একটি জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানের জনপ্রিয় সামাজিক সমর্থন রয়েছে। এবার তাই ২০০৬ সালের তুলনায় তার ভিত্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রথমতঃ এবার “মাইনাস ওয়ান” অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বিপর্যয় আগেই সম্পন্ন হয়েছে, দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন তাকে হতে হচ্ছে না, তৃতীয়তঃ আমেরিকা দৃঢ়ভাবে তার পক্ষে আছেন, চতুর্থতঃ ছাত্র শক্তি ও অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজ তার পক্ষে এখনো রয়েছেন। কিন্তু এত সবের পরেও ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ফলাফল বা পরিণতি কিন্তু নির্ভর করবে, মাঠে এখনই উপস্থিত ট্রাডিশনাল রাজনৈতিক দলগুলির (ধর্মভিত্তিক দল/ মডারেট ধর্মভিত্তিক দল/ বামপন্থি দল/ নাগরিক ও জনগণের আন্দোলন) আন্তঃসম্পর্ক ও শক্তি ভারসাম্যের ওপর। এই রাজনৈতিক জায়গাটায় এখনো একটা অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
ড. ইউনূসকে যতটুকু জানি তিনি এমন একজন লোক যিনি কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করলে তা আলংকারিক দায়িত্ব না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি দায়িত্ব নিলে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলি করার লক্ষ্যে টিমকে নিয়ে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করবেন এবং যতদিন দরকার হবে ততদিন থাকার চেষ্টাও করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত (Expected)। তবে সংবিধানে সংসদ ভাঙার পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্ভবতঃ এখনো রয়ে গেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে সব সংস্কার আদৌ শেষ হবে না। এই সাংবিধানিক জটিলতা আগামীতে নিরসন করতে হবে।
সংস্কার করে অন্তর্বর্তী সরকারের হাত থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হচ্ছে বর্তমানে ঘোষিত লক্ষ্য। সুতরাং কী ধরনের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা যাবে তার উপরই নির্ভর করবে দেশের বা আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ভবিষ্যৎ। ছাত্রদের মধ্য থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তার শক্তি কতটুকু হবে সেটিও বিবেচ্য। ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন— ভবিষ্যৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক শক্তি ভারসাম্য কোন দিকে যায় তার ওপর অনেককিছু নির্ভর করবে। সুতরাং একটি বিকল্প প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান তাই জরুরি হয়ে উঠেছে।
যেসব উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি যারা আগে কখনো রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসেননি বা এতকাল আপেক্ষিকভাবে স্বচ্ছ রাজনীতি চর্চা করেও ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে পারেন নি অথবা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পরীক্ষিত হওয়ার সুযোগ পান নি, তাদের মধ্যে আছেন—: বিক্রি না হওয়া বামপন্থিরা, সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকারসম্পন্ন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, সংস্কারের কর্মসূচির প্রতি অঙ্গীকারসম্পন্ন শ্রমজীবী জনগণ (শ্রমিক ও কৃষক), এনজিও, নাগরিক সমাজ, মধ্যবিত্ত ও ধনীদের মধ্যে সেসব ব্যক্তি এবং উৎপাদনশীল ধনিকবৃন্দ। এক কথায় যারা অতীতে যেসব দল ক্ষমতায় থেকে স্বজন তোষণের রাজনীতি অনুসরণ করেছেন বা যারা একে অপরের প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে চেয়েছেন, যারা ডাইনাস্টিক রাজনীতির চর্চা করেন বা মতাদর্শগতভাবে ধর্মীয় জঙ্গিপনা বা এক ধরনের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ চর্চা করেন তারা ছাড়া বাকি সকলেই ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বিকল্পের রাজনৈতিক অংশীজন হতে পারেন। এদের সংগঠিত নেটওয়ার্কই পারবে সংস্কারকে এগিয়ে নিতে এবং তাকে রক্ষা করতে। সুতরাং এখন পর্যন্ত এরকম পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যের ওপরই নির্ভর করবে ড. ইউনূস ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভবিষ্যৎ যাত্রা। বিদেশি এজেন্সিগুলো ও সেনাবাহিনী এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যতদিন সমর্থন দেবেন ততদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ড. ইউনূসকে নিয়ে টানাটানি চালু থাকবে।
পরাজিত আওয়ামী লীগের কী প্রতিক্রিয়া হয় তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে। সেনাবাহিনীর মতামত এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অজানা চলক। সর্বত্র এই মুহূর্তে এক “দখলদারের” বদলে আরেক “দখলদার” ক্ষমতা নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা আটকানোর ওপর আবার ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে।
তবে সংস্কারগুলো যদি ফলপ্রসূ হয়, দ্রুত কার্যকর হয় ও সংস্কারের পক্ষে জনমত যদি ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে তাহলেই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মদান স্বার্থক হবে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি
Login to comment..