কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সমাবেশ একতা প্রতিবেদক :
শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নেমেছে শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, কলাকুশলী, অভিনেতা, শিল্পী, আটিস্ট, গায়ক, লেখক, গবেষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, নারী, শিক্ষার্থী, অধিকার কর্মী, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সচেতন নাগরিক, অভিভাবক, শ্রমিক, অধিকার কর্মীসহ দেশের প্রগতিশীল পেশাজীবি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সরকারের হত্যা-গুম, মামলা-হামলা, নির্যাতন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় উঠিয়ে নেয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গান, কবিতা, ছবি আকার মতো বিভিন্ন মাধ্যমে সরব হয়েছেন শিল্পী সংগঠকরা। মিডিয়া পাড়াজুড়েও আন্দোলন শুরু হয়েছে। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে গত ১ আগস্ট রাজপথে নামেন চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, থিয়েটারসহ শোবিজের নানা অঙ্গনের কর্মীরা।
সমাবেশে অভিনেতা ও নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘গত জুলাই মাসব্যাপী কী ঘটনাগুলো ঘটেছে, কত প্রাণ গেছে! এর মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। এই বেদনা প্রকাশ করার ভাষা আমাদের নেই।’
অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে আমরা সকল মানুষের পক্ষে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের আর ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থা নেই। আমরা শান্তি চাই। আমরা সকল নির্যাতন, গোলাগুলি, হত্যা, রক্ত- এগুলো আর দেখতে চাই না। আমরা শান্তি চাই।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে মনে করে উদীচী। জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করে এসব ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গত ২ আগস্ট সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সমাবেশে এসব কথা বলেন উদীচীর নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশস্থলের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি প্রতিকী কফিন রাখা হয়। বৈরি আবহাওয়া উপেক্ষা করে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। এতে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদার, জামসেদ আনোয়ার তপন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নান্নু, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এনামুল হাসান অনয়, শ্লোগান কন্যাখ্যাত লাকী আক্তার প্রমুখ।
এসব হত্যাকাণ্ডের দায় কাঁধে নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পদত্যাগ করা উচিত। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার রাখে না বলে মন্তব্য করেন তারা। তারা বলেন, যখনই মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তখনই কোন না কোন ইস্যুকে সামনে এনে মানুষের মনোযোগ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।
উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন এবং বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির আন্দোলনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ের পরপরই সরকার চাইলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে পারতো। কিন্তু এখন এটিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে সরকার। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকে ইতিববাচক হিসেবে দেখলেও উদীচী মনে করে, সরকারের উচিত বাহাত্তরের সংবিধানকে পূর্ণাঙ্গরুপে প্রতিষ্ঠা করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
এর আগে উদীচীর সাংস্কৃতিক সমাবেশে বাধা প্রদান করে পুলিশ। গত ২৯ জুলাই বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংস্কৃতিক সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উদীচীর নেতা-কর্মীরা। এজন্য শব্দযন্ত্রের গাড়িও সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদেরকে প্রেসক্লাব এলাকা থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কজুড়েই অবস্থান নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া, উদীচীর নেতা-কর্মীসহ কোন মানুষকেই ওই চত্বরে যেতে দেয়া হয়নি। এজন্যই সাংস্কৃতিক সমাবেশ স্থগিত করে উদীচী। পরে, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীতে ফুটপাতে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।
৩০ জুলাই বিকাল ৩টায় ঢাকায় প্রতিবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের ব্যানারে এদেশের বাম-প্রগতিশীল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদী গানের মিছিল বের করলে পুলিশী বাধায় তারা অগ্রসর হতে পারেনি। রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী এসব আচরণের প্রতিবাদ করেছিল শিল্পীরা। তাদের হাতে ছিল না অস্ত্র, তবে তারা তাদের কলম, কবিতা, গান, চিত্র এসব নিয়ে পুলিশী বাধায় বাধ্য হয়ে গুলিস্তান মোড়ে বসেই প্রতিবাদী সমাবেশ করেন। গানের ভাষায় প্রতিবাদ জানাই স্বৈরাচারী সরকারের হত্যা, দমন-পীড়নকে।
এতে বক্তব্য রাখেন বিবর্তন-এর মফিজুর রহমান লাল্টু, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর জাকির হোসেন, কামাল হোসেন বাদল এবং গণসংস্কৃতি কেন্দ্র-এর জাকির হোসেন। সমাবেশে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন সায়ান, কৃষ্ণকলি, আমিরুন নুজহাত মনীষা, মীর সাখাওয়াত, শাওন, সুস্মিতা কীর্তনিয়া প্রমুখ।
কবিতা আবৃত্তি করেন দীপক সুমন, হাসান ফকরি, সুষ্মিতা রায় সুপ্তি। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি জামসেদ আনোয়ার তপন।