মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, তাহির জামান প্রিয়, রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ একতা প্রতিবেদক :
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন লুটিয়ে পড়ছিলেন তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। গত ১৮ জুলাই মুগ্ধর রক্তে যখন রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল, তখন তার বন্ধুরা বহু সংগ্রাম করেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। মুগ্ধর বন্ধু আশিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর রিকশায় করে মুগ্ধকে নিকটস্থ ক্রিসেন্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মুগ্ধ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার উত্তরা এলাকায়। তার বাসাও সেখানে। যেদিন মুগ্ধ মারা যান, সেদিন রাজধানী ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। সংঘাত ছড়িয়েছিল শহরের অলিগলিতে।
মুগ্ধ যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তখন তার কাছাকাছি ছিলেন বন্ধু জাকিরুল ইসলাম। মুগ্ধর কপালে গুলি লাগার দৃশ্য তিনি বিবিসি বাংলার কাছে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘গুলি লাগছিল কপালে, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে...ডান কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে। গুলি লাগার পর ওর মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছিল। ঘটনাস্থলেই, আমাদের চোখের সামনেই ও মারা গেল।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুগ্ধ সবাইরে পানি খাওয়াইতেছিল। আমাদের কাছে না ছিল কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, না ছিল অন্য কোনোকিছু। তারপরও এইভাবে আমার বন্ধুরে গুলি করে মাইরা ফেলাইলি? আমার সামনে ঘটে যাওয়া এ সিন আমি কিভাবে ভুলি?’
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। গত মার্চে তিনি ভর্তি হন বিইউপিতে।
দেশজুড়ে চলমান কারফিউয়ের মাঝে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ২০ জুলাই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। তার বন্ধুরা বলছেন, মৃত্যুর পর তার লাশ সড়কেই পড়ে ছিল। কেউ হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। বরং পরে তার লাশের সন্ধান মেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।
ফারিয়া উলফাত সৈয়দ নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ঢাকার গ্রিন রোডের ল্যাবএইডের পেছনে বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি তাহির জামান প্রিয়কে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন। তারা একসাথেই ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ফারিয়া উলফাত সৈয়দ লেখেন, ল্যাবএইডের পেছনে পুলিশের ঘেরাও করে রাখা একটি রাস্তায় একজন মানুষ ‘একটা বডি টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করছে। আর, হাত দিয়ে ডাকছে...উনাকে হেল্প করতে। আমি সবার পেছনে থাকায় দেখতে পাই। সাহস করে উনাকে হেল্প করতে একটু কাছে যেতেই দেখি মানুষটার মাথার পিছন জুড়ে রক্ত, নিথর দেহ...মানুষটা প্রিয় ভাই...দুই মিনিট আগে আমাকে যে একসাথে থাকতে বলল।’
তাহির জামান প্রিয় যখন মারা যান, তখন দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তার অনেক বন্ধু তার মৃত্যুর খবর পাননি, শেষ বিদায় জানাতে পারেননি। ২৪ জুলাই থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ কিছুটা চালু হলে একসময়ের কাছের বন্ধু ‘প্রিয়’র মৃত্যুর খবর জানতে পারেন মেহেরুন নাহার মেঘলা। তিনি আফসোস করে বিবিসিকে বলেন, ‘আজ পাঁচদিন পর জানতে পারলাম– প্রিয় আর নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওরা তিনজন ছিল। একজনের হাত ঘেঁষে ওর মাথায় গিয়ে গুলি লাগছে। লাশটা পড়ে ছিল। গোলাগুলির মাঝে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। দুইদিন পরে পরিবার লাশ নিতে পারছে।’ প্রিয়র ছয় বছর বয়সী কন্যা সন্তান থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটাকে মাত্র একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করছিল। প্রিয়ই ওর বাবা-মা ছিল।’
প্রিয়র মৃত্যুর দুদিন আগে, ১৮ জুলাই ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের (ডিআরএমসি) ছাত্র ফারহান ফাইয়াজও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে নিহত হন। বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র ফাইয়াজের বন্ধুরা বিবিসি বাংলাকে জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফাইয়াজকে সিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।
ফাইয়াজের এক বন্ধু ও ডিআরএমসির শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা একই জায়গায় আন্দোলন করছিলাম। আমি কাছাকাছিই ছিলাম। হঠাৎ শুনি ওর গুলি লাগছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বুলেটও বের করে নাই...অনেকে বলছে রাবার বুলেট ছিল।’
টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ গত ১৯ জুলাই দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার বোন শিমু আহমেদ ফেসবুকে লেখেন, ‘আমার ভাইকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের হাসিখুশি পরিবার এক সেকেন্ডে শেষ।’