প্লাস্টিক বর্জ্যে কতটা তলিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব

শামীমা ইসলাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

কোথাও তীব্র দাবদাহ তো কোথাও ভয়ংকর বন্যা, সেইসাথে মাত্রাতিরিক্ত হারে গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। এই যখন বৈশ্বিক আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা তখন নিজেদের প্রয়োজনেই প্রকৃতি আর পরিবেশ নিয়ে একবার ভাবা উচিৎ বৈকি। সাম্প্রতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান উপাদান প্লাস্টিক। শুধু সমতল নয়, সাগর-মহাসাগর ছাড়িয়ে প্লাস্টিক এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টের পরিবেশকেও বিপর্যস্ত করছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়। যার অর্ধেকই ব্যবহার করা হয় একবার। উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুন:ব্যবহার হয়। প্রতি বছর আশি থেকে দেড়’শ লাখ টন প্লাস্টিক ফেলা হয় সমুদ্রে। সমস্ত সামুদ্রিক দূষণের ৮০ শতাংশই ঘটে এই প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে। যদি এসব প্লাস্টিক এক জায়গায় বিছিয়ে রাখা হয় তবে এটি ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ঢেকে ফেলার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ এই প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে যাবে কাতার, জ্যামাইকা কিংবা বাহামার মতো ছোট দেশগুলো। এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সাগরে ৫ লাখ ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে প্লাস্টিক বর্জ্য। বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী, সায়েন্স অ্যাডভান্সেস রিসার্চের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্রে পাওয়া ৮০ শতাংশ প্লাস্টিকের জন্য দায়ী এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো। মহাসাগরে প্রাপ্ত সমস্ত প্লাস্টিক বর্জ্যের এক তৃতীয়াংশের বেশি আসে ফিলিপিন্স থেকে। তালিকায় এরপরেই আছে ভারত, মালয়েশিয়া, চীন এবং ইন্দোনেশিয়া। কিছুটা হলেও দূষণ কমাতে সাগর জলে ভেসে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। মহাসাগরে যত প্লাস্টিক পাওয়া যায় এর ৯৯ শতাংশই ভূপৃষ্ঠের নিচে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আল জাজিরা জানিয়েছে, বর্তমানে সাগরে ভাসমান কিংবা তলদেশে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যরে সাথে প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরো আছে। এইসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। মহামূল্যবান প্রবালসহ অস্তিত্ব হারিয়ে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণী। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যা ৩০০ কোটি মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের আশংকা, এই অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের সাগর ও মহাসাগরগুলোর পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ প্রকৃতিতে অক্সিজেনের প্রায় ৫০ শতাংশ তৈরি করে সমুদ্র। আর প্রকৃতিতে থাকা মোট কার্বন ডাই অক্স্রাইডের ৩০ শতাংশ শোষণ করে সাগর-মহাসাগরগুলো। ১৯৫৩ সালে প্রথমবার মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ পবর্তশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে। সত্তর বছরেই পর্বতারোহীদের ফেলা আসা বর্জ্যে রীতিমতো আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে তুষার রাজ্য এভারেস্ট। শুধু এভারেস্ট না, আবর্জনার স্তুপ এখন সমগ্র হিমালয় রেঞ্জ জুড়েই। আট হাজার মিটারের এই পবর্তের প্রায় পুরোটাই আবর্জনায় ঢেকে গেছে। গত কয়েক দশক ধরে বাণিজ্যিক আরোহণের ফলে মানববর্জ্যরে সাথে হাজার হাজার পর্বতারোহীর ফেলে যাওয়া জুতা, তাঁবু, অক্সিজেন সিলিন্ডারে এভারেস্ট হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভাগাড়। নেপালের সাগরমাতা পলিউশন কন্ট্রোল কমিটির তথ্য অনুযায়ী, মাউন্ট এভারেস্ট অঞ্চলে প্রতিবছর দুশো টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ১১টন বর্জ্য অপসারণ করার সক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির। বর্জ্য পরিস্কারে গত কয়েক বছর ধরে এভারেস্টে মৌসুমি অভিযান চালাচ্ছে নেপাল সরকার। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১৩ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্যক্তি উদ্যোগে আবর্জনা পরিস্কারে নেমেছেন শেরপারা। এভারেস্ট ট্রেকিংয়ে পর্বতারোহীরা যে বর্জ্য ফেলেন তা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কাছে আরোহণের আগে ৪ হাজার ডলার জমা রাখার নিয়ম রয়েছে। আবর্জনা নিয়ে আসলে, তবেই ফেরত দেয়া হয় অর্থ। তবে এতোসব বিধিনিষেধেও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ফলে পর্বতচূড়াতেও মিলছে প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশ বা ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। মাউন্ট এভারেস্ট অঞ্চলে প্রতিবছর দুশো টন বর্জ্য তৈরি হয়। আর বাতাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ফলে প্লাস্টিকের দূষণ কেবল ঘুরপথে নয়, সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সমুদ্র-মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, মাছ ও সামুদ্রিক-প্রাণীর জীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। কেবল ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী নয়, বিশাল তিমি মাছও প্লাস্টিক দূষণে মারা পড়ছে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..