শুধু কামড়ায় না, অনেক উপকারও করে

ফয়সাল হায়দার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

পিঁপড়া বা পিপীলিকা খুবই পরিচিত একটি কীট। আমাদের চারপাশে সবখানে পাওয়া যায়। পিপীলিকা দেখেননি এমন কোনো মানুষ পৃথিবীতে আছেন কিনা সন্দেহ। যদি এমন হয় যে আছেন, তবে তিনি কোনও শীতল আবহাওয়ার দেশে থাকেন কিংবা তিনি দুর্ভাগা যে তার চোখের আলো নেই। শীতল আবহাওয়া বলতেই মনে পড়ে গেল- পিপীলিকা, পিপীলিকা; দলবল ছাড়ি একা; কোথা যাও, যাও ভাই বলি।; শীতের সঞ্চয় চাই খাদ্য খুঁজিতেছি তাই; ছয় পায়ে পিলপিল চলি। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-এর লেখা কাজের লোক কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। কবি ও কবিতার নাম মনে না থাকলেও লাইনগুলো তো মনে আছে। ঠিক কি না? সে যাই হোক। পিপীলিকা বা পিঁপড়ার দেখা প্রাকৃতিক পরিবেশ বলুন কিংবা মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশ বলুন, সবখানেই পাওয়া যায়। রানারের মতো ছুটে চলে সারাক্ষণ। তবে এই ছুটে চলা মূলত খাবারের জন্য, খবরের জন্য নয়। পিল পিল করে চলা এই কীট থেকে মানুষ নানান কিছু শিখেছে। না শিখলেও, পরীক্ষায় পাশের জন্য ঠিকই লিখেছে, কি তাই না? লিখেননি? তবে অধ্যাবসায়, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা রচনায় কী লিখেছেন মশাই! পরীক্ষা ও বাংলা রচনা বাদ দিলাম। এবার একটু অন্য কথায় আসি। আচ্ছা, মাথায় কি কখনও ঘুরপাক খেয়েছে এমন প্রশ্নের যে পৃথিবীতে পিঁপড়ার সংখ্যা কত? খানিকটা মাথা চুলকে বলতে পারেন অনেক অনেক অনেক অনেক। অনেক কত জিজ্ঞাসা করলে কী বলবেন? দাঁড়ান, আপনি কি আমার বিসিএস ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন? জ্বি না, তা নিচ্ছি না। কৌতুহল থেকে জানতে চাচ্ছি আর কি? বিসিএস-এর কথা বলার পরে সকল পিঁপড়ার ওজনই বা কত হবে, এই প্রশ্নটি করার সাহস হচ্ছে না! আপনার কিংবা আমার কৌতূহল না থাকলেও বিজ্ঞান ও এর চালিকাশক্তি (আদতে, কামলা। বিশ্বাস না হলে তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করুন, কেমন খাটা-খাটুনি করতে হয়।) মানে বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে ভেবেছেন। এই তো আপনার সংলাপটি পেয়ে গেছেন। মনে মনে বলে উঠেছেন, ওদের কাজই তো ওটা। কেউ কেউ মনে মনে বলছেন পাগল, আঁতেল, ...। তাদের জন্য আপনার বরাদ্দকৃত বিশেষণ পদ যাই হোক না কেন, একদল বিজ্ঞানী হিসেব কষে দেখেছেন পৃথিবীতে পিঁপড়ার সংখ্যা ২০ কোয়াড্রিলিয়ন। এই আবার কত? বলছি– ২০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০। আচ্ছা, আরেকটু সহজ করে দেই বুঝার সুবিধার জন্য। পৃথিবীতে পিঁপড়ার সংখ্যা ভারতীয় গণনা পদ্ধতি অনুসারে ২০ পদ্ম, মানে ২০ হাজার লাখ কোটি। জার্মানির জুলিয়াস ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটি অব ওয়ার্জবার্গের এক দল গবেষক এই হিসাবটি করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পিঁপড়ার সংখ্যা সম্পর্কে প্রকাশিত ৪৮৯টি গবেষণাপত্র থেকে সংগ্রহ করা পরিসংখ্যানকে প্রথমে তারা একত্রিত করেন। একত্রিত করা সংখ্যাগুলোকে এরপর পৃথিবীর আকারের নিরিখে হিসেবে-নিকেশ (এক্সট্রাপোলেট) করা হয় এবং এর মাধ্যমেই ২০ পদ্মা বা ২০ হাজার লাখ কোটি সংখ্যাটিতে পৌঁছেছেন গবেষক দলটি। সব কীট, নরকের কীট নয় বিজ্ঞানীরা পিঁপড়ার প্রকৌশল দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হতে পারেন। কিন্তু, বাস্তুতন্ত্রে এই কীটের ভূমিকা পরিমাপ করতে হলে এদের সংখ্যা জানাটা অত্যাবশ্যক। গ্রীষ্ম এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়। তবে, আবাসস্থল ভেদে এদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য তারতম্য দেখতে পাবেন। জার্মানির গবেষক দলটি তাদের গবেষণায় যে ৪৮৯টি গবেষণা পত্র ব্যবহার করেছেন, তাতে পৃথিবীর সকল মহাদেশের পিঁপড়ার সংখ্যা, প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক পরিবেশ (বায়োম) এবং আবাসস্থলের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন। তাদের সাবধানী অনুমান অনুসারে পৃথিবী নামক এই গ্রহে মাটিতে বসবাসকারী পিঁপড়ার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার লাখ কোটি। আর মানুষের জানা মতে মানে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন ১৫ হাজার ৭০০টিরও বেশি পিঁপড়ার প্রজাতি। আমাদের জানার বাইরেও থাকতে পারে আরও অনেক প্রজাতির পিঁপড়া। আর সংখ্যাটি পরিসংখ্যানগত দিক থেকে একটি অনুমিত সংখ্যা। প্রজাতির সংখ্যা কিংবা মোট সংখ্যা যাই হোক না কেন, পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবশে রক্ষা ও বিকাশে পিঁপড়ার অবদান অনস্বীকার্য। পিঁপড়ার না থাকলে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের প্রাচুর্যে ভরা এই পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে প্রাণহীনতার খরা। বীজ ছড়ানো, মাটিতে অক্সিজেন ও পানির সঞ্চয়ন, জৈব পদার্থের রূপান্তর থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় নানাবিধ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই ছয় পায়ের কীট। পৃথিবীর সব পিপীলিকার ওজন কত শুধু সংখ্যা গণনা করেই গবেষক দলটির কৌতূহল মেটেনি, তারা পৃথিবীর সকল পিঁপড়ার ওজনও বের করেছেন। এটা পড়ার পর বলতে পারেন, নাই কাজ তো খই ভাজ আর কি! আপনার অভিমত সাদরে সমাদৃত। পৃথিবীর সকল পিঁপড়ার ওজন ১২ মেগাটন । তবে, পৃথিবীর সকল পিঁপড়ার ওজন জানলে আপনি চমকে উঠতে পারেন! ওই গবেষকদের পরিমাপ অনুসারে, তাদের গণনাকৃত ২০ হাজার লাখ কোটি পিঁপড়ার ওজন ১২ মেগাটন বা ১২ লাখ মেট্রিক টন। কেজির হিসাব অনুসারে এক হাজার ২০০ কোটি কেজি। সংখ্যাটি পড়ার পর মনে হতে পারে কিংবা বলতে পারেন, এটা চমকে ওঠার মতো এমন কী মশাই? হাজার, লাখ, কোটি সাধারণত আমার টাকা গুণতে ব্যবহার করি তো, তাই এক হাজার ২০০ কোটি তেমন কোনো কিছুই মনে হয় না। হবেই বা কীভাবে? প্রতি বছর দুর্নীতিই হয় লাখ লাখ কোটি টাকা। সংখ্যা দেখে না চমকানো, তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, আরও একটা সংখ্যা জানালে, না চমকালেও বেশ চমকপ্রদ মনে হবে কিন্তু। পৃথিবীর সকল বনের পাখি ও স্তন্যপায়ীদের সম্মিলিত ওজন নয় মেগাটন বা ৯ লাখ মেট্রিক টন অথবা নয় শত কোটি কেজি। অর্থ্যাৎ পিঁপড়ার থেকে কম। তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষের ওজন কত? বলছি। পৃথিবীর সকল মানুষের ওজন ছয় হাজার কোটি কেজি বা ৬০ মেগাটন। এমনি এমনি তো আর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে না! পিপীলিকার গল্প এখানেই শেষ নয়! ওই গবেষণা সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, বনাঞ্চলে পিঁপড়ার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। আর, শুষ্ক অঞ্চলের স্থলভাগে এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এতদসত্ত্বেও, এই চিত্র পুরো চলচ্চিত্র নয়? আরও আছে। গবেষক দলটি কেবলমাত্র মাটিতে থাকা পিঁপড়ার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গবেষণাপত্রটি লিখেছেন। অর্থ্যাৎ এতে মাটির নিচে এবং গাছ-পালায় থাকা পিঁপড়াদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উপরন্তু, আফ্রিকা এবং উত্তর এশিয়া থেকে পিঁপড়ার সংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য ছিল সীমিত। গবেষক দলের সদস্য প্যাট্রিক শুলথাইস-এর মতে, এটির মানে হল যে পিঁপড়ার সংখ্যা এবং তাদের সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের জানা-বোঝায় এখনও বড় পার্থক্য রয়েছে। গবেষণার নমুনা সংগ্রহের ভৌগলিক অবস্থান। শুলথেইস ও তার দল, পিএনএএস তারপরেও, বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে পিল পিল করে ছয় পায়ে চলা এই কীটের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যার অনুমানটি তাদের বসবাসের বিস্তৃতি বিষয়ক ধারণার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। ভবিষ্যতে, গবেষকরা পিঁপড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে কী পরিবর্তন হয়েছে তা নির্ধারণ করতে এবং এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে একই জায়গায় এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে তুলনামূলক চিত্র অবলোকন করতে পারবেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..