প্রকৃতি বনাম পুঁজিবাদ

একতা ফিচার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

প্রকৃতির সম্পদ নিজের বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহার করা জীবজগতের সাধারণ রীতি, যার মধ্যে পড়ে জল, মাটি, হাওয়া ইত্যাদি। আমরা এ-ও জানি যে এর মধ্যেই রয়েছে এক নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্র, যেমন উদ্ভিদের ফল, পাতা খেয়ে নিরামিষাশী প্রাণীর বেঁচে থাকা, আবার তাদের খেয়ে মাংসাশী প্রাণীর বেঁচে থাকা। সেই আদিমকাল থেকে মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষও এই স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের অংশ ছিল, প্রকৃতির সাথে ছিল তার এক সাধারণ বিপাকীয় সম্পর্ক (Natural Metabolism)। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী কি সাধারণভাবে আজো নিজের ইচ্ছামত কোন জায়গায় নির্দিষ্ট গাছ লাগিয়ে তার ফসল আহরণের চেষ্টা করেছে (কৃষি) বা অন্য পশুকে পোষ মানিয়ে তার কোন গুণাবলী বা শক্তিকে নিজের সুবিধায় ব্যবহার করেছে (পশুপালন বা উৎপাদন/পরিবহণে তার ব্যবহার)? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল- ‘না’। কিন্তু এটাই তো মানুষের বৈশিষ্ট্য যা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তাকে সমগ্র জীবজগতের মধ্যে বিশিষ্টতা দিয়েছে এবং তা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে হয়নি, যেমন এককোষী অ্যামিবার তুলনায় শিম্পাঞ্জী অনেক বেশী উন্নত প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। কার্ল মার্কস তাঁর সুবিখ্যাত ‘পুঁজি’ (Capital) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলছেন যে এতদূর পর্যন্ত মানুষের সাথে প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি। কিন্তু এরই ভেতরে একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর তা হল ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপত্তি (ভাবুন আর কোন জীব নিজের উত্তরপুরুষের জন্য সম্পদ জমিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে?) যেখানে প্রতি ব্যক্তি নিজের বা নিজের বংশজের জন্য নির্দিষ্ট করে আরও বেশি সম্পদ আহরণের চেষ্টা করে, এবং বস্তুতঃ শক্তিশালী-দুর্বল, পুরুষ-নারী, লম্বা-বেঁটে ইত্যাদি ব্যবধান-নিরপেক্ষভাবে একটা সম্মিলিত প্রজাতি হিসেবে বাঁচার প্রাকৃতিক বন্দোবস্তকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। প্রজাতির মধ্যেই একে-ওপরের বিরোধ বাধে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয়ের চেষ্টা নিয়ে যা মানব সভ্যতার চলনের এক কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে। এবং কোনো সন্দেহ নেই যে এই ভাবনারই এক চূড়ান্ত ফল হল আধুনিক পুঁজিবাদ যা প্রকৃতির ওপরে অত্যাচারকে নিয়ে গেছে এক চরম সীমায় আজ মানুষ উন্নত বিজ্ঞানের সহায়তায় জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ধানের গড়ন বদলে দেয়, সে শুধুমাত্র উদ্ভিদ নয়, ইচ্ছেমতো পশুও চাষ করে, গরু-শুয়োর বা ছাগলের শরীরে বেশি মাংস চাপায় যাতে তার রসনার তৃপ্তি হয়। আবার মার্কসের কথা ধার করে বলা যায় যে, আধুনিক পুঁজিবাদ মানুষকে প্রকৃতির সাথে বিপাকীয় সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নিল (Metabolic Rift) মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে না দেখে প্রকৃতির প্রভু ভাবতে শুরু করল, যেন সে প্রকৃতি-নিরপেক্ষভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম, পুরো জীবজগৎ ধ্বংস হয়ে গেলেও যেন তার কিছু যায়-আসে না। বর্তমান পৃথিবীর ‘পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা’ আসলে এরই ফসল। চারদিকে তাই আলোচনা দেখা যাচ্ছে যে কীভাবে এমন শক্তি (Energy) উৎপাদন করা যায় যা আগের মত প্রকৃতির অতটা ক্ষতি করবে না। চতুর্দিকে চেষ্টা চলছে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, সমুদ্রশক্তি, ইত্যাদিকে আর্থিকভাবে লাভজনক করে উৎপাদনের। অর্থাৎ মানবসভ্যতার নিয়ন্ত্রকরা এখনো ব্যবস্থার মুনাফাকেন্দ্রিক গতিপথ পাল্টানোর কথা ভাবছেন না, চেষ্টা করছেন শুধু প্রকরণগুলিকে খানিকটা বদলে নেওয়ার। যেমন কয়লাখনি নির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে না, বদলে সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি বা পরমাণুশক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে, অথবা তেল দিয়ে গাড়ি না চালিয়ে ব্যাটারি দিয়ে বা হাইড্রোজেন দিয়ে চালানো হবে ইত্যাদি। এই ভাবনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশ্বাস কাজ করছে এবং সেটা হল পুঁজিবাদী যে ব্যবস্থাটার ওপর গত ২০০ বছর পৃথিবী চলছে সেটার সাথে প্রকৃতির কোনো মূলগত বিরোধ নেই, উৎপাদন প্রকরণগুলো খানিকটা বদলে নিলেই একটা সমঝোতা সম্ভব যাতে করে প্রকৃতি ও পুঁজিবাদ অনায়াসেই সহযাত্রী হতে পারে, কোথাও কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের দেশে এখনো বিষয়টি বেশ অগভীর ভাবনার জায়গা থেকে ‘পরিবেশ বনাম উন্নয়ন’ হিসেবে রাখা হলেও, পৃথিবীর বহু মানুষ অনেকটা তলিয়ে দেখে বলছেন যে বিষয়টা আসলে ‘প্রকৃতি বনাম পুঁজিবাদ’। স্বভাবতই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সুবিধাভোগীরা (তার মধ্যে আমরাও অনেকে হয়তো পড়ি) ব্যাপারটা সেভাবে দেখতে রাজি নন, তাঁরা পুঁজিবাদী উন্নয়নের পক্ষে, শুধুমাত্র কিভাবে ঘরের বাতানুকূল যন্ত্রটিকে চালিয়ে রেখেই ‘বেজায় গরম’, দূষিত হাওয়া’, ‘বন্যা’, ‘সাইক্লোন’, বা ‘পৃথিবী ধ্বংস’ গোছের ঝামেলাগুলো এড়ানো যায় তার রাস্তা খুঁজতেই উৎসাহী। এই অংশের কাছেই সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ধরনের বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ শিল্পপতিদের কাছেও তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারাই এই সংক্রান্ত গবেষণায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন যেহেতু ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি থেকেও বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সৌরশক্তি খাতে বিনিয়োগ করে বিপুল মুনাফা লুটছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে বিতর্কটার মধ্যে আসলে দুটো আলাদা প্রশ্ন লুকিয়ে আছে ঃ ১) কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই (পড়ুন লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন) কি প্রকৃতি ও পুঁজিবাদের মধ্যে একটা সমঝোতার রাস্তা বার হতে পারে এবং কোনভাবেই পুঁজিবাদী উন্নয়নের গতিরোধ না করেই কি সেটা করা সম্ভব? নাকি; ২) প্রকৃতি ও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা মূলগতভাবেই একে ওপরের প্রতিপক্ষ যেখানে আর বেশিদিন এদের সহাবস্থান সম্ভব নয়? এরই ফল হিসেবে পরিবেশ বিতর্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন এমন মানুষদের মধ্যে মোটামুটি গোটা চারটি পক্ষ দেখা যাচ্ছে। প্রথম পক্ষের যুক্তি হল : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে দাঁড় করালেই সমস্যার সমাধান হবে। দ্বিতীয় পক্ষ মনে করেন : গরিব, আদিবাসী মানুষের জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নিয়ে কয়লা খনি, খাদান ইত্যাদি করতে দেওয়া যাবে না, কিন্তু উন্নয়নও তো হতে হবে এবং তার জন্যে তেল-কয়লা বাদ দিয়ে লাভজনকভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে হবে। ভাবলে বোঝা যায় যে এরা আসলে পুঁজিবাদের হাতে জল-জঙ্গল-জমি দখল হওয়া, মানুষের জমিহারা হওয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সনাতনী লড়াই সেই লড়াইয়ের কথাই বলছেন, প্রকৃতি-পরিবেশের বিষয়টার দার্শনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বটা তাদের মননে এখনো অনুপস্থিত, বাস্তবিকভাবে তাঁরা প্রথম পক্ষের দিকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। তৃতীয় পক্ষের বিবেচনা হল : পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলের বিরোধিতা করতে হবে। কয়লাখনির জন্য আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নেওয়ার বিরোধিতা করতে হলে হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার চাষজমি কেড়ে নিয়ে সোলার প্যানেল বসানোর বিরোধিতাও করতে হবে। সর্বশেষ পক্ষের বিচারে- অত ঝামেলার দরকার নেই, সেই অরণ্যচারী জীবনে ফিরে যাওয়াই ভালো। তাই এদের সম্পর্কে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। গত শতাব্দীর ’৬০-’৭০-এর দশকে বলিভিয়ার টিন খনিতে যে লড়াই হচ্ছিল তার চেহারা ছিল সনাতন ‘শোষণের মাধ্যমে সঞ্চয়’ (Accumulation by exploitation)-এর বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেখানে তার চেহারা ছিল খনি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা ও সংগঠনের মাধ্যমে মালিকের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু এই লেখায় যে প্রসঙ্গ এসেছে তা খানিকটা আলাদা, কারণ আজ এই লড়াই দাঁড়িয়েছে ‘উৎখাতের মাধ্যমে সঞ্চয়’ (Accumulation by exploitation)-এর বিরুদ্ধে লড়াই, এবং সেখানে সনাতনী শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই, সেখানে বরং পরিবেশের ক্ষয়, পরিচিত সত্তা ও সংস্কৃতির ক্ষয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এবং এই কারণেই সারা পৃথিবী জুড়েই শাসকরা এই ‘আদি বাসিন্দা’ (আদিবাসী) পরিচিতির অধিকারটাকে ফেলে দিতে চাইছে, যেমন ২০১৩ সালে পেরুর প্রধানমন্ত্রী আন্দিজ পাহাড়ের কুইচুয়া আর আইমারা উপজাতিদের আদিবাসী পরিচয়টা সরিয়ে দিয়েছেন। আবার আমেরিকার ১৫২টি পরিত্যক্ত পাথর খাদানকে পরিষ্কার করার জন্য সেদেশের সরকারকে আজ বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ঠিক তেমনি সিলিকনের সোলার প্যানেল বানানোর জন্য যে পাথর ও বালি খাদান হবে সেটা সামলানোর খরচ, বাতিল ব্যাটারির বিষাক্ত রাসায়নিক সামলানোর খরচ- কে জোগাবে? তাই এই ধরনের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মোট খরচ হিসেবে শুধু কিছু ক্ষতিপূরণ নয়, পরিবেশ ও তার পুনরুদ্ধার, স্থানীয় মানুষের জীবন, সংস্কৃতির মুল্য, এই সবই ধরতে হবে। আর তাই উৎখাত ও মুনাফার কাহিনি একই রেখে পরিবেশের সমস্যার সমাধান করা যাবে কিনা তার একটা বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে মনে হয়। এবং ‘কর্মসংস্থানের’ নামে পুঁজিবাদী উন্নয়নকে সমর্থনের প্রশ্নকেও আবার বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। আবার পাথর ভাঙ্গার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে বহু শ্রমিকের সিলিকোসিস নামের একটি রোগ হয় যার কোনো নিরাময় নেই, মৃত্যু নিশ্চিত থাকে। এই প্রসঙ্গে সরকার ও বেআইনি কারখানার মালিককে কাঠগড়ায় তুললে অনেকেই বলেন যে এই কারখানাগুলো আটকালে স্থানীয় মানুষের চলবে কি করে? অথচ তাঁরা ভুলে যান যে সাময়িক কর্মসংস্থানের নামে ভয়ঙ্কর শোষণ, এমনকী মৃত্যুকেও যুক্তিগ্রাহ্য করে দেখানোর অভ্যাস ত্যাগ করা প্রয়োজন। খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, এই একই উন্নয়নের যুক্তি প্রায় সব পুঁজিবাদী দেশের সরকাররা দেখান। কাজেই আজকের পরিস্থিতির অনেকগুলো চারিত্রিক বদলকে মাথায় নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আদতে পুঁজিবাদী উন্নয়নের রাস্তায় প্রকৃতি-পরিবেশের বিপন্নতার অন্তিম উত্তর বেরনোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই মনে হয়; যদিও কোনো মূলগত পরিবর্তন খুব সহজেও আসবে না। বহু লড়াই, রক্ত ও সংশয় নিয়েই এগোতে হবে। কিন্তু বেছে বেছে বিরোধিতা নয়, এই গ্রহকে বাঁচাতে হলে এই ধরনের সমস্ত প্রকল্পকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা প্রয়োজন। প্রতিটি এমন প্রস্তাবের সঠিক লাভ-ক্ষতির (কার লাভ, কার ক্ষতি? পরিবেশের ধ্বংস কার অ্যাকাউন্টে যাবে?) হিসাব ছাড়া এমন কোনকিছুকেই এক পাও এগোতে দেওয়া যাবে না। এমন লাগাতার বিরোধিতার মুখেই একমাত্র রাষ্ট্র থমকে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এই বিরোধিতা কখনোই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিরোধিতা হতে পারে না, কারণ ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার হতে পারে। পুঁজিবাদ পার হয়ে ভবিষ্যতের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে প্রকৃতির বিপাকীয় বন্দোবস্ত পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও একমাত্র বিজ্ঞানের হাত ধরেই আসতে পারে। ফলে ব্যবস্থার পরিবর্তন যেন বিজ্ঞানের অগ্রগতির বিরোধী না হয়ে ওঠে। তাই ‘প্রকৃতি বনাম পুঁজিবাদ’ আজকের দুনিয়ার সম্ভবত সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক প্রশ্ন, যার সামনে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে, আমাদের সবাইকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে “কোন দিক সাথি, কোন দিক বল, কোন দিক বেছে নিবে তুমি?”

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..