রক্তস্নাত ১৬, ১৭ জুলাই ২০২৪

জয়নাল আবেদীন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের সংগ্রামী বীর ছাত্র-জনতা আবার জেগে উঠেছে। তাদের বিপ্লবী অভিনন্দন জানাই। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, ন্যায়-সত্য-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কোন আত্মত্যাগ, রক্তদান বৃথা যায় না। নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য প্রথমেই ছাত্র সমাজই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আজকের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল ছাত্ররাই। ১৯৮৩ ইং সনের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে ছাত্ররাই এরশাদের সামরিক আইন ভঙ্গ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে সেলিম, দেলোয়ার, দীপালী সাহা, মোজাম্মেল, নূর হোসেনসহ আরো অনেক বীর শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়ে গণতন্ত্রের নবীন যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিয়তির নির্মম পরিহাস, কালের পরিক্রমায় দলবাজি, দুর্নীতি, আধিপত্যবাদ কায়েম করতে গিয়ে গণতন্ত্র আজ স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশে আজ দুর্নীতির মহাউৎসব চলছে। কন্ঠরুদ্ধ, মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রেই যায় না। জনপ্রতিনিধিরা কিভাবে নির্বাচিত হয় আল্লাহ মালুম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি দুবছর ধরে বেড়েই চলেছে, লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিদেশে অবৈধভাবে টাকা পাচারের প্রতিযোগিতা চলছে। দেদারছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংক ফুটো করে দিচ্ছে। বেশিদিন আগের কথা নয়। অকুতোভয় ছাত্ররাই গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত করে ৭১ এর যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করেছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি ছাত্ররাই রাস্তায় নেমেছিল। ২০১৮ সালে ছাত্ররাই প্রথম কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের দাবির মুখে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়। একথা অনস্বীকার্য যে, দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক ও ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। দুর্ভাগ্যের সাথে এটাও বলতে হয় যে, কিছু ছাত্র সংগঠনের দলবাজি ও অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তি অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সম্প্রতি আদালতের রায়ের সূত্র ধরে সরকার যখন পূর্বের কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার পায়তারা শুরু করে তখনই বাংলার চির-বিদ্রোহী সাধারণ ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। আজ এক অভূতপূর্ব দ্রোহের সৃষ্টি হলো। ছাত্রদের বক্তব্য প্রথমে স্পষ্ট না হলেও পরে অবশ্য অত্যন্ত গোছালো ও পরিষ্কারভাবে তাদের নায্য দাবি তুলে ধরতে থাকে। আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি যুক্তিসঙ্গতভাবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে, যাতে মেধাবী ছেলেরা বঞ্চিত না হয়। ছাত্ররা শিক্ষাজীবন শেষে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাক। বেকারত্ব সমস্যারও অনেকটা সমাধান হোক। কারণ অযৌক্তিক বেশি কোটার কারণে অনেক যোগ্য শিক্ষিত ছেলে বেকারত্বের সম্মুখীন হচ্ছে। শুরু থেকেই ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা গুরুত্ব দেন নাই, বরং উপহাস তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যাচ্ছিলেন। ওদিকে আন্দোলন দিনদিন শক্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে। সেই আবার পুরনো খোঁটা, যেকোন পরিস্থিতি শাসকদলের বিপক্ষে গেলে সকলকে রাজাকার তকমা দেওয়া। এটা যেন এখন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি নিয়ে গেল তখন যদি তিনি নাতির বয়সী ছাত্রদের ডেকে বসাতেন, আপ্যায়নের সহিত তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিতেন তাহলে আজকে ক্র্যাকডাউনের মত ঘটনা ঘটতো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর স্বভাবী ঢঙে ট্যারা কথা না বলে যদি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলতেন যে, তোমরা ক্লাসে ফিরে লেখাপড়ায় মন দাও, তোমাদের যুক্তিসঙ্গত সকল দাবী বাস্তবায়নের জন্য আমি চেষ্টা করবো, তাহলে আর এতকিছু ঘটতো না। ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করা শুরু করলো, পুলিশও যখন গুলি চালিয়ে তাদের চোখের সামনে তাদেরই সহপাঠীদের হত্যা করলো তখন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা আর সহ্য করলো না, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো। সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ, দেশের সকল সরকারি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পুলিশের সাথে এবং ক্ষমতাসীন দলের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডাবাহিনীদের প্রতিহত করতে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেছে না। গত কিছুদিন ধরে অনেক মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেল। পুলিশের সামনে বুক এগিয়ে দেওয়া বেরোবি’র ছাত্র আবু সাইদের বুকে পুলিশ গুলি চালিয়ে দিলো। স্বাধীন দেশে এ কি দেখলাম। ঐ পুলিশের কি ভাই সন্তান নাই। এটা খুবই হৃদয়স্পর্শী লোমহর্ষক ঘটনা যা খুবই অগ্রহণযোগ্য ও সম্পূর্ণ বেআইনী। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে ছাত্ররা কি আর ঘরে বসে থাকতে পারে। দেশের ইতিহাসে রাজপথে এত ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। শাসকদল কোন মতে ছাত্র হত্যার দায় এড়াতে পারে না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে পড়েছি ঢাকার রাজপথ রফিক, বরকত,সালাম, জব্বার সহ অনেক শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় তখন দলমত নির্বিশেষে ছাত্র জনতা ও দেশবাসী সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজও সেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ বয়সে আমারও রক্ত ঝরে ছিল রাজপথে। জুলুম, অবিচার দেখলে এখনও রক্তে শিহরণ জাগে। ইতিহাসের শিক্ষা, ছাত্ররা পরাভব মানে না। ছাত্র-জনতার এই বিদ্রোহ রুখিবার সাধ্য কারো নাই। অনেক অশ্রুসিক্ত নয়নে, বেদনা ভরে আন্দোলনের প্রথম শহীদ ও এই প্রজন্মের নতুন বীর আবু সাইদ সহ আরো অজানা বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। অগনিত আহতদের সুস্থতা কামনা করি। শহীদদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। সংগ্রামী বীর ছাত্রদের প্রতি জানাই লাল সালাম। তোমরা এগিয়ে যাও, লড়াই জারি রেখো। বিজয় অবশ্যম্ভাবী। লেখক : অধিকার কর্মী ও কৃষক সংগঠক।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..