বিপ্লবী বীর শহীদ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস

প্রদীপ ঘোষ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একটি নামের সান্নিধ্যে, বদলে দিয়েছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবন। তিনি বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। যাকে ফাঁসির আগে কলকাতার আলীপুর কারাগারে চল্লিশবার খুব কাছে থেকে দেখেছেন, কথা বলেছেন বিপ্লবী প্রীতিলতা। শপথ করেছিল দেশের জন্য আত্মত্যাগের। প্রীতিলতার মৃতদেহের সঙ্গে বুক পকেটে পাওয়া গিয়েছিল একটি চিঠি ও রক্তে ভেজা বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়ের ‘ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব’ বই থেকে মেলে সেই চিঠি। নিজের সম্বন্ধে লিখেছিলেন প্রীতিলতা। সেই কথা লিখতে গিয়েই চলে আসে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের কথাও। প্রীতিলতা লিখেছিলেন, ‘১৯৩০ সালে পড়বার উদ্দেশ্যে কলকাতা চলে এসেছিলাম। আমার কোনও এক বিপ্লবী ভাইয়ের নির্দেশে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার জন্য তৈরি হলাম। মৃত্যুপথযাত্রী রামকৃষ্ণ। দেশকে ভালবাসার অপরাধে ব্রিটিশ শৃঙ্খলে বন্দী রামকৃষ্ণ ফাঁসির জন্য অপেক্ষমান। আমি ‘কাজিন সিস্টার’ সেজে কোন ক্রমে রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি আদায় করলাম। প্রত্যেকদিন যেতাম হাসি-খুশি সপ্রতিভ ঐ বীরকে দেখার জন্যে। তাঁর ফাঁসি মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আমি অন্ততঃ চল্লিশটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাঁর সমাহিত রূপ, অপকট আলাপ-আলোচনা, মৃত্যুর তপস্যায় প্রশান্ত আত্মসমর্পণ, দ্বন্দ্বহীন ভগবৎ ভক্তি, শিশু সুলভ সারল্য, প্রেমস্নিগ্ধ হৃদয়াবেগ, গভীর জ্ঞান, নিবিড় আত্মানুভূতি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল; দুঃসাহসিকতার পথে চলবার সামর্থ্য আমার দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পরে সক্রিয়ভাবে বৈপ্লবিক কোন এ্যাকশনে যাবার আগ্রহ আমার প্রচণ্ড হয়ে ওঠে।’ কে এই রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। কেন তাঁর ফাঁসি হয়েছিল? রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বীর বিপ্লবী। মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশের জন্যে প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। তিনি গোপন বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বোমাপ্রস্তুত করার সময় সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হন। মাস্টারদার নির্দেশে ১৯৩০ সালের ১ লা ডিসেম্বর রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালী চক্রবর্তী চাঁদপুর স্টেশনে ইনস্পেক্টর জেনারেল ক্রেগকে হত্যা করতে গিয়ে তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের সারোয়াতলীতে ১৯১০ সালের ১৬ ই জানুয়ারি। বাবার নাম দুর্গাকৃপা বিশ্বাস আর মায়ের নাম নয়নতারা দেবী। ছোটোবেলা থেকেই দারুন মেধাবী ছাত্র ছিলো রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। ১৯২৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হন তিনি। তারপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। পাথরঘাটায় বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু, স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ক্রমশ মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হতে থাকে। মেধাবী হওয়া বেশি দূর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি তার। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ছোটথেকেই বেশ পরাক্রমী ও নির্ভীক ছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেন তখন যুবকদের কাছে অনুপ্রেরণা। রামকৃষ্ণ ছুটলেন তাঁর কাছে। তাঁর দীপ্ত চোখে মুখে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জেদ দেখতে পান সূর্য সেন। কিছুদিনের মধ্যেই মাস্টারদার বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং তাকে দলে টেনেনেন। ব্রিটিশদের মোকাবিলার জন্য সেই সময় দরকার হয়েপড়ে বোমা, গুলি বন্দুকের। আর বিপ্লবীরাই সেই বোমা প্রস্তুত করতেন কিন্তু বোমা বানানো মোটেই সহজ কাজ ছিলো না। বিজ্ঞানের ছাত্র রামকৃষ্ণ বোমার ক্যাপ বানানোর দায়িত্ব পেলেন। বোমা বানানোয় ক্রমে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন রামকৃষ্ণ আর এই বোমা বাঁধতে গিয়েই ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুরুতর জখম হন ফলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিতে পারেননি তিনি। তবে বোমার ক্ষত তাঁকে দমাতে পারেনি। পুলিশ যাতে তাঁর খোঁজ না পায়, সেজন্য আহত অবস্থাতেই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। সুস্থ হয়েই ফের ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিপ্লবী কার্যকলাপে। সেইসময় চট্টগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনেরাল পদে টি জে ক্রেগকে বসায় ব্রিটিশ সরকার। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচারের জন্য ক্রেগ তখন সুবিদিত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর এই অত্যাচারের বদলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা। ১৯৩০ সালে টি জে ক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। ১৯৩০ সালের ১লা ডিসেম্বর চাঁদপুর স্টেশনে ট্রেনে করে আসবেন ক্রেগ। তাঁকে হত্যার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করলেন মাস্টারদা ও তাঁর দল আর সেই দায়িত্ব পড়ল রামকৃষ্ণ ও কালীপদ চক্রবর্তীর উপর। এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন রামকৃষ্ণ সংকল্প করলেন, অত্যাচারী ক্রেগকে হত্যা করতেই হবে। ১লা ডিসেম্বর চাঁদপুর স্টেশনে পৌঁছালেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও তার সঙ্গী কালীপদ চক্রবর্তী। শীতের ভোর কুয়াশায় ঢাকা চারদিক চাঁদপুর স্টেশনের এককোণে গুটিশুটি মেরে বসে দুই যুবক। পাশ দিয়ে গেলেও কারও নজরে পড়ত না। কোনও কিছুর অপেক্ষা করছেন তাঁরা। প্রতীক্ষার প্রহর যত বাড়তে লাগল, ততই যেন তাঁদের হৃদস্পন্দনের গতি বাড়তে থাকে। একসময় ট্রেনের আওয়াজে তাঁদের চোখ চিকচিক করে উঠল। অপেক্ষার প্রহর শেষ। এবার নিজেদের সংকল্প পূরণের সময়। একসময় ট্রেন এসে থামল স্টেশনে। দৌড়লেন ট্রেনের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পরে রিভলভারের গুলির আওয়াজ। কিন্তু ক্রেগকে মারতে গিয়ে রামকৃষ্ণরা ভুল করে রেলের ইন্সপেক্টর তারিণী মুখোপাধ্যায়কে ক্রেগ ভেবে গুলি করেন তাঁরা। খাঁকি উর্দি আর গায়ের ওভারকোট দেখে তারিণী মুখোপাধ্যায়কে ক্রেগ ভেবেছিলেন। তাদের গুলিতে মৃত্যু হয় রেলের ওই ইন্সপেক্টরের। ক্রেগ বেঁচে গেলো। হইচই শুরু স্টেশনে, দৌড়ে পালাচ্ছেন দুই যুবক। তাঁদের ধরার জন্য দৌড়াল পুলিশ। তার আগেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন ওই দুই যুবক। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরই বাইশ মাইল দূরে মেহেরকালী স্টেশনে পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করল। ওই বোমাগুলি কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়। বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফেরার একদিন পর ২৪ শে নভেম্বর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলন মনোরঞ্জন রায়। ধরা পড়ার পর তাঁদের চোখেমুখে ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই বরং নিজেদের কাজ সম্পূর্ণ করতে না পারার বেদনা ধরা পড়ে। কারণ, যাঁকে মারতে গিয়েছিলেন, তিনি বেঁচে গিয়েছেন। মাস্টারদা সূর্য সেনকে দেওয়া কথা না রাখতে পারার যন্ত্রণা রামকৃষ্ণের চোখেমুখে। ছোটো থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার বিচার শুরু হয় রায়ে কালীপদ চক্রবর্তীর বয়স কম হওয়ায় কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে পাঠানো হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে আর রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে পাঠানো হয় কলকাতার আলিপুর জেলে। কলকাতায় এসে ছেলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পয়সা ছিল না রামকৃষ্ণের পরিবারের। সেইসময় কলকাতায় পড়াশোনা করছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদর। খবর পেয়ে হিজলি জেল থেকে তাঁকে একটা চিঠি লিখলেন মনোরঞ্জন। চিঠিটি প্রীতিলতার কাছে পৌঁছে দেন মনোরঞ্জনের মা। জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চিঠিটি আনেন তিনি। রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টার জন্য চিঠিতে প্রীতিলতাকে অনুরোধ করেন মনোরঞ্জন। আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলেন প্রীতিলতা। সেখানে নিজের পরিচয় দিলেন রামকৃষ্ণের কাজিন হিসেবে। নাম বললেন অমিতা দাস। জেলে গিয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রায় ৪০ বার দেখা করেছেন প্রীতিলতা। রামকৃষ্ণের সঙ্গে জেলে সাক্ষাৎ নিয়ে প্রীতিলতা লেখেন– “তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপূর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদি মন এবং প্রগাঢ় উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুণ বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।” ছেলেকে দেখতে একবার আলিপুর জেলে এসেছিলেন নয়নতারা দেবী। তাঁকে রামকৃষ্ণের কাছে নিয়ে যান প্রীতিলতা। সেদিন ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন নয়নতারা দেবী। তা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি প্রীতিলতাও। কয়েকমাসের শুনানির পর ফাঁসির সাজা হল রামকৃষ্ণের। দিন ঠিক হল ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট। ততদিনের জেলের কুঠুরিতে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েন রামকৃষ্ণ। অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়। রামকৃষ্ণের ফাঁসি প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাঁর কথায়– “রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।” মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশের জন্য ফাঁসির দড়ি গলায় পরে শহীদ হয়েছিলেন দেশের এই অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংস্কৃতিক কর্মী

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..