‘নারী কোটা’ এবং নারীর মানবাধিকার

সোহানা আহমেদ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

আমরা যে যুগে বাস করছি সে যুগটা বিশ্বায়নের; বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের মানুষ একদিকে যেমন অন্যান্য অনেক অনেক বিষয়ে জানবার পাশাপাশি মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনে সক্ষম হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে এবং নতুন নতুন সব দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে একদিকে যেমন নারীর এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হচ্ছে, পাশাপাশি নারী-স্বাধীনতার প্রশ্নে সমাজের রক্ষণশীল দিকটিও প্রকট হচ্ছে। এর কারণটা সম্ভবতঃ আমাদের সবারই জানা। বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন, সহজলভ্যতা ও শিক্ষাগ্রহন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যাবহারের মাধ্যমে মানুষ তার অধিকার ও অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পর্কে সহজেই জানতে পারছে ও অধিকার প্রয়োগে বা আদায়ে সচেতনভাবে কাজ করতে পারছে। ইদানিং গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে আর একটি বিষয়ের উপর; আর তা হলো নারীর অধিকার। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে মানবাধিকারের শর্তগুলো কি নারীর অধিকারের শর্তগুলোও পূরণ করে না? যদি নারীকে মানবজাতিরই অংশ মনে করা হয়, তবে নারীর জন্য আবার আলাদা করে ‘অধিকার’এর কথা কেন? একটু পিছনে ফিরে যাই। আন্তর্জাতিকভাবে সর্বপ্রথম ১৯৪৫এর UN Charter-এ জেন্ডার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৬-এ গঠিত হয় Commission on the Status of Women (CSW), যার কাজ হয় নারীর অধিকারের বিষয়টি দেশে দেশে উন্নত ও পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশে দেশে ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন ও অপরাধ সংঘটনের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে UDHR (Universal Declaration of Human Rights)-এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, জাতি ও সম্প্রদায়গত এবং সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষ সমান সুরক্ষা-অধিকার ভোগ করবে। এই ঘোষণা মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মৌলিক অধিকারের ঘোষণা— যা মানুষের ভয়ভীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন জীবন যাপনের এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পত্তির অধিকার, ভোটের অধিকার এবং সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিকের আইনগত অধিকারের কথা বলে। কিন্তু দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ দেশেই সব বয়সী নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কেবলমাত্র তাদের নারী হয়ে জন্ম নেবার কারণেই। পরবর্তীতে ঈঊউঅড (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) নারীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সনদ হিসেবে পাস করা হয় যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশে এর প্রেক্ষিতে জাতীয় নারী নীতিমালা গ্রহন করা হলেও তা মৌলবাদী সংগঠনগুলোর অনৈতিক ও অন্যায্য বিরোধিতার মুখে পড়ে। এই বিরোধিতা থেকেই বোঝা যায় যে আমরা জেন্ডার সমতার লক্ষ্যে এগোতে তো পারিই নি বরং পিছিয়ে গেছি কতো দূরেৃ! নারীকে এখানে ‘মানুষ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে না, দেখা হচ্ছে কেবল ‘নারী’ হিসেবে। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে নারীর সব রকমের বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় নারীও এটি প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছিলো যে, নারী হলো মানবজাতির মধ্যে মেধাহীন প্রজাতিটি, পক্ষান্তরে পুরুষ প্রজাতিটি হলো চৌকষ ও বুদ্ধিমান; তাই মেধার সাথে তার (নারীর) যেন কোনও সম্পর্ক থাকতে নেই। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী ক’রে পুরুষ প্রজাতির আরাম আয়েশের বন্দোবস্তের জন্য ঘর সামলানো বা সন্তানাদি লালন পালনের দায়িত্ব দিয়ে, এমনকি “মাতৃত্ব”কে একটি প্রাকৃতিক বিষয় হিসেবে না দেখিয়ে মাহাত্ম্য প্রদান ক’রে নারীর প্রতি সীমিত পরিসরে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যবস্থা ক’রে ঘরের কোণে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে বন্দী করা সহজ হয়েছে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করাটা যৌক্তিক যে, সন্তান কি নারীর একার? নারীর ভূমিকা সন্তান ধারণ থেকে শুরু ক’রে জন্মদান এবং সন্তানের জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ পান করানো, তাও নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। কিন্তু দেখা যায় সন্তান লালনপালনের দায় কেবল যেন নারীরই। সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব সন্তানের মা ও বাবা- উভয়েরই নয় কি? অন্যদিকে, যে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীকে ঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, সেই ঘরের কাজের যোগ্য মর্যাদা কি নারী পাচ্ছে? জাতিসংঘের ১৯৯৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারী যে গৃহকর্ম করে থাকেন তার বার্ষিক বাজার মূল্য প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই একটি সহজসরল প্রশ্ন সামনে আসে, তা হলো— নারী কি তার এই শ্রমের বা গৃহকর্মের যথাযোগ্য স্বীকৃতি পায়, না তার জন্য এই গৃহকর্মের কোনও পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়? ভেবে দেখা জরুরী যে, নারী যদি এই গৃহকর্মের কর্মঘন্টাগুলো কোনও উৎপাদনমূলক কাজে খরচ করতো তাহলে জিডিপির সূচকে তার অবদান আরও কতো হতো! জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, নারী এখনও পুরুষের তুলনায় জীবনের সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে; বিশ্বে এখনও এমন কোনও দেশ নেই যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে দূর হয়েছে— ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বৈশ্বিক নারী-পুরুষের বৈঠক সূচকে এই বাস্তবতাই ওঠে এসেছে। যদিও তার বাস্তব অবস্থাটা দেশে দেশে, সমাজে সমাজে ভিন্ন। কোনও দেশে নারী ক্ষমতার প্রায় কেন্দ্রে অবস্থান করলেও কোনও কোনও দেশে নারীকে তার অমূল্য জীবন বলিদান দিয়ে তার অধিকারের কথা জানান দিতে হচ্ছে। এই একটি কারণই বোধ হয় যথেষ্ট এটা বোঝার জন্য যে, কেন নারীর অধিকার নিয়ে আলাদাভাবে এবং জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। তাই সব দেশের সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো নারীর মানবাধিকারের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া। আজকাল নারী এই প্রশ্নগুলো করতে শিখে গেছে; তাই নারীর ‘অবাধ্য’ হবার ফলে পুরুষের আরাম-আয়েশের রাস্তাটা বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে বিধায় নারীর অগ্রসর হবার রাস্তাটা বন্ধ করতে হবে, তার অগ্রগতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সরকারি উদ্যোগেরও বিরোধিতা করতে হবে। তাই, কোটা ব্যবস্থায় নারীকে বঞ্চিত করতে হবে কারণ কোটার সহযোগিতা পেলে একজন নারী সচেতন ও শিক্ষিত হয়ে একটু বেশীই শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং পুরুষতন্ত্রের জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। কোটা সংস্কার বিষয়ক ছাত্র আন্দোলন এবং তার পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে নারী কোটার বিলুপ্তি আমাদের ‘শিক্ষিত’ সমাজের নড়বড়ে বিশ্লেষণিক ক্ষমতার স্বরূপটাকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি কয়েকজন শিক্ষিত ও সাংগঠনিক পর্যায়ে ক্ষমতাশালী অবস্থানে আছেন এমন নারীকে নারী কোটা বিলুপ্তির বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। এঁদের অধিকাংশই সুপ্রীম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই আবার সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর নারী (এবং সাথে কিছু পুরুষও), যারা জন্মসূত্রেই সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাভোগী নারী, অনেকটা অহমিকার সুরেই বলেছেন যে, নারী এখন ‘এই’, নারী এখন ‘সেই’, নারী এখন রকেট চালিয়ে চাঁদে যায়, মঙ্গলে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি; তাই নারীর জন্য কোটার প্রয়োজন নেই। তাদের এই উক্তির পেছনে দু’টো বিষয় কাজ করে বলে আমার ধারণা। হয় তারা ধরে নিচ্ছেন যে, সমানাধিকারের জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করা নারীর সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে গেছে বা প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। কারণ, তারা উদাহরণ দিচ্ছেন, নারী এখন সরকার প্রধান, স্পীকার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বৈমানিক, অনেক সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার প্রধান, এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, কেউ কেউ অকল্পনীয় উচ্চ বেতনে বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করছেন– কারো কারো এমন বেতন যে, গার্মেন্টসে বা ক্ষেতখামারে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা স্বল্প আয় করা একটি বালিকা বা একজন নারীর বেতনের অথবা, সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অধিকারবঞ্চিত প্রান্তিক নারীর মজুরীর চল্লিশ, পঞ্চাশ বা শতগুণ বেশী। এতে সেই উচ্চ বেতন পাওয়া নারী ভাবছেন যে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’এর বিষয়টি তো নিষ্পন্ন হয়েছে; তাই তারা ঐ নিম্ন আয়ের কিশোরী বা নারীটির জন্য বিশেষ কোনও সুযোগ সুবিধা (পড়ুন ‘কোটা’) রাখাকে “নারীর জন্য অপমানকর” মনে করছেন। আমাদেরকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে যে নারীর জন্য কোটার বিরোধিতাকারী এই নারী এবং তাদের সমমনা পুরুষ, এরা আসলে কারা! তারা কি আসলে পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক সেই ঊচ্চ শ্রেণীর নারীকূল যারা প্রকারান্তরে সমাজে শ্রেণী বৈষম্যকেই টিকিয়ে রাখতে চান, যেভাবে পুরুষ তার আরাম আয়েশের অবস্থানটিকে ছাড়তে রাজী নয়, তেমনি তারাও তাদের ভোগী জীবনএর আয়েশকে ছাড়তে রাজী হন না এই ভেবে যে সব মেয়েরা স্বাবলম্বী আর ক্ষমতাশালী হয়ে গেলে তাদের আয়েশের ব্যাঘাত ঘটবে? আরেক শ্রেণীর নারী এই বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখতে চাইতে পারে যারা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নারী। নারীর ক্ষমতায়ন তো দূরের কথা, পুরুষের অধীন হয়ে দাসত্বের জীবন কাটানো ছাড়া, এইভাবে ‘ভালো মেয়েমানুষ’ হয়ে থেকে পরকালে ‘বেহেশত বা স্বর্গ’ প্রাপ্তির পুরষ্কার পাওয়ার চিন্তা ছাড়া তাদের মাথায় আর কিছুই কাজ করে না। ধর্মান্ধ এই নারীকূলকে পুরুষতন্ত্র খুব চাতুর্যের সাথে ব্যাবহার করে— বিশেষ করে নারীকে অধিকারবঞ্চিত করে তাকে চিরকাল অসহায় ও পুরুষের অধীন করে রাখার জন্য ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এই শ্রেণীর নারীকূলের এই মানসিকতা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। তার এই পশ্চাদপদতার শিক্ষা আজন্মলালিত; পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে বুঝিয়েছে যে এই দাসত্বের জীবনেই তার চূড়ান্ত মুক্তি, পুরুষের সেবাদাসী হওয়াতেই তার পরিপূর্ণতা। এই দুই শ্রেণীর নারীই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ধারক ও বাহক। এই নারীরা এবং পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা তাই রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এবং সুফিয়া কামাল-এর মতো মহীয়সী নারীর শিক্ষাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। তারা এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে নারী যতোদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বস্তুগত ও মানবসম্পদের অভিগম্যতার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ক্ষমতাশালী না হবে, ততোদিন নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার অবসান হবে না। যে মেয়েটি আজ নারী কোটার বিলুপ্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো না, সে তার নিজের ক্ষমতায়ন ও মুক্তির পথে নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ালো; যে ছেলেটি তার সুবিধাবঞ্চিত, নিপীড়িত, পশ্চাদপদ ও পরাধীন মা, বোন, বান্ধবী, শিক্ষকের সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার মধ্য দিকে তাদেরকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে আওয়াজ তুললো না, সে সমাজ পরিবর্তনে কোনও ভূমিকাই রাখলো না বরং পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অনৈতিক ব্যবস্থায় নারীর শোষিত হবার পথকে সে চিরস্থায়ী করার জন্য সহযোগিতাই করলো কেবল। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর একটা কৌতুক কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। রোকেয়া লেখেন, “একজন শিক্ষক ছাত্রদিগকে ভূগোল পড়াইবার সময় দিক-নির্ণয় বুঝাইতেছিলেন। তিনি একটি ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করিলেন, — “দেখ, তোমার বাম হাত দক্ষিণ দিকে, ডান হাত উত্তরে, মুখ পশ্চিম দিকে, এখন বলো তো তোমার পশ্চাতে কী আছে”? সে উত্তর দিলো, “স্কুলে আসবার সময় মা আমার ছেঁড়া প্যাতলুনে একটা তালি লাগিয়ে দিয়েছেন, তাই আছে।” এ থেকেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্রটা বোঝা যায়, যে ব্যবস্থা ছাত্রদেরকে সরকারি চাকরি ব্যতীত অন্য কোনও ইস্যু নিয়ে, যেমন দুর্নীতি, শিক্ষব্যবস্থার সংস্কার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু, ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন করতে আগ্রহী করে তোলে না। যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে সমাজে বৈষম্যের কাঠামো চিরস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে, তার পরিবর্তনের জন্য তাদের ভূমিকা রাখার আগ্রহ দেখা যায় না; তাদের আগ্রহ কেবল নিজেদেরকে সেই আমলা শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত করা, যে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এই বৈষম্য টিকে থাকে। বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে পর্যন্ত শেখায় না। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে সুদৃষ্টি না দিলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি করা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ‘মেধাবী’ ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম দিকই কেবল দেখবে, সেই পূর্ব দিক আর দেখতে পাবে না যা তা দৃষ্টির আড়ালে থাকে। এই মেধাবীদেরকে দৃষ্টির অন্তরালের দিকটি সম্পর্কে বোঝার বা জানার ক্ষমতাসম্পন্ন করে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের রাষ্ট্র ও তার শিক্ষাব্যবস্থা; একই অপরাধ আমাদের পারিবারিক শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থারও। কারণ, উপরের কৌতুকের মতো তারা কেবল ডাইনে, বাঁইয়ে ও সামনেই দেখতে শিখেছে; পশ্চাতে কী আছে তা তারা দেখতেই পায় না যতোক্ষণ পর্যন্ত না দেশীয় ভোজালির গুণে কিংবা বিদেশি শটগানের আদিখ্যেতায় আমাদের রাষ্ট্রের সকলের পশ্চাতের “তালি” আরও ছিন্নভিন্ন হয় এবং হৃৎপিন্ডকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দেয়। লেখক : সংগীত শিল্পী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..