ভেনেজুয়েলায় বামপন্থী মাদুরা আবার জয়ী

একতা টিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যখনই এমন কোনও সরকার এসেছে, যারা ওয়াশিংটনের প্রতি অনুগত হতে রাজি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক আইনের চাদরের তলা থেকে সামরিক অভ্যুত্থান, অর্থনৈতিক অবরোধ ও কূটনৈতিক ছোরাবাজির লোহার ডাণ্ডাবর করেছে বারংবার। ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালা, ১৯৬১ সালে ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ১৯৬৪ সালে ব্রাজিল, ১৯৭১-এ বলিভিয়া, ১৯৭৩-এ চিলে, ১৯৭৬-এ আর্জেন্টিনা, ১৯৮৩-তে গ্রানাডা, ১৯৮৯ সালে পানামা, ১৯৯৪ আর ২০০৪-এ হাইতি, ২০০৯-এ হন্ডুরাস- লাতিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ইতিহাস যেমন সুদীর্ঘ তেমন রক্তাক্ত। মার্কিন দেশের তাঁবেদার না হয়ে এই অঞ্চলে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারে না– দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠিত এই নিয়মের একটিই ব্যতিক্রম ছিল। সেই ব্যতিক্রম– কিউবা। আমাদের মনে রাখতে হবে, কিউবার বিপ্লব শুধু একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না– এই বিপ্লব ছিল একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনও, যা মার্কিন পুতুল বাতিস্তাকে অপসারিত করে দেশ হিসেবে কিউবার সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের প্রতি যে তখন থেকে আজ অবধি সর্বক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর জিঘাংসা দেখিয়ে চলেছে, অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে হাভানার শ্বাসরোধে তার যে এত উৎসাহ– তার কারণ কিউবায় শুধু কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আছে বলে নয়। এ কথা ওয়াশিংটন জানে, যতদিন কিউবায় বর্তমান সরকার রয়েছে, ততদিন লাতিন আমেরিকার প্রত্যেক দেশের সামনে একটি উদাহরণ থাকবে যে একটি সফল ও সার্বভৌম সরকার মার্কিন দেশকে দাসখত না লিখেও পরিচালনা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই দীর্ঘকাল মরিয়া প্রচেষ্টা করে গেছে কিউবার এই ‘অবাধ্যতা’-র রোগ যাতে লাতিন আমেরিকায় সংক্রামিত না হয়। কিন্তু ইতিহাসের গতি চিরকাল রুদ্ধ করে রাখার মত শক্তি মার্কিন দেশেরও নেই। ঠিক যে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে একমেরু বিশ্বের সৃষ্টিতে মনে হয়েছিল মার্কিন শক্তি অজেয়, সেই সময়েই একে একে লাতিন আমেরিকায় কয়েকটি নতুন বাম ঘেঁষা সরকারের আগমন এই মহাদেশের রাজনীতি বদলে দিল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলে, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, ইকুয়েদর একদা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সামরিক একনায়কদের মুক্তাঞ্চল ছিল, সেখানে গণ-আন্দোলনে ভর করে ইভো মোরালেস্, লুলা দা সিল্ভা, রাফায়েল কোরিয়ার মত নেতারা একের পর এক দেশে ক্ষমতায় আসীন হলেন। এঁরা প্রত্যেকেই বাম-ঘেঁষা অথবা মধ্য-বাম রাজনীতিবিদ। অনেকে নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলেও পরিচয় দিতেন। নতুন এই রাজনৈতিক ধারার সর্বাপেক্ষা বৈপ্লবিক বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল ভেনেজুয়েলায়। ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে আজকাল সংবাদমাধ্যম খুললেই আমরা শুনতে পাই, কেমন করে একদা ‘সমৃদ্ধশালী স্বর্গ’ ভেনেজুয়েলা সাভেজ ও তাঁর দলের হাতে ‘নরক’ হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান কিন্তু আমাদের অন্য কাহিনী শোনায়। ১৯৯৮ সালে সাভেজ ও তাঁর পঞ্চম সাধারণতন্ত্র আন্দোলন নির্বাচনে জয় লাভ করে ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতায় আসার আগে, আমরা দেখতে পাই, ভেনেজুয়েলার প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতেন, অতি-দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতেন প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ। ১৯৯২ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এর মত সংবাদমাধ্যমেই রিপোর্ট লেখা হয়েছিল, মাত্র ৫৭ শতাংশ ভেনেজুয়েলার নাগরিক কোনওক্রমে একবেলা খাবার জোটান। এই কি সেই ‘সমৃদ্ধি’-র চিত্র যা সাভেজ এসে ধ্বংস করেছিলেন? সাভেজ ও তাঁর আন্দোলন নিজেদের ‘সমাজতন্ত্রী’ দাবি করতেন। তিনি নিজেও ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ প্রসঙ্গে বহু বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু সাভেজ-এর ক্ষমতায় আগমন কোনও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তাঁরা শুধু একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন ও জাতীয় ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের এই খুব নিরীহ প্রচেষ্টাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে রাজি ছিল না। তেল সমৃদ্ধ ভেনেজুয়েলার জাতীয় সার্বভৌমত্ব মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও মার্কিন পুঁজির স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। এই কারণেই তারা ২০০২ সালে সাভেজকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের প্রচেষ্টা করে। সাময়িকভাবে সফল হলেও ভেনেজুয়েলার জনগণ প্রবল বীরত্বের সঙ্গে রাজপথের দখল নিলে এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। সাভেজ ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রবল শত্রু মনোভাবাপন্ন অবস্থান নেন, কিউবা এবং লাতিন আমেরিকার সকল বাম ঘেঁষা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক মুগুরের আঘাত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক-সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে প্রয়াসী হন। তাঁর গণ-কল্যাণমুখী কর্মসূচিরও প্রত্যক্ষ ফল ফলতে শুরু করে। সাভেজ যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন ভেনেজুয়েলায় দারিদ্র্যের অবস্থা কী ছিল, আগেই বলা হয়েছে। ২০১১ সালে এই দারিদ্র্যের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমে হয় ৩১.৯ শতাংশ এবং অতি-দারিদ্র্য ১৯.৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৮.৬ শতাংশ-এ। শিশু অপুষ্টি, বেকারত্ব, শিক্ষার হার– প্রত্যেক পরিসংখ্যানে উল্লেখজনক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। গড় আয় এবং জিডিপি– যে দুই পরিসংখ্যান-কে অর্থনৈতিক খবর পরিবেশনের সময় মোক্ষ বলে ধরা হয়, তাতেও ভেনেজুয়েলা সাভেজ আমলেই পূর্ববর্তী তিরিশ বছর যে স্থিতাবস্থার মধ্যে ছিল, তা থেকে বের হয়ে আসে। মাসের হিসেবে ১৯৯৮ সালে যেখানে ন্যূনতম মজুরি ছিল ১৬ ডলার, ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৩০ ডলার। ভেনেজুয়েলায় ২০০১ থেকে ‘মিশন জামোরা’-এর মাধ্যমে ভূমি সংস্কারের কাজ হয় দ্রুত গতিতে। প্রায় ৭৭ লক্ষ হেক্টর জমি সরকার অধিগ্রহণ করে, কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হয় ৩০ লক্ষ হেক্টর। ২০১৩ সালে যখন সাভেজ প্রয়াত হন, তখন তাঁর মূল্যায়নের সময় ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মত মার্কিন পুঁজির প্রত্যক্ষ স্বার্থরক্ষাকারী পত্রিকাও তিনি যে সেই দেশের দারিদ্র্য মোচনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা স্বীকার করতে বাধ্য হন। সাভেজ যখন প্রয়াত হলেন, তখন ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি যথেষ্ট সবল, তাঁর পার্টি ‘পার্টিডো সোশ্যালিস্টা উনিডো দে ভেনেজুয়েলা’ রাজনৈতিকভাবে প্রবল জনপ্রিয়। তাহলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল, যে তিন-চার বছরের মধ্যেই ভেনেজুয়েলার সরকারই পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল? এর কারণ পাওয়া যাবে সাভেজ আমলের দু’টি ভ্রান্তির মধ্যে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাভেজ ভেনেজুয়েলার খনিজ তেল রপ্তানি নির্ভরতা হ্রাস করার কোনও প্রচেষ্টাই করেননি। যেখানে ভেনেজুয়েলার সরকারের আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ-ই তেল নির্ভর, কোনভাবে তেলের দাম হ্রাস পেলেই সরকার প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হত। তেলের দাম বিশ্ব রাজনীতির নানা যোগ-বিয়োগের সঙ্গে যুক্ত। তাই এর উপর নির্ভর করে কোনও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নীতি গড়ে তোলা যায় না। সাভেজ ঠিক এই ভুলটিই করেছিলেন। তিনি তেল রপ্তানি থেকে আসা যে বিপুল সরকারি আয়, তা নানা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে লাগিয়েছিলেন। বিশ্ব রাজনীতির বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁর শাসনকালের অধিকাংশ সময়েই তেলের দাম চড়া ছিল, তাই তাঁকে কোনও অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু এটা তাঁর এবং তাঁর সরকারের ভাবা উচিত ছিল, যে এমন পরিস্থিতি চিরস্থায়ী হবে না। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির তেল নির্ভরতা হ্রাস করার ও অর্থনীতির অন্যান্য অংশকে চাঙ্গা করার প্রয়াস তাঁরা অনায়াসেই এই অনুকূল পরিস্থিতিতে করতে পারতেন। তা করা হয়নি। এর কারণ হল, মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও সাভেজ অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের তেমন পক্ষপাতী ছিলেন না। একথা ঠিক, খনিজ তেল ও গ্যাস শিল্পে তাঁর সরকার বহু সংস্থা জাতীয়করণ করেছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলির পূর্বতন অকর্মণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্থ বে-সরকারি কর্তাব্যক্তিদের সরানোর কোনও প্রচেষ্টাই হয়নি। তাই দুর্নীতি রয়ে গেছে এই সংস্থাগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অর্থনীতির অন্যত্র সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ আরও কম। সাভেজ-এর আমলে সেখানেও পুঁজিবাদী আধিপত্য অব্যহত ছিল। ১৯৯৯ থেকে ২০১১, সাভেজ আমলে অর্থনীতিতে বে-সরকারি প্রভাব কমা দূরে থাক, তা জাতীয় অর্থনীতির ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ, সাভেজ-এর ‘২১-শতকের সমাজতন্ত্র’-এর ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে বেসরকারি পুঁজির প্রভাব ফ্রান্সের থেকেও অধিক। শত্রুর এই অ্যাকিলিসের গোড়ালি সমদুর্বলতা মার্কিন ঈগলের চোখ এড়ায়নি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সাভেজ অনেকগুলি শনির প্রবেশ উপযোগী ছিদ্র রেখে গিয়েছিলেন। ২০০২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁদের সকলকেই তিনি ক্ষমা করে দেন। অভ্যুত্থানের অধিকাংশ চক্রীরা কয়েক মাস জেল খেটে ছাড়া পান। অনেকে তো কোনও শাস্তিই পাননি। এই সময়ে ভেনেজুয়েলার সংবাদমাধ্যম কতটা মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থান-পন্থীদের হাতে রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তারপরেও সাভেজ তাঁদের সঙ্গে বিশেষ দ্বন্দ্বে যাননি। বরং ‘ঞবষবঝটজ’-এর মতো সংবাদমাধ্যম, যারা লাতিন আমেরিকায় বাম ঘরনার সাংবাদিকতায় নতুন যুগ এনেছিল, তারা প্রাথমিকভাবে সাভেজ-এর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলেও তাঁর শাসনকালের শেষ দিক থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জোটের নানা অংশের তরফ থেকে বাধার সম্মুখীন হয়। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই আমরা সাভেজ পরবর্তী সময়ে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’-এর নিপুণ প্রয়োগ দেখতে পাই। কাকে বলে ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’? ঘঅঞঙ জার্নালে এই প্রসঙ্গে যে সংজ্ঞা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়ায় হয়েছে তা তুলে দেওয়া যেতে পারে। সহজ অর্থে হাইব্রিড যুদ্ধ হলো– একটি দেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ক্ষমতার হাল-হাতিয়ার ও নাশকতার কলাকৌশলগুলি একের পর এক বা একত্রে প্রয়োগ। এই সব হাতিয়ার ও কলাকৌশলগুলিকে লাগাতারভাবে এমনভাবে মিশ্রিত করে ব্যবহার করা হয় যাতে সেটি দেশের সরকারের নাজুক দুর্বলতাগুলিকে জিম্মি করে তাকে ফেলে দেওয়া যায়। ২০১৫ সালে ওবামা সরকার তেল-কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এই প্রকার যুদ্ধ শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্র্যাকিং-এর মাধ্যমে দেশীয় তেল উৎপাদন খুব দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব বাজারে এই তেলের বন্যায় খনিজ তেলের দাম কমে যায় দ্রুত (২০১২ সালে ব্যারেল পিছু ১২৫ ডলার থেকে ২০১৬-এর জানুয়ারি মাসে ব্যারেল প্রতি ৩০ ডলার)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই তেলভিত্তিক অর্থনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্য ছিল রাশিয়া আর ভেনেজুয়েলা। রাশিয়া প্রাথমিকভাবে কিছুটা বেসামাল হলেও আবার অর্থনীতি সামলে নেয়, কারণ তেল রুশ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও একমাত্র অংশ নয়। ভেনেজুয়েলার পক্ষে এই ধাক্কা সামলানো সম্ভব ছিল না। বিদেশি মুদ্রার অভাবে এই আমদানি ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেটুকু খাবার আছে, তারও সুষম বন্টন সঠিক ভাবে সম্ভব হয়নি, কারণ খাদ্যব্যবস্থা বন্টনও খুব অনুন্নত। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই আকাশ ছুঁয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতেই ২০১৫ সালের ভেনেজুয়েলার আইনসভা নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী জোট বিপুল ভাবে বিজয়ী হয়। ১৯৯৯-এর পর প্রথমবার আইনসভার কর্তৃত্ব চলে আসে সাভেজ-বিরোধীদের হাতে। এই কায়দাই যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলায় তাদের সমর্থিত বিরোধীরা বজায় রাখতেন, তাহলে হয়তো পরের নির্বাচনেই মাদুরো অপসারিত হতেন। সাধারণ জনগণ তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’-এর বাস্তবতাকে মেনে নেয়নি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়ে মাদুরো উচ্ছেদে ওবামার মত আর রাখঢাক করে অগ্রসর হলেন না। ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন ভেনেজুয়েলাকে ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি থ্রেট’ বলে ঘোষণা করে তার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে তাকে ভাতে মারতে চেয়েছিল। ট্রাম্পএই অবরোধ চালু রাখেন ও তার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। এর ফলাফল কত মারাত্মক, তা বোঝার জন্য ‘সেন্টার ফর ইকনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ’ থেকে প্রকাশিত মার্কিন অর্থনীতিবিদ মার্ক ওয়েইস্ব্রট ও জেফরিস্যাক্স-এর ‘ঊপড়হড়সরপ ঝধহপঃরড়হং ধং ঈড়ষষবপঃরাব চঁহরংযসবহঃ: ঞযব ঈধংব ড়ভ ঠবহবুঁবষধ’ নামক গবেষণাপত্রটি দেখা জরুরি। এই গবেষণা অনুযায়ী শুধু ২০১৭-১৮ সালেই মার্কিন অবরোধের কারণে প্রায় চল্লিশ হাজার ভেনেজুয়েলাবাসী প্রাণ হারিয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে ‘তেলের বদলে খাদ্য’ সংক্রান্ত যে চুক্তি ভেনেজুয়েলার সরকার করেছিল, তার উপরেও অত্যন্ত অমানবিক ভাবে অবরোধ চাপানো হয়েছে। ট্রাম্প শুধু এতেই থেমে থাকেননি। ২০১৯ সালে স্বল্প পরিচিত বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো-কে সম্পূর্ণ অ-সাংবিধানিকভাবে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা সংঘটিত হয়, তাতে যে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন আছে, তা ট্রাম্প প্রশাসন খোলাখুলিই ঘোষণা করে। এই প্রকাশ্য অভ্যুত্থানের চেষ্টায় হিতে বিপরীত হয়। ভেনেজুয়েলার জনগণের সামনে ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে যায়, মাদুরো যে মিশ্র-যুদ্ধের কথা বলছিলেন, তা শুধু গা বাঁচানোর প্রচেষ্টায় দেওয়া অজুহাত নয়। স্পষ্টতই, এই দাবিতে যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে। তাঁরা এ-ও উপলব্ধি করেন মাদুরো বিরোধিতার নামে ভেনেজুয়েলার বিরোধী পরিসরের একটি বড় অংশ আসলে ওয়াশিংটনের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবার দেশকে বাঁধতে চায়। এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মাদুরোর জনসমর্থন যে আবার কিছুটা বাড়তে শুরু করে, তার মূল কারণ এটা। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিও ক্রমশঃ কিছুটা উন্নতি করতে শুরু করে। যে কাজ সাভেজ-এর অনেক আগেই করা উচিত ছিল, সেই কাজে মাদুরো হাত দেন। অর্থনীতির তেল নির্ভরতা হ্রাস করার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং অনেকাংশে সফল হয়। তাঁর প্রতিবেশী অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়। বলিভিয়ার অভ্যুত্থান সমায়িক ভাবে সফল হলেও, প্রবল গণ-আন্দোলনের ঢেউ-এ ভর করে মোরালেসের দল আবার ফেরত আসে। ব্রাজিলে লুলা বোলসানারো-কে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রতিবেশী কলম্বিয়া, যা দীর্ঘকাল এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অনুগত মিত্র ছিল, সেখানে গুস্তাভো পেট্রোর মত প্রাক্তন মার্কসবাদী গেরিলা নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। গত ২৯-শে জুলাই ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, এখনও অবধি তাতে দেখা যাচ্ছে মাদুরো আবার ক্ষমতায় ফিরতে চলেছেন। ৫৯ শতাংশ নির্বাচক এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, যা বিগত নির্বাচনের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে বেশি। ৮০ শতাংশ ভোট গণনার পর মাদুরো পেয়েছেন ৫৩.৬৭ শতাংশ ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ও সম্মিলিতি বিরোধী প্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেজ পেয়েছেন ৪৬.৩৩ শতাংশ ভোট। এই নির্বাচনী প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়েছে ২০১৯-এর অভ্যুত্থানের চেষ্টার প্রেক্ষিতে ভেনেজুয়েলার জনতার মার্কিন মিশ্র যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, অনুকূল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মাদুরোর অর্থনৈতিক সংকট অনেকটাই সামলে দেওয়ার সাফল্যের প্রেক্ষাপটে। যথারীতি, যা সাভেজ আমলেও আমরা বারংবার দেখেছি, বিরোধী পক্ষ এই নির্বাচনী পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হয়নি। ভোট মিটতেই তারা রাস্তা অবরোধ, অগ্নি সংযোগ, সরকারি সম্পত্তির উপর আক্রমণের মত কৌশলে ফেরত গেছে। এ অস্বাভাবিক নয়, কারণ প্রধান বিরোধী নেতাদের মধ্যে মারিয়া করিনোর মতো নেত্রীরাও রয়েছেন, যাঁরা ২০০২ সালে সাভেজ উচ্ছেদে অভ্যুত্থানের চেষ্টায় মূল চক্রীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরা প্রকাশ্যেই বলে এসেছেন এই সরকারকে ফেলে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য, গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে হলে ভালো, না হলে সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কীভাবে তা বেঁকাতে হয়, তাও তাঁরা জানেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই আরও চাপ সৃষ্টি করার কথা বলতে শুরু করেছে, আর্জেন্টিনার ঘোষিত নব্য-উদারনীতি ও শিকাগো স্কুলের মহাভক্ত রাষ্ট্রপতি হাভিয়ের মিলেই ঘুরিয়ে ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীকে আহ্বান করেছেন সামরিক অভ্যুত্থানের। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ মাদুরোর চ্যালেঞ্জের শেষ নয়, শুরু মাত্র।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..