স্বৈরতন্ত্রের পতনে কমিউনিস্টদের অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখতে হবে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে আড়াই শ’র বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে সরকার গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কখনো এই ভূখণ্ডে কোন আন্দোলনে এতো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়নি। ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নেমে আসা নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিহতদের তালিকায় আছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষ। পুলিশের গুলি ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের আক্রমণে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাদের কারো পা কেটে ফেলতে হয়েছে, কেউ হারিয়েছেন চোখ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে আওয়ামী লীগের নিষ্ঠুরতা আগের সব স্বৈরশাসককে হার মানিয়েছে। তবে তাতেও রাজপথে গণমানুষের প্রতিরোধ থামেনি। জনরোষ থেকে বাঁচতে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিলেও নিপীড়ন বন্ধ করেনি সরকার। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ও সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনী এলাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। কোটা আন্দোলনের নেতাদের বেআইনিভাবে ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়েছে। আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে নানা চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে এতো কিছুর করেও এবার আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জেগে উঠেছে। সরকারের উপর মানুষের প্রবল ঘৃণা ও ক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসহ শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন সব শক্তি শুরু থেকেই এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। গণহত্যার প্রতিবাদে প্রতিদিনই রাজপথের প্রতিবাদ জোরালো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বিপুল প্রাণহানির নিন্দা জানানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট এই পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে, দেড় দশক ধরে চলে আসা আওয়ামী দুঃশাসনে মানুষ কতোটা ক্ষুব্ধ। ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ভাগাভাগি, ব্যাংক লুট ও বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। সেই সাথে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে গণবিরোধী নানা রকম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব কিছুর প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকহারে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। শিল্প কারখানাসহ বেসরকারি খাতে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হয়নি। ফলে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু মোটা অঙ্কের ঘুষ ছাড়া চাকরির সুযোগ নেই। সর্বস্তরের মানুষের এই দুঃখ, বঞ্চনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগের স্বৈরাতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়ে নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেইসঙ্গে আগের মতোই জনগণের প্রতিবাদ ও দাবি-দাওয়াকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহের ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। একইসঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় ক্ষমতায় থাকার হীন স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতাও অব্যাহত রেখেছে। তবে কোন কিছুই এবার মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছে না। তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন আরো তীব্র হচ্ছে। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। ইতিহাস বলছে, জনগণের এমন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে কোনো স্বৈরশাসক টিকে থাকতে পারে না। এ অবস্থায় জনগণের এই আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণির অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে কমিউনিস্টরাই পারে, যে কোন আন্দোলনকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের পথে নিয়ে যেতে। স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা, লুটপাটতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে কল্যাণমুখী ও বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে হলে চলমান আন্দোলনে কমিউনিস্ট, বামপন্থী, প্রগতিশীলদের সামনে কাতারে থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।
Login to comment..