হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে সংশয়
ময়নাতদন্ত ছাড়াই বহু লাশ দাফন
সাম্প্রতিক সহিংসতায় প্রাণহানি
* রাজধানীর পাঁচ বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া ৩৩ জনের ময়নাতদন্ত হয়নি
* গুলিবিদ্ধ অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
* ময়নাতদন্ত ছাড়াই সব মরদেহ নিয়ে গেছেন স্বজনেরা
* দাফনের পর ময়নাতদন্ত করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগে
* দেরীতে ময়নাতদন্ত হলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ চাপা পড়ার আশঙ্কা থাকে
একতা প্রতিবেদক :
দেশের প্রচলিত আইনে যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সম্প্রতি সারা দেশে যেসব মানুষ নিহত হয়েছে, তাদের একটি বড় অংশকেই দাফন করা হয়েছে ময়নাতদন্ত ছাড়া। ঠিক কতজনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের অন্তত ৫৮টি লাশের খোঁজ পেয়েছে বিবিসি বাংলা।
জানা গেছে, এক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে মারা যাওয়া অনেকের মরদেহ ‘পুলিশি ঝামেলা’র ভয়ে স্বজনেরাই সরাসরি বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছেন। অন্যদিকে, যাদের মৃত্যু হাসপাতালে হয়েছে, তাদের বিষয়ে খবর দেওয়া হলেও পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। যদিও পুলিশ সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিজেদের রক্ষা করতেই পুলিশ ময়নাতদন্ত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতিতে যথাসময়ে ময়নাতদন্ত না হওয়ার ফলে নিহত অনেকের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ চাপা পড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বিবিসি বাংলাকে বলেন, এসব মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে পুলিশের নামও জড়িত রয়েছে। ফলে তারা নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা থেকেই এসব করছে।
গত ১৮ জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষে রাজধানীর উত্তরা এলাকাটি রীতিমত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই একদল লোক প্রায় ২০ বছর বয়সী এক তরুণের গুলিবিদ্ধ মরদেহ স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রেখে যায়।
ওই হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বুলেট ইনজুরিতে মৃত্যু হওয়ায় আমরা দ্রুত পুলিশকে ইনফর্ম করি, কিন্তু পুরো একটা দিন পার হওয়ার পরও তাদের কেউ আসেননি। সেই কর্মকর্তা জানান, পুলিশ না যাওয়ায় ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’কে খবর দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুলিশি কাগজপত্র ছাড়া তারা মরদেহ দাফন করতে পারবে না। ফলে সেদিনই আবার থানায় যোগাযোগ করেন কর্মকর্তারা। তখন পুলিশ তাদের হুমকি দিয়ে বলে, এরপর যোগাযোগ করলে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হবে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নিহত ছেলেটির পরিচয় খুঁজতে লেগে পড়ে।
ওই কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ছেলেটার চেহারা এবং পোশাক দেখে আমাদের মনে হয়েছিল যে সে মাদ্রাসার ছাত্র হতে পারে। ফলে আশেপাশের সব মাদ্রায় আমরা খবর পাঠালাম এবং তাতেই কাজ হলো। দুদিন হাসপাতালে পড়ে থাকার পর ২০ জুলাই রাতে নিহত তরুণের মরদেহ নিয়ে যান স্বজনেরা।’
উত্তরার ওই হাসপাতালটি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সহিংসতায় নিহতদের ময়নাতদন্তের ব্যাপারে তারা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তারা বলেছে, মৃতদের পরিবার চাইলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিতে যেতে পারে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা মরদেহ নিয়ে গেছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা-বনশ্রী ও মোহাম্মদপুর এলাকার বেসরকারি পাঁচটি হাসপাতালে কমপক্ষে ৩৩ জন মানুষ মারা গেছেন। তাদের কারোরই ময়নাতদন্ত হয়নি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যেও কোনো কোনোটিতে নিহত সবার ময়নাতদন্ত হয়নি বলে জানা যায়। ঢাকায় এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ময়নাতদন্ত ছাড়াই অন্তত ১৩টি মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে দুজনের ময়নাতদন্ত হয়নি। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এর সবগুলোই মৃত অবস্থায় এসেছিল। কিন্তু তখন আহত রোগির চাপ এত বেশি ছিল যে ময়নাতদন্তের মতো সময়সাপেক্ষ ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ ছিল না। তিনি আরও বলেন, নিহতদের ময়নাতদন্ত করতে গেলে তখন আহত অনেক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। সহিংসতায় নিহত অন্তত ৯৬ জনের মরদেহ এসেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। এর মধ্যে ৯৪ জনেরই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাকি দুটি মরদেহ এসেছিল ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা থেকে। ময়নাতদন্ত শেষ না করেই পুলিশ মরদেহগুলো নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মর্গের কর্মকর্তারা।
কী কারণে ময়নাতদন্ত না করেই মরদেহ ফিরিয়ে আনা হলো, সে বিষয়ে জানতে মোহাম্মদপুর থানায় যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, থানার ওসি বদলি হয়ে চলে যাওয়ায় নতুন কর্মকর্তা ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
এর বাইরে নিহত অনেক ব্যক্তির স্বজনদের মধ্যেও ময়নাতদন্তের বিষয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। গত ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুরে নিহত হাসিব ইকবালের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এগুলো করলে কী আমার ছেলে আবার ফিরে আসবে? আসবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এমনিতেই আমাদের দিশেহারা অবস্থা। এরমধ্যে নতুন করে পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ একই ধরনের বক্তব্য ফুটে উঠেছে ঢাকায় নিহত শিক্ষার্থী মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তীর কণ্ঠেও।
তিনি বলেন, ‘কার কাছে বিচার চাইবো?...আমার ভাইকে তো পুলিশ গুলি করছে। এখন আমি থানায় যেয়ে পুলিশের কাছে বিচার চাইবো?’
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, অস্বাভাবিক যেকোনো মৃত্যুর ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করা বাধ্যতামূলক বলে জানান সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। ।
অন্যদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন জানান, ময়নাতদন্তে গাফিলতির বিষয়ে কোনো অভিযোগ তারা পাননি। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা এখনও পায়নি। কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’ তার দাবি, সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে যাদের তথ্য পুলিশ পেয়েছে, তাদের সবার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী বলছেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই স্বজনেরা ময়নাতদন্তে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহিংসতায় নিহত অনেকের মরদেহ দাফন করা হলেও সেগুলো ময়নাতদন্তের সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, এটি এখনও করা যাবে। তবে তার জন্য আগে মামলা করতে হবে। আর দাফনের পর ময়নাতদন্ত করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রাথমিক শুনানিতে বিচারক যদি প্রাথমিকভাবে কনভিনসড হন যে ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বা স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হচ্ছে না, তখন তিনি ডেডবডি তুলে ময়নাতদন্ত করার নির্দেশ দেবেন। তবে দাফন করার পর যত দেরী হবে, ন্যায়বিচার পাওয়া ততই কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পর তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম করা গেলে রিপোর্টটা কনভিনসিং হয়। দেরী হলে (মরদেহ নষ্ট হয়ে) অনেক এভিডেনস পাওয়া যায় না। ফলে এভিডেনস হিসেবে রিপোর্টটা তখন হালকা হয়ে যায়।’
প্রথম পাতা
দেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা আনতে হবে
শেয়ারবাজার কারসাজিতে লুটপাট কয়েক হাজার কোটি টাকা
‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও মানব মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিতে হবে’
জাতীয় সঙ্গীত-পতাকা মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে হবে
আন্দোলনে ওষুধ কারখানার শ্রমিকরা, উৎপাদন বন্ধ
ডেঙ্গু রোগী বাড়ছেই
মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা প্রশ্নে কোনো আপস নয়
‘কৌতুহলোদ্দীপক’
Login to comment..