সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে
মোহাম্মদ শাহ আলম
বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। রাষ্ট্রকে অবিলম্বে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার পথে হাটতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। ছাত্রদের ওপর আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। নিরীহ গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের নিঃশর্ত মুক্ত দিতে হবে। হামলা-মামলা-গণগ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে। দল নির্বিশেষে, পক্ষপাতহীনভাবে নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং নিহত ও আহতদের বিশ্বাসযোগ্য স্বচ্ছ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোকে ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। গণরুম কালচার বন্ধ করতে হবে। ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিতে হবে। নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অস্বাভাবিক, নানামুখী শক্তির তৎপরতা চলছে। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্মম ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে কোটা বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার রায় দিয়েছেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে জামাত-শিবির, অবশেষে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছে এ সময়ে কেন? কিন্তু প্রশ্ন হলো, ২০১৩ সালে করলে এই প্রশ্ন কি উঠত? স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অংশ হিসেবে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ হয়নি, হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন।
কোটা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি ফিরাই তাহলে দেখি, এবার কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছিল শান্তিপূর্ণভাবে, ১ জুলাই ২০২৪ থেকে। যদিও বিভিন্ন জায়গায় রাজপথ-রেলপথ অবরোধ হয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি দিয়ে সমাধানের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিল। প্রধানমন্ত্রী তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা এক কদম এগিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেন। এটাতে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের সন্তানরা এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট রিট আমলে নিয়ে, কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। “নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগে কোটা বাতিলসংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্র গত ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ের মূল অংশ প্রকাশিত হয়েছে ১৫ জুলাই ২০২৪। এই রায়ের মূলকথা হলো, সব কোটা বজায় রাখতে হবে। তবে প্রয়োজনে বাড়ানো-কমানো যাবে। অবশ্য আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন” (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪)। এর ফলে আরও তীব্রভাবে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথ ও ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেমে পড়ে। তারা পূর্বে কোটা সংস্কারের আন্দোলন করেছিল ২০১৮ সালে। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী আদেশে সম্পূর্ণভাবে কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন।
১৭ জুলাই ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১৫ ও ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকে ঘিরে ৬ জনের প্রাণহানি হয়। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে। ঘোষণা করেন নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কোটা বিষয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতের ওপর ভরসা রাখতে বলেন। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, উদ্যোগ ও নির্দেশনা ছিল না প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে, প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি ছিল বলে জনগণের কাছে মনে হয়েছে।
১৫ জুলাই ২০২৪ ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আক্রমণ করে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকে ঘিরে ৬ জনের প্রাণহানি হয়। যেখানে ছাত্রীরা প্রচ-ভাবে নির্যাতনের শিকার হন। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। সরকার এই সংঘাত সৃষ্টি করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কৌশল অবলম্বন করে। সরকার মনে করেছিল সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আন্দোলন স্থগিত ও ব্যর্থ হয়ে যাবে, হয়েছে বুমেরাং। কোটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের এই দীর্ঘসূত্রিতা, কৌশল-অপকৌশল কেন? এই অপকৌশল পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করেছে, দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে। অসংখ্য তাজা প্রাণ ঝড়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় জাতীয় সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এই পর্যায়ে আন্দোলন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং কৌশল পাল্টায়। আপিল বিভাগের ৭ আগস্ট ২০২৪ শুনানির তারিখ ২১ জুলাই ২০২৪ নিয়ে আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৩ মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন। এই সিদ্ধান্ত আগে কেন নেওয়া হলো না? আগে নিলে এত প্রাণহানি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হতো কি না? কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামাতে হতো কি না? দেশের ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করতে হতো কিনা? সব ধরনের পরিবহন বন্ধ করতে হতো কি না? দেশের অর্থনীতি কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়তো কি না? এই দায় কার? অবশ্যই সরকারের। তার স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের, তার আত্মররিতা। সরকারের এই কৌশল-অপকৌশল, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করেছে, করছে। সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে মানুষের সকল পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কোটার ওপর ভর করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বি-রাজনীতিকরণের শক্তি, সংবিধান বহির্ভুত শক্তি, নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অতিতৎপরতা চলছে। গণতন্ত্রহীনতা, মানুষের ভোটাধিকার হরণ করার ফলে এই অবস্থা বিরাজ করছে এবং সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট দূর করতে হলে সরকারকে পদত্যাগ করে অতি দ্রুত নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে গণতন্ত্রহীনতার কারণে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতের শক্তির উপাদান রাজনীতিতে বিরাজ করতেই থাকবে।
আমরা ১৯৬৯, ৭০, ৭১ সালে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে, জনসমর্থনের মাধ্যমে আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে মোকাবিলা করেছি। জনগণের কাতার থেকে আমরা উঠে এসেছিলাম, তাদেরকে বিদায় করেছিলাম। আজ কিন্তু বৈপরীত্য লক্ষ্য করছি। বর্তমান সরকারের গণবিরোধী আমলা, ক্যাডার ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীনির্ভর লুটপাটের রাজনীতি সরকারকে চরমভাবে জনবিচ্ছিন্ন করেছে। এর বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলন করলেও তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি ও শক্তি দুর্বল। বর্তমানে তারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। ফলে চেতনাগতভাবে প্রবীণ হোক বা নবীন হোক প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এই সুযোগে পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে। জনসমর্থন নিয়ে তারা আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা অহ-ঃরঃয-পংরং (বৈপরীত্য) হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ তার চেতনাকে রক্ষা করতে হলে বর্তমান সরকারের গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এই দেশের দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ সর্বাত্মক লড়াইতে নামতে হবে। রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। বর্তমান সরকারের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা এবং গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই কাজ করতে হলে আওয়ামী-বিএনপি জোটের বাইরে বাম প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক শক্তি-ব্যক্তিকে স্বাধীন স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে নিজস্ব বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম পাতা
দেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা আনতে হবে
শেয়ারবাজার কারসাজিতে লুটপাট কয়েক হাজার কোটি টাকা
‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও মানব মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিতে হবে’
জাতীয় সঙ্গীত-পতাকা মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে হবে
আন্দোলনে ওষুধ কারখানার শ্রমিকরা, উৎপাদন বন্ধ
ডেঙ্গু রোগী বাড়ছেই
মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা প্রশ্নে কোনো আপস নয়
‘কৌতুহলোদ্দীপক’
Login to comment..