দ্রোহযাত্রায় উত্তাল দেশ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার ও শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশ [ ছবি: রতন কুমার দাস ]
একতা প্রতিবেদক : কোটা সংস্কারের আন্দোলন ক্রমেই ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন ৯ দফা দাবিতে প্রতিদিনই নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। এর প্রতি সংহতি জানিয়ে রাজপথে নামছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও। কোনো কোনো কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের দাবিও তোলা হচ্ছে। একই দাবিতে গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে রাজপথে নেমে আসে হাজার-হাজার ছাত্র-জনতা। শহীদ মিনার এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শিক্ষার্থীরা হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগানে মুখরিত করেন শহীদ মিনার চত্বর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টি বাদল অপেক্ষা করে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বুক ফুলিয়ে যেভাবে রাজপথে নেমে এসেছেন তা বিগত কয়েক বছর সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে নি। অনেকেই বিভিন্ন সময় ছাত্রদের রাষ্ট্রের অনিয়ম-অনিশ্চয়তা নিয়ে নিশ্চুপ থাকাকে সমালোচনা করেছেন। ছাত্রদের রাষ্ট্রের সুবিধাভোগি শ্রেণি বলে যে অভিযোগ করেছিলেন ছাত্ররা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তা প্রতিহত করেছেন। গত ২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘দ্রোহযাত্রা’ সমাবেশ শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত গণমিছিল করেন বিক্ষোভকারীরা। গত ২ আগস্ট বিকেল ৩টায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গান-কবিতা-পথ নাটক পরিবেশনের পর এ মিছিল শুরু হয়। শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ডাকা ‘দ্রোহযাত্রায়’ যোগ দেন কয়েক হাজার মানুষ। যাত্রাটি জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর ও টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। যাত্রার শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তাঁদের দাবি এখন একটাই, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে আনতে হবে। সরকারের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার নেই। তবে অনেক বিচার বকেয়া রয়েছে। ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ বিচার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখন প্রধান এজেন্ডা (আলোচ্য বিষয়) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে গত ২ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। জুমার নামাজ শেষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল শুরু হয়ে হাইকোর্ট এলাকা ঘুরে শাহবাগে কিছুক্ষণ অবস্থান করে কয়েক হাজার মানুষ। প্রেসক্লাবে কর্মসূচি শেষে বিশাল মিছিল নিয়ে শিক্ষা ভবনের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য হয়ে শহীদ মিনারে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। শাহবাগ মোড়ে অবস্থানকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজ শাখার অন্যতম সমন্বয়ক রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন ঘোষণা দেন, ৯ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। পরে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবের দিকে চলে যান। ওই দিন বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত শিল্পী ও সাধারণ মানুষ ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে শামিল হন। তারা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, বিচার ও হত্যার দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলেন। ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে ওই দিন বেলা ১১টায় ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে আবাহনী মাঠের সামনে প্রতিরোধী শিল্পীদের সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ওই দিন বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই ভরে যায় প্রতিষ্ঠানটির সামনের সড়ক। ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে চারপাশ। দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বিক্ষোভের কারণে বন্ধ হয়ে যায় কলেজের সামনের সড়কের যান চলাচল। এর আগে গত ৩১ জুলাই সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালিত হয়। তবে উত্তরায় শিক্ষার্থীরা শুক্রবার এই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘গণমিছিল’ কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ করা হয়। শুক্রবার শিক্ষার্থীরা বাধা ডিঙিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ওই সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করে। বিকেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পার্শ্ববর্তী আখালিয়া এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত এবং অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী, পুলিশ, সাংবাদিক ও পথচারী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পুলিশের দাবি, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের আখালিয়া এলাকায় অবস্থান নিয়ে অবরোধ তৈরি করেছিলেন। পুলিশ বারবার তাদের সরে যেতে অনুরোধ করে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রসহ কয়েক হাজার মানুষ। শুক্রবার জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ এলাকায় শিক্ষার্থী-জনতা জড়ো হয়। সেখান থেকে মিছিল করে তারা নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে মিছিলটি টাইগার পাস মোড় হয়ে ওয়াসার মোড়ের দিকে যায়। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ওয়াসার মোড়ের একটি পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে। তবে সেখানে কোনো পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি। মিছিলটি পরে মুরাদপুর হয়ে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বহদ্দারহাটের দিকে যাচ্ছিল। ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচিতে শুক্রবার খুলনায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পুলিশ। বেলা আড়াইটার দিকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা শিববাড়ী থেকে সোনাডাঙ্গা থানা মোড় হয়ে গল্লামারী যান। পরে বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি দল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে অবস্থান নেয়। আরেকটি দল জিরো পয়েন্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। মিছিলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দেখা যায়। তবে পুলিশ ওই সময় থানার ফটক বন্ধ করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..