বিশেষ সংবাদদাতা :
সড়ক পথে দুর্ঘটনার ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রাণহানির হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩৭ শতাংশ (৩৬.৯৪) বৃদ্ধি ঘটেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই উদ্বেকজনক তথ্য উঠে এসেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহনের বেশির ভাগ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে দেহ-মন ঠিকমতো কাজ করে না। পণ্যবাহী যানবাহনচালকদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। তাঁরা সব সময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। পরিবহনচালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসারত দুর্ঘটনাকবলিত একজন হলেন- গাজীপুরের আরিফুল ইসলাম। তিনি গুরুতর আহত রোগী হওয়ায় জরুরি ওয়ার্ডে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। তার স্বজন রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় এক সিএনজিতে ৫ জন আহত হয়। সবার অবস্থা খুবই খারাপ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছে। বাকি ২ জন গাজীপুরের একটা সরকারি হাসপাতালের আছে। আমাদের রোগীর অবস্থা খুবই নাজুক।’ জীবিত উদ্ধার হওয়া আরেকজন রোগী মাহবুব খান বলেন, ‘মাইক্রোবাসটি লোহার সেতুর মাঝ বরাবর আসার পর আকস্মিক ধসে কচুরিপানায় ভর্তি খালে ডুবে যায়। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালে। আল্লায় মোগো বাঁচাইলেও সব শ্যাষ অইয়া গ্যাছে।’ মাহবুব ও শাকিবের মতো কান্নাও আহাজারীর শেষ নাই।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২৫৬টি অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ২৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৭৮টি অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ২৯ ভাগ আঞ্চলিক সড়কে, ৭৯টি গ্রামীণ সড়কে এবং ১০৭টি শহরের সড়কে এবং ৬টি অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাগুলোর ১৬৩টি মুখোমুখি সংঘর্ষ। ৩১৪টি হয়েছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা এক হাজার ১৪৭টি। সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, সকালে ২৩ দশমিক ৮২ শতাংশ, দুপুরে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ, বিকেলে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং রাতে ২০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ২৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭২টি দুর্ঘটনায় ১৫৫ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৪৫টি দুর্ঘটনায় ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। রাজধানী ঢাকায় ৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯ নিহত ও ৩৪ জন আহত হয়েছেন।
সংগঠনটি বলছে, গত মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৬ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৫ দশমিক ৬৭ জন। জুনে তা বেড়ে গিয়ে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ২১ দশমিক ৪৬ জন। এই হিসাবে জুন মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন,দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করতে হবে। পাশাপশি দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক। মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহণ ও দীর্ঘদিন যাবত ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্র্যাপ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
এর পাশাপাশি আমাদের নৌ, রেল ও সড়ক পথে ভ্রমণ ও রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে আরো সচেতন হতে হবে। পরিকল্পিত ও সফল উদ্যোগই কেবল পারে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধ করতে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান একতাকে বলেন, ‘আমাদের সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেটা কমাতে হলে বিজ্ঞানসম্মত কাজগুলো করতে হবে। আমি একটা সড়ক তৈরি করলাম উচ্চগতির। আর সেই সড়কে যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিলাম তার অর্ধেক! তা তো ঠিক নয়। সড়কের স্পিড লিমিট হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একই সড়কে যানবাহনভিত্তিক গতিসীমা নির্ধারণ করতে গেলে অনেক কৌশলে কাজ করতে হবে। সড়কের ব্যাকরণ বলে— লেনভিত্তিক গাড়ি চলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে একই লেনে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি থাকে। লেনভিত্তিক কনসেপ্ট এখানে নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেলের লিমিট দেওয়া হয়েছে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার এবং প্রাইভেটকার-বাসের লিমিট দেওয়া হয়েছে ৮০ কিলোমিটার। এখন আমার পেছনে থাকা ৮০ কিলোমিটার গতির গাড়ির ওভারটেক করতে অসুবিধা হবে। যদি আমাদের লেনভিত্তিক ব্যবস্থা থাকত তাহলে আমরা বলতে পারতাম যে, এই লেনে শুধু মোটরসাইকেল চলবে, এই লেনে বাস এবং ট্রাক চলবে। এখন একই লেনে যদি বিভিন্ন ধরনের যানবাহন থাকে এবং তাদের গতিও যদি ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাহলে তো এখানে গতির তারতম্য আরও বাড়তে থাকবে। গতির তারতম্য থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।’
‘সেই সঙ্গে যানবাহনের সঙ্গে সড়ক অবকাঠামোর সামঞ্জস্য রাখতে হবে। যদি মোটরসাইকেলকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে সীমাবদ্ধ করতে হয়, তবে মোটর সাইকেলের জন্য আলাদা লেন লাগবে এবং সেটা সেভাবেই তৈরি করতে হবে। এখন এক্সপ্রেসওয়েতে যে অবস্থা, সেখানে এই গতি ধরে রাখা সম্ভব নয়। ফলে মামলার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।’