সাম্প্রতিক সিনেমা লাপাতা লেডিজ

একতা ফিচার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

‘অনেক দিন তো রইলে ঘরে মেয়ে, লজ্জানত শান্ত এবং বধির/ এবার না হয় উজান বেয়ে নদীর, দাঁড়াও এসে মাথায় আকাশ নিয়ে’। কিরণ রাওয়ের লাপাতা লেডিজ দেখতে বসে প্রত্যাশা তৈরি হয় এ ছবি আমাদের দেশের চিরশান্ত, চিরলাজুক এবং সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া চৌহদ্দির মধ্যে ‘সুখী’ জীবন কাটানো মেয়েদের ঘুম ভাঙানোর কথা বলবে। গ্রামের মেয়ে ফুল, বিয়ের সিঁদুর মাথায় নিয়ে, স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। নৌকা, ভিড় বাসের ছাদ এবং শেষপর্যন্ত রেলগাড়ি। সেখানে ঠিক ফুলের মতই আরও তিন-চারজন গলা পর্যন্ত ঘোমটা টানা সদ্যবিবাহিত তরুণী, ঘোমটা না সরালে যাদের কাউকেই আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। সেই লক্ষ্মীমন্ত বউয়েরা নিয়ম মেনে ঘোমটার আড়ালে থাকে, বরের আদেশ মেনে কাঠের পুতুলের মত এই সিট থেকে ওই সিটে যায়, কপাল গুণে জানলার ধার পেলেও ঘোমটা সরানোর উপায় নেই, তাই ঘুমিয়েও পড়ে ওভাবেই। শুধু তাদের গয়নায় মোড়া নির্জীব হাতগুলো বেরিয়ে থাকে রক্তমাংসের অস্তিত্ব জানান দিতে। রাতের স্টেশনে তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে ওই ঘোমটার সুবাদেই বউ বদলে যায়। ফুলের স্বামী ভালমানুষ দীপকের সাথে নেমে পড়ে জয়া, আর জয়ার স্বামী লম্পট প্রদীপের সাথে নামতে হয় ফুলকে। ফুল প্রায় পালিয়ে বাঁচে, অনেক হয়রানির পর স্টেশনের ভবঘুরে ছেলের সাহায্যে মঞ্জু মাইয়ের মত এক পোড় খাওয়া স্নেহশীলা মাতৃসমার আশ্রয়ও জোটে। দীপকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে স্টেশনই তার প্রায় ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে। মঞ্জু মাইয়ের দোকানে কাজ করে, খাবার বানিয়ে প্রথম নিজে কিছু উপার্জন করার আনন্দ খুঁজে পায়। মিষ্টি স্বভাবের গুণে ফুলকে সকলেই ভালবাসে। ওদিকে দীপক বউয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে থানা-পুলিশ করে, ফুলের বিরহে মদ খায়, রাতের বিছানায় ফুলের স্বপ্ন দেখে। জয়া কিন্তু নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে বেশ আনন্দেই থেকে যায় দীপকের মা-ঠাকুমার নিরাপদ ঘরোয়া আশ্রয়ে, দীপকের বউদির নিঃসঙ্গ জীবনে একমুঠো টাটকা বাতাস হয়ে। জয়া ওরফে পুষ্পা অন্য ধাঁচের মেয়ে। সে ঘোমটা তুলে স্পষ্টভাবে চোখের দিকে তাকাতে পারে, গুছিয়ে কথা বলতে পারে, দীপকের বউদির ছবি আঁকা আর দীপকের মায়ের রান্নার দক্ষতার প্রশংসা করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, ধানজমির পোকা মারার জন্য কীটনাশকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপায় বাতলে দিতে পারে, এমনকি মন্দিরে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে গয়না বিক্রি করে মানি অর্ডারও করতে পারে। সিনেমার গল্প এর চেয়ে বেশি বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু লাপতা লেডিজ দেখে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল সোশাল মিডিয়ায়, সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, ৯০% ক্ষেত্রেই মন টেনেছে দীপক আর ফুলের মিষ্টি প্রেম, তাদের বিচ্ছেদ ও মিলন। এই বিশ্বাসহীনতার যুগে দীপকের মত ভাল বউ অন্তপ্রাণ ছেলেও যে আছে, মাত্র কদিনের আলাপ আর দুদিনের বিয়ে করা বউয়ের বিরহে যে এমন শোকাকুল হয়, বউকে সসম্মানে ফিরিয়ে নেয় এসব দেখে মনের শান্তি আর প্রাণের আরাম মেলে। তাই সেই নির্মল ভালবাসার ছোট ছোট দৃশ্য, মিষ্টি সংলাপ, অরিজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে বিরহের গান ভাইরাল হয়েছে। তুলনায় আড়ালে থেকে গেল জয়া যে চরিত্রটার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পাওয়ার কথা। মেধাবী ছাত্রী জয়া পড়াশোনা ভালবাসে, এখনই বিয়ে করতে চায় না। জৈব চাষ নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। নিজের ইচ্ছের কথা সে জোর গলায় বলতে পারে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়ার পর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতেও জীবন যখন আরেকটা সুযোগ এনে দেয়, সাহস করে মিথ্যে পরিচয়ের আড়াল নিয়ে জয়া সেই খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। সবচেয়ে বড় কথা, জয়া অন্য মেয়ের বন্ধু হয়ে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে উস্কে দিতে পারে। মনে রাখার মত আরও অনেক মুহূর্ত, সংলাপ আছে ছবিতে। ঘোমটা টানা বউদের নিয়ে আসতে আসতে তাদের সামনেই যখন স্বামী আর শাশুড়িরা কে কত পণ বাগাতে পেরেছে সেই আলোচনা হয়, বউ হারিয়ে যাওয়ার পরেই মদে চুমুক দিয়ে প্রদীপ যখন বলে, ‘বউ না পাই, পণের টাকা তো পেয়েছি’, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নিরুপমাকে মনে পড়ে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও যৌতুকপ্রথার বিষ গ্রামদেশের নির্মম বাস্তব। শহরেও নির্মূল হয়েছে কি? ভারি চমৎকার লাগে দীপকের বউদি আর জয়ার বন্ধুত্ব দেখে দীপকের মায়ের আক্ষেপ ভরা সংলাপ – ‘মেয়েরা সংসারে এসে বৌ, শাশুড়ি, ননদ সবই তো হয়ে যায়, কিন্তু একে অন্যের বন্ধু হতে পারে না। শাশুড়ি মা, আপনি আর আমি বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করে দেখব নাকি আরেকবার?’ দীপকের মা নিজের পছন্দের সব্জি বহুদিন রাঁধেন না, বাড়ির বাকিরা খায় না বলে। ‘নিজের জন্য কেন মাঝে মাঝে করেন না?’ জয়ার এই প্রশ্নের উত্তরে হেসে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এই হাসির আড়ালে আমাদের প্রত্যেকের চেনা কোনো মা-ঠাকুমা-পিসিমার অভিমান চাপা পড়ে আছে, সারাজীবন হেঁসেল ঠেলেও যাঁরা নিজেদের জন্য নিজের পছন্দের কিছু রান্না করার কথা কোনোদিন ভাবতেই পারেননি। জয়ার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে দীপকের বউদিও জানতে পারেনি, নিছক খেয়ালের বশে সে যে ছবি আঁকে তাও একটা শিল্পকলা, চর্চা করে বাঁচিয়ে রাখার মত একটা গুণ। লাপত্তা লেডিজ ছবির আলোচনায় এমন বহু ছোটবড় জিনিস যে তেমন করে উঠে এল না, তার কারণ কি আমাদের দেখা বা ভাবতে পারার সীমাবদ্ধতা, নাকি গল্পের চলনও অনেকখানি দায়ী? আসলে গুরুত্বপূর্ণ কথা কমেডি-ড্রামায় বলতে যাওয়ার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধা মূলত বাণিজ্যিক। সেন্সরে আটকানো, প্রশ্ন ওঠার ঝামেলা থাকে না, পরিচালকের গল্প বলার ক্ষমতা থাকলে ছবি একরকমভাবে জনপ্রিয়ও হয়। যেমন করে অনেকের ভাল লেগেছে এই ছবি। কিন্তু ওই কমেডির খাতিরে মধুরেণ সমাপয়েৎ হতেই হবে। কাজেই ঘুষখোর পুলিশ অফিসার হঠাৎ ভীষণ মানবিক হয়ে জয়াকে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে দেন, কোনোরকম প্রশ্ন বা কৈফিয়ত ছাড়াই দীপকের পরিবার এতদিন নিরুদ্দেশ থাকা বাড়ির বউকে ঘরে তুলে নেয়। এই সহজ সমাধান দর্শককে ভাললাগার স্বস্তি এনে দেয় বটে, কিন্তু বাস্তবের যন্ত্রণা থেকে কিছুটা দূরেও রাখে। দেশের গ্রাম শহর পথেঘাটে কর্মক্ষেত্রে এবং অন্তঃপুরে প্রতিদিন নানাভাবে হারিয়ে যাচ্ছেন যে মেয়েরা, তাঁদের কথা বলা যদি নির্দেশকের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে দুর্দান্ত অভিনয়, নিখুঁত সম্পাদনা, টানটান চিত্রনাট্য সব মজুত থাকা সত্ত্বেও কমেডির মোড়কে এই মসৃণ পথ চলা সেই বক্তব্যের ধার এবং ভার কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। আজও কি ভাল স্বামীর সঙ্গে জীবন কাটাতে পারাই নারীজন্মের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন? ঘোমটার আড়াল সহজে চেনা যায়, কিন্তু ঘরে বাইরে আরও অজস্র আড়াল, বাধার দেওয়াল যে মেয়েদের নিজস্ব পরিচয়কে ঢেকে রেখেছে, সেসব অবরোধ কি একজন ফুল ভাল স্বামী পেলে বা একজন জয়া লড়তে চাইলেই ভাঙা সম্ভব? নাকি লড়াইটা আরও বড়, আরও কঠিন? নাগেশ কুকুনুর বেশ কিছু বছর আগে ডোর নামে একটি চমৎকার ছবি বানিয়েছিলেন মেয়েদের অবদমিত জীবন আর স্বপ্ন নিয়েই। মর্মে আঘাত করার মত ছবি। কিরণের মত পরিচালকরা যখন বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে ভাবছেন, আরেকটু গভীরে ভাবার ঝুঁকি নিতে পারেন না কি? শরৎচন্দ্র শেষ প্রশ্নে ‘শুধু কোমল পেলব রসানুভূতিই নয়, ইনটালেক্টের বলকারক আহার্য পরিবেশন করাটাও আধুনিক রসসাহিত্যের একটা কাজ” বলে মন্তব্য করেছিলেন। আধুনিক সিনেমারও সে দায়িত্ব পালন করার কথা।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..