* ১৬ জুলাই থেকে পাঁচ দিনের সহিংসতায় সারা দেশে প্রাণহানি দুই শতাধিক
* মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন, বিটিভি ভবন, সেতু ভবনসহ বহু রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় আগুন-তাণ্ডব
* নরসিংদীতে কারাগারের ফটক ভেঙে ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট, জঙ্গি ছিনতাই
* শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে আগুনে ঘি ঢালা হয়
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যে দাবির বিষয়ে সরকারেরও দ্বিমত নেই সেই দাবির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাঁচ দিন ধরে চলা সহিংসতায় সারা দেশে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে এত অল্প সময়ে সংঘর্ষে এত মানুষের মৃত্যু আর কখনো হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমনটি ঘটল?
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুরুতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও সরকারের দিক থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হয়নি। আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করলেও পুলিশ তাতে বাধা দেয়নি। শুরুতে ছাত্রলীগের অবস্থানও ছিল সহনশীল। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে। ১৪ জুলাই ওই সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এর প্রতিক্রিয়ায় সেই রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সেখানে শিক্ষার্থীদের সমাবেশে দেওয়া একটি শ্লোগান নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়। যদিও শ্লোগানটি অল্প সময়ের মধ্যেই পরিবর্তন করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরদিনই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের প্রকাশ্য নির্দেশনায় মাঠে নামে ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সেদিনই।
আন্দোলনকারীদের ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের অবরোধ কর্মসূচির কারণে গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সেদিন সংঘাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। পরের দুদিনে আরও কমপক্ষে ৪১ জনের প্রাণহানির খবর জানা যায়। ১৯ জুলাই সহিংসতার পাশাপাশি ধ্বাংসাত্মক কার্যক্রমের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে রাত ১২টা থেকে সরকার কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য করে। সেদিন সারা দেশে অন্তত ৮৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও ২০ জুলাই বিভিন্ন স্থানে ২১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওই পাঁচ দিনের সহিংসতায় আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ। গুরুতর আহত বেশ কয়েকজন পরে মারা যান। নরসিংদীতে কারাগারের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ৬০টির বেশি চাইনিজ রাইফেলসহ ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নেওয়া হয়। কারাগারে বন্দী থাকা ৯ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
এর আগে ১৬ জুলাই নাগাদই ছাত্র বিক্ষোভ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছিল। ক্ষমতাসীন দল বিষয়টিকে ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেদিন এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, এই আন্দোলন হচ্ছে কোটাবিরোধিতার নামে সরকারবিরোধী আন্দোলন।’ তিনি দাবি করেন, আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়েছেন বিএনপি নেতা তারেক রহমান। কাদের বলেছিলেন, ‘তার (তারেক রহমান) দল বিএনপি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে। একটা অরাজনৈতিক ইস্যুকে সমর্থন দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চক্রান্ত তারা করছে।’
অন্যদিকে বিএনপির নেতারা বলছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান ১৬ জুলাই বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, সরকার মুখে যা কিছুই বলুক না কেন বাংলাদেশের বর্তমান অন্যায় বাস্তবতা নতুন প্রজন্ম স্বীকার করতে রাজি নয়। এবং অতি দ্রুত সময়ে এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সার্বিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
বিএনপির নেতারা আগে যা-ই বলুন না কেন, দুদিনের মাথায় কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে সমগ্র জাতির মুক্তির আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ১৮ জুলাই রাতে এক ভার্চুয়াল বিবৃতিতে বলেন, আর সামান্য একটা ধাক্কা, তাহলেই দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে দাবির বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত ছিল সেই দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কেন প্রতিপক্ষ বানানো হলো? এর আগে ২০১৮ সালেও কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছিল। তখনও ক্ষমতাসীনেরা আন্দোলনকারীদের ‘প্রতিপক্ষ’ বানিয়েছিল। আমরা সাপ্তাহিক একতার গত সংখ্যায় লিখেছিলাম, ২০১৮ সালে সরকারপ্রধান জেদের বশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে দিয়েছিলেন। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন, তিনি বিরক্ত হয়েই কাজটি করেছিলেন। অথচ একজন সরকারপ্রধানের এমন আচরণ শপথ ভঙ্গের শামিল। নানা বিষয়ে সরকারপ্রধানের অহংবোধ প্রসঙ্গ তুলে ধরে গত সপ্তাহে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম, ব্লকেডেও দম্ভ কিছু কমবে কি-না?
না, বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতেও সরকারের দম্ভ এতটুকু কমেনি। ক্ষমতাসীনরা এবার ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে হটাতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা দেখাতে চেয়েছিল যে রাস্তায় যেকোনো আন্দোলন মোকাবেলা করার ‘রাজনৈতিক সামর্থ্য’ তাদের আছে। কিন্তু ছাত্রলীগ হালে পানি না পাওয়ায় সরকারের দম্ভ কিছুটা কমলেও ততক্ষণে জল অনেক ঘোলা হয়ে যায়। অনেক রক্ত ঝরে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক স্থাপনা। রাজধানীতে বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন এবং মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনে (মিরপুর-১০ নম্বর ও কাজীপাড়া) ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মেট্রোরেলের স্টেশন দুটির যে ক্ষতি হয়েছে, আগামী এক বছরেও তা সারিয়ে তোলা যাবে কি-না সে নিয়ে সন্দিহান কর্তৃপক্ষ। রাজধানীসহ দেশের বেশ কিছু স্থানে থানা, পুলিশ বক্স, আনসার ক্যাম্প, ডিসি অফিস, এসপি অফিসও আক্রান্ত হয়েছে।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এক পর্যায়ে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পারেননি বা ভুল বুঝেছেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, তারা ‘রাজাকার’ শব্দযুক্ত যে শ্লোগান দিয়েছিলেন সেটিরও খণ্ডিত অংশ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে যোগাযোগের একটি ফারাক ছিল। সেই ফারাকটি হাইকোর্টের আদেশের পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কোটার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আসার পরই যখন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়ল, তখনই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে রায়ের বিষয়টি বোঝানো গেলে এবং পূর্ণাঙ্গ রায় আসার পর সেই আলোকে কোটা সংস্কারের আশ্বাস দেওয়া হলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াতো বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে আন্দোলনের নেতারাও যেভাবে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন একটি বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে জরুরি সংসদ ডেকে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন, তাতে তাদের আনাড়িপনা ফুটে ওঠে। কেননা কোটা সংস্কার নিয়ে কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে না। আদালতের রায়ের আলোকে সরকার নির্বাহী আদেশ দিয়েই বিষয়টির সুরাহা করতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো আইন প্রণয়নেরই একটি প্রক্রিয়া আছে এবং সেটি সময়সাপেক্ষ। শিক্ষার্থীরা সেটি বোঝেননি কিংবা তাদের বোঝানোর চেষ্টাও করা হয়নি।
এক পর্যায়ে সরকার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখায়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৮ জুলাই দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী এই আলোচনার জন্য দুই মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখনই আলোচনায় বসতে রাজি হবেন, তখনই এ আলোচনা হবে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে এবং শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী আরও জানান, প্রতিটি মৃত্যুর ব্যাপারে হাইকোর্টের বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার নমনীয় হলেও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এক বা একাধিক গ্রহণযোগ্য বিশিষ্ট নাগরিককে কাজে লাগানো যেত। সরকার তেমন কোনো উদ্যোগও নেয়নি। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে সরকার বা ক্ষমতাসীন দল আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করে। তাতে আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার এবং ‘তৃতীয় শক্তি’র থাবা মেলার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও আগে আলোচনার কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এত প্রাণহানি ঘটত না, ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রাও এতটা তীব্র হতো না।